খুলনা
৪ এপ্রিল, ২০১৩
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
মাধ্যম: জেলা প্রশাসক, খুলনা
বিষয়: যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ শাস্তি এবং যুদ্ধাপরাধী সংগঠনবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির সহ অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধকরণ প্রসঙ্গে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
শুভেচ্ছা জানবেন। আপনি অবগত আছেন যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরসর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে খুলনাতেও। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এখন গোটা বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী সহ সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছে। এই দাবীতে পথে নেমে আসা বাংলাদেশের কোটি মানুষ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে। দেশের ষোল কোটি মানুষের সাথে এই দাবীতে খুলনার সংগ্রামী জনতাও এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি জানেন যে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর সহ সারা বাংলাদেশে যে আন্দোলন শুরু হয় তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সন্ত্রাসী অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশ জুড়ে বীভৎস তান্ডব শুরু করেছে। দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে চলছে জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের মহোৎসব। তারা ট্রেন পুড়িয়ে ফেলছে, রেললাইন উপড়ে ফেলে মৃতুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে শত শত মানুষের জীবন। দেশ জুড়ে চালাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ,ধর্ষণের মতো অপরাধ। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর উপর নেমে এসেছে অমানবিক নির্যাতনের কালো ছায়া। বাংলাদেশের জনগণের নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব যে পুলিশ বাহিনীর হাতে, তারাও আজ নিরাপদ নয় এই হিংস্র শ্বাপদের থাবা থেকে। মসজিদ, মন্দির সহ উপাসনালয়গুলো রেহাই পায়নি তাদের এই তাণ্ডব থেকে, রক্ষা পায়নি পবিত্র শহীদ মিনার। দেশের একাধিক জায়গায় জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে তাতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে এই সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবির, যা স্পষ্টতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি একটি প্রত্যক্ষ্য হুমকি। তারা হুমকি দিয়েছিল একটি গৃহযুদ্ধের, বেপরোয়া এই সন্ত্রাসী দলটি সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেই বদ্ধপরিকর।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি এও জানেন, বাংলাদেশের কতিপয় সংবাদমাধ্যম এই সন্ত্রাসী দলটির কার্যক্রমে সহায়তা ও উস্কানি প্রদান করছে। দেশ জুড়ে আন্দোলনে যোগদানকারী তরুণ সমাজ সম্পর্কে কুৎসিত অপপ্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে এই সংবাদ মাধ্যগুলো। বাংলাদেশের ধর্মপ্রান মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে বিকৃত মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে তারা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ বদলানোর একটি ছবির সাথে মিথ্যা ক্যাপশন জুড়ে অসত্য খবরও প্রচার করেছে আমার দেশ নামক একটি পত্রিকা। এছাড়াও, আন্দোলনের অগ্রপথিক ব্লগারদের সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে চলেছে এই সংবাদমাধ্যগুলো।বিভিন্ন ব্লগে প্রকাশিত ধর্ম অবমাননা কারী লেখা গুলোও ব্যাপক আকারে প্রচার করেবাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ক্রমাগত হেয় করে চলেছে তারা। আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কুখ্যাত জামায়াত-শিবিরের অপরাধের পক্ষে সাফাই গাইতেও এসবপত্রিকা নিরলস। এবং, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে যতভাবে অপমান করা সম্ভব, তার কোনটিই তারা বাকি রাখেনি ।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তারা নির্বিচারে মিথ্যচার ও অসত্য ভাষণ চালিয়ে যাচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
১৯৭১ সালে এই ঘৃণ্য সন্ত্রাসী দলটির ভূমিকা আপনার অজানা নয়। এরসাথে একমাত্র তুলনা করা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নাৎসি বাহিনীর কার্যক্রমের সাথে। ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস পাঁচটি গণহত্যার একটি সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে,১৯৭১ সালে। আর সেই গণহত্যায় নেতৃত্ব দানকারী সংগঠনটির নাম জামায়াতে ইসলামী। অত্যন্ত বেদনা এবং হতাশার সাথে আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতারপর বিভিন্ন কারণে এই ঘৃণ্য অপরাধী দল এবং যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার আমরা করতে পারিনি। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে, নিষিদ্ধ থাকার পরেও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসতে পেরেছে। তার সাথে নতুনরূপে ফিরে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির নামে। একাত্তরের কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীগঠনে এই দলটিই প্রধান ভূমিকা রাখে। ঘৃণিত এসব দলের প্রত্যাবর্তনের পরে আবারও তীব্র আতঙ্ক ও ঘৃণা নিয়ে আমরা দেখেছি রগ কাটার সংস্কৃতি, আমরাদেখেছি ভয়াবহ সন্ত্রাস। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রদের খুন হয়ে যাওয়া। ২০১০ সালে এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল তার কাজ শুরু করার পর জামায়াত-শিবির চেষ্টা শুরু করেছে একটি মরণ কামড় দেয়ার। আজ ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এসব দল তাদের সব ধরণের মুখোশ খুলে ফেলে,আবারও এদেশের স্বার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
এই পরিস্থিতিতে, গণজাগরণ মঞ্চ, খুলনা নিচের দাবীগুলো পেশ করছে :-
১) অবিলম্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন-১৯৭৩এর অধীনে বিচারের আওতায় এনে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে, এবং ভবিষ্যতে এই দলগুলোর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার সব ধরণের রাস্তা বন্ধ করতে হবে। এজন্য বিদ্যমান আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।
২) যত দ্রুত সম্ভব, বাংলাদেশের বিভিন্নঅঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ করে,পর্যায়ক্রমে সকল যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় এনে অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য দক্ষও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের দ্বারা প্রসিকিউশন টিম গঠন, প্রয়োজনেপুনর্গঠন করতে হবে। প্রসিকিউশন টিমকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। দেশের ভেতরের ও বাইরের প্রখ্যাত ও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করতে হবে।
৩) যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার কাজে নিয়োজিত সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশের ভেতরে ও বাইরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে যেসব অপপ্রচারণা চালানো হয় তার শক্ত জবাব দিতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টআইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে এসব মহলকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৪) ক্রমাগত বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচারকারী পত্রিকা দৈনিক আমারদেশ, দৈনিক নয়া দিগন্ত,দৈনিক সংগ্রাম, টিভি চ্যানেল দিগন্তটিভি সহ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণাকারী সংবাদমাধ্যমগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কুৎসিত উক্তিকারী আমারদেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে।
৫) সারা দেশে চলমান সন্ত্রাসের জন্য দায়ী জামায়াত শিবির ও তাদেরসহযোগী প্রত্যেক সংগঠনের সকল সন্ত্রাসীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। পুলিশ সদস্যও সাধারণ নাগরিক হত্যা, মসজিদ ও মন্দির ধ্বংস, নারী ধর্ষণের জন্য দায়ী অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৬) যুদ্ধাপরাধীদের মালিকানাধীন ও তাদের সহযোগী প্রতিটি অর্থনৈতিক,সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠননিষিদ্ধ করতে হবে। এসব যুদ্ধাপরাধীর দেশী ও বিদেশী প্রতিটি আয়ের উৎস খুঁজে বের করে সেগুলো বন্ধ করে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড চিরতরে ভেঙে দিতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ ১৯৭১ সাল থেকে আপন জন হারানোর তীব্রবেদনা বুকে ধারণ করে বেঁচে আছে, এই দেশের পবিত্র মাটিরএকজন সন্তান হিসেবে আপনিও তার ব্যতিক্রম নন। বিচারহীনতার যে অভিশপ্ত ছায়া এদেশেরজনগণের অদৃষ্টকে ঢেকে রেখেছে তার অপসারণের দাবীতে বাংলার মানুষ আজ ব্যাগ্র। চারদশকের পুরনো প্রেতাত্মারা আজ যখন আবার জাতীয় পতাকা খামচে ধরেছে তখন দেশের মান্নুষসোচ্চার হয়ে উঠেছে এইসব নরপিশাচদের শাস্তির দাবীতে। বাংলাদেশের সরকার প্রধানহিসেবে আপনি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের অভিভাবক। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি,বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় নিংড়ানো এই দাবীগুলো বাস্তবায়নের জন্যঅবিলম্বে আপনার সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এবং এর ফলে বাংলাদেশে চলমানগণ আন্দোলন একটি যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে।
শুভেচ্ছা আবারও।
জয় বাংলা।
বিনীত
ডাঃ সোহানা সেলিম
মুখপাত্র
গণজাগরণ মঞ্চ, খুলনা