মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। ইরান আর ইসরায়েলের লড়াই বহু দিনের, তবে এ যাত্রা তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে — কারণ এবার সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এর জবাবে ইরানও ড্রোন হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া ও ইসরায়েল সীমান্তে পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি নিয়েছে। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য এক অজানা আতঙ্ক আর উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি:
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন — যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই ইরানকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে চায়, নাকি ইসরায়েলকে তুষ্ট রেখে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়?
সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, ইরানের ওপর হামলা মূলত ইসরায়েলকে দেখানোর জন্য — ‘‘তোমার পাশে আমরা আছি!’’ আর ইরানও এই চিত্র ভালো করেই বুঝে হামলার আগে তাদের গোপন পারমাণবিক ও রাসায়নিক সম্পদ নিরাপদ বাঙ্কারে সরিয়ে ফেলেছে। ফলে কোটি কোটি ডলার খরচ করে যে বোমাবর্ষণ হয়েছে, বাস্তবে ইরানের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। এখানে সাধারণ মানুষের করের টাকা আর বিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বাণিজ্যই মূল চালিকা শক্তি।
রাশিয়া ও চীনের অবস্থান:
ইউক্রেন যুদ্ধেই রাশিয়া জর্জরিত, তবে তাতে রাশিয়া পুরোপুরি থেমে নেই। গোপনে কূটনৈতিক সমর্থন আর সীমিত অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে ইরানকে শক্তি জোগাচ্ছে। চীনও এই কৌশলগত সমীকরণে নিরবভাবে পাশে আছে, যাতে পশ্চিমা আধিপত্য রাশিয়া-চীন মিলে ব্যালেন্স করতে পারে।
ইরানের শক্তি: ধর্ম, জাতীয়তাবাদ আর আঞ্চলিক জোট:
ইরানের শক্তি কেবল সেনাবাহিনী নয় — বরং তাদের মিলিশিয়া, হিজবুল্লাহ, হুথি, আর অন্যান্য প্রো-ইরানি নেটওয়ার্ক মিলে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শক্তি বিস্তার করেছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো একক আন্দোলন না থাকলেও আঞ্চলিক ছোট ছোট জোট ইরানকে অদম্য করে তুলেছে।
আয়াতুল্লাহ খামেনি: মধ্যপ্রাচ্যের আদর্শ নেতা
যখন বহু তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র পশ্চিমা চাপ আর সাম্রাজ্যবাদী নীতির সামনে বারবার মাথা নত করেছে, তখন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি প্রমাণ করেছেন কীভাবে ধর্মীয় চেতনা, জাতীয় ঐক্য আর দৃঢ় নেতৃত্ব একত্রে একটি জাতিকে অজেয় করে তোলে। খামেনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা নন — তিনি এক আদর্শ, যে আদর্শ মুসলিম বিশ্বকে শিখিয়ে দেয় কিভাবে একবিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় শক্তি আর আধুনিক রাষ্ট্রশক্তি একসাথে জাগিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে চাপে ফেলা যায়।
আজ ইরান একাই প্রমাণ করেছে যে অস্ত্র, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আর গোপন চক্রান্তের মাঝেও কিভাবে শক্ত ভিত আর আদর্শিক ভিত্তি থাকলে শত্রুপক্ষকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা যায়। অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শেখা উচিত — ‘‘শুধু মুখের ইসলাম নয়, নেতৃত্বে আদর্শ আর বাস্তবে আত্মনির্ভরশীলতা কেমন হওয়া উচিত, সেটাই খামেনি দেখিয়ে যাচ্ছেন।’’
পারমাণবিক অধিকার ও বৈশ্বিক রাজনীতি:
ইরান বহুবার বলেছে — আমেরিকা, রাশিয়া, ইসরায়েল যদি পারমাণবিক বোমা রাখতে পারে, তাহলে তাদেরও অধিকার আছে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক শক্তি গড়ে তোলার। আর এই পারমাণবিক খেলার সাথে জড়িয়ে আছে বিশাল অর্থনীতি — ক্ষেপণাস্ত্র, বাঙ্কার, যুদ্ধজাহাজ, প্রতিরক্ষা চুক্তি — সবই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য, যার টাকা ওঠে আমাদের মতো মানুষের পকেট থেকে।
যুদ্ধবিরতির নাটক:
সবচেয়ে নতুন আপডেট হলো — যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন ইরানকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিচ্ছে, আর ইরান সেই শর্তে রাজি হয়েছে যে ইসরায়েলকে আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে ‘কূটনৈতিক জয়’ বলছে, কিন্তু বাস্তবে অনেকে এটাকে ইরানের বিজয়ের ইঙ্গিত বলছে। কারণ বহু বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশের কণ্ঠ নরম করতে বাধ্য করেছে।
এখন কী হতে পারে?
১️⃣ যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে। ইসরায়েল নিজেই ঘোষণা করেছে, প্রয়োজনে আবার বড় হামলা হবে।
২️⃣ রাশিয়া ও চীনের গোপন সমর্থন ইরানকে আরও শক্তি জোগাবে।
৩️⃣ যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে পারমাণবিক চুক্তির টেবিলে ইরানকে বসাতে চাইবে।
৪️⃣ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মুসলিম ঐক্যের কথা উঠতে পারে, যা পশ্চিমা শক্তিগুলো আবার ছলে বলে ভাঙতে চেষ্টা করবে।
৫️⃣ আর্থিক বাজার, জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্যের দাম — সবকিছুর ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে।
শেষ কথা:
এই যুদ্ধ কেবল বোমা-বারুদের নয়। এটি তথ্যের যুদ্ধ, অর্থনীতির যুদ্ধ আর মানুষের মানসিকতার উপর প্রভাবের যুদ্ধ। যুদ্ধ থামাতে পারবো না — কিন্তু সত্য জেনে, গুজব এড়িয়ে, প্রতিবাদ জানিয়ে আমাদের অবস্থান জানাতে পারি। যুদ্ধ নয়, শান্তি হোক। সত্য হোক, মিথ্যা নয়। লুণ্ঠন নয়, ন্যায়বিচার হোক এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২৫ দুপুর ১:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



