মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ নিজের অস্তিত্ব, প্রাণের উৎস, মৃত্যুর পরবর্তী পরিণতি এবং এ বিশ্বজগতের রহস্যময়তার ব্যাখ্যা খুঁজে ফিরেছে। কেউ আল্লাহ কিংবা ঈশ্বরে আশ্রয় খুঁজেছে, কেউবা যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোয় প্রশ্ন তুলেছে সেই সত্ত্বার অস্তিত্ব নিয়েই। এই দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। বরং বিশ্বাস ও অবিশ্বাস মানবজীবনের বোধ, অভিজ্ঞতা ও দর্শনের গভীরে প্রোথিত এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব।
ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি যেমন আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, নৈতিক বিধিনিষেধ এবং জীবনের পরকালীন বিচারে আস্থাশীল, তেমনই নাস্তিক বা সংশয়বাদী ব্যক্তি এইসব বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন—তারা যুক্তির আলোয় সত্যকে অনুসন্ধান করতে চান। আর এখানেই জন্ম নেয় মতাদর্শগত, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, যা কখনো একে অপরের বিরোধিতা করে, কখনো আবার সহাবস্থানের সন্ধান করে।
বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাস: মানুষের চেতনায় এই দ্বন্দ্ব চিরকালীন
মানুষ জন্মগতভাবে জ্ঞানান্বেষী প্রাণী। আমরা যা জানি না, তার অর্থ খুঁজতে চাই। এই অনুসন্ধান থেকেই জন্ম নেয় বিশ্বাস—আমাদের চেতনার ঊর্ধ্বে কেউ আছেন যিনি সবকিছু পরিচালনা করেন। আবার এই অনুসন্ধানই জন্ম দেয় সংশয়—যে কিছু অনুভব, যাচাই ও পরীক্ষার বাইরে, তা কি আদৌ রয়েছে? এই দ্বিধা থেকেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস। একদিকে ধর্ম আমাদের দেয় নৈতিক গাইডলাইন, অস্তিত্বের অর্থ এবং অন্তিম আশ্রয়ের অনুভূতি; অন্যদিকে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতা আমাদের আহ্বান জানায় প্রশ্ন তুলতে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে এবং অন্ধ আনুগত্য পরিহার করতে। এই দ্বন্দ্ব শুধু চিন্তায় সীমাবদ্ধ নয়—এটি মানুষের সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা, এমনকি আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে। এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব মানব ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মানসিক ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।
ধর্ম ও নাস্তিকতা: শুধুই মতবাদ নয়, এটি একটি অস্তিত্বের দার্শনিক প্রশ্ন
ধর্ম ও নাস্তিকতা একে অপরের পরিপন্থী হলেও উভয়ের উৎস মূলত একই—জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য খোঁজা। ধর্ম বলে, এই জগতের ঊর্ধ্বে একজন সর্বশক্তিমান আছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন সবকিছু; মানুষ তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব। আবার নাস্তিকতা বলে, এই মহাবিশ্ব নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনা; এতে কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন নেই। তবে এই পার্থক্য কেবল বিশ্বাস আছে না বিশ্বাস নেই এই দ্বৈততার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি আরও গভীর, একটি অস্তিত্বগত প্রশ্ন—আমি কে?, আমি কেনো এখানে?, আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?, আমার মৃত্যুর পরে কী হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ খুঁজে পায় ঈশ্বরে, কেউ খুঁজে ফেরে বিজ্ঞানে, কেউ বা খুঁজে নিজস্ব জীবনদর্শনে। ধর্মীয় বিশ্বাস হোক কিংবা নাস্তিক চেতনা—উভয়েই মানুষকে এক গভীর আত্মোপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু যখন এই মতবাদগুলো চরমে পৌঁছে যায়—তখনই সৃষ্টি হয় সংঘর্ষ, অস্থিরতা ও বিভাজন।
১. নাস্তিকতার শ্রেণিবিন্যাস ও সংশয়বাদী মনের অন্বেষণ
নাস্তিকতা—শুধু একটি বিশ্বাস না থাকা নয়, বরং এটি একধরনের দার্শনিক অবস্থান, যা যুক্তি, অভিজ্ঞতা, প্রশ্নবোধ ও ব্যক্তি-মনস্তত্ত্বের জটিল পরিপ্রেক্ষিতে বিকশিত হয়। সব নাস্তিক একরকম চিন্তা করেন না, এবং তারা সবাই মাবুদ, ঈশ্বর বা ধর্ম বিষয়ে একই মনোভাবও পোষণ করেন না।
নিচে নাস্তিকতার কিছু শ্রেণি আলোচনা করা হলো—
১.১ পূর্ণ নাস্তিক (Strong Atheist)
এই গোষ্ঠীটি সবচেয়ে চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ করে। তারা স্পষ্টভাবে বিশ্বাস করেন, ভগবান বা কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্তিত্ব নেই এবং এটি যুক্তি, বিজ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রতিষ্ঠিত একটি অবস্থান। তারা ধর্মকে একটি কাল্পনিক, মানব-নির্মিত ব্যবস্থা হিসেবে দেখে থাকেন, যা সমাজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এরা সাধারণত দর্শনের ধারায় বস্তুবাদ, যুক্তিবাদ এবং মার্কসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
১.২ আংশিক নাস্তিক / সংশয়বাদী (Agnostic Atheist)
এই শ্রেণির মানুষ মনে করেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। তবে তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসও করেন না। তারা একটি প্রশ্নবোধক অবস্থানে থাকেন। যুক্তি তাদের বিশ্বাসে প্রাধান্য পায়, এবং তারা বলে থাকেন, "আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই, তাই আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ভবিষ্যতে প্রমাণ আসলে আমি খোলা মন নিয়ে বিবেচনা করব।"
❝এরা যুক্তিকে প্রমাণের উপরে স্থান দেন, কিন্তু যুক্তির বাইরে যা কিছু তারা খোলামেলা অনুসন্ধানের জন্য উন্মুক্ত রাখেন।❞
১.৩ সংস্কৃতিনির্ভর নাস্তিক (Cultural Atheist)
অনেকেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব পালন করেন, সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিয়ে, জন্ম, মৃত্যুতে ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশ নেন, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। এরা ধর্মকে মূলত সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেন, বিশ্বাস হিসেবে নয়। ধর্মীয় আচরণ তাদের ঐতিহ্য বা সামাজিক বন্ধনের একটি অংশ।
একজন সংস্কৃতিনির্ভর নাস্তিক পুজোর থালায় ফুল দিতে পারেন, কিন্তু ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে প্রার্থনা করেন না।
১.৪ নৈতিক নাস্তিক (Moral Atheist)
এই গোষ্ঠীটি ঈশ্বর বা ধর্ম ছাড়াই নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, ভালো-খারাপ নির্ধারণে ধর্মের প্রয়োজন নেই, কারণ নৈতিকতা জন্ম নেয় বিবেক ও সহানুভূতির মাধ্যমে। এই ধারণাটি Humanism বা মানবতাবাদ নামে পরিচিত—যেখানে মানুষ, তার মর্যাদা, স্বাধীনতা ও কল্যাণই মুখ্য।
২. সংশয়বাদী ও কৌতূহলী মন: বিশ্বাসের মাঝপথে দাঁড়ানো
মানুষের বোধ ও চেতনার বিকাশের সাথে সাথে জন্ম নেয় সংশয় ও অনুসন্ধান। অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তাকে প্রশ্ন করতে শেখায়—বিশ্বাসের ভিত কতটা দৃঢ়, নাকি এটি কেবল সংস্কারের ফল? এই মানসিক অবস্থানই একজন মানুষকে কৌতূহলী, চিন্তাশীল ও কখনো সংশয়বাদীর পথে পরিচালিত করে।
আমাদের মনকে একধরনের skeptical (সন্দেহপ্রবণ) অবস্থানে নিয়ে যায়। এমন মনের বৈশিষ্ট্য হলো:
—তারা প্রশ্ন করে, কিন্তু অস্বীকার করে না
—তারা জানতে চায়, কিন্তু হুট করে বিশ্বাস করতে চায় না
—তারা চায় যুক্তির জবাব, অন্ধ অনুসরণ নয়
এমন মানুষদের চেতনা আসলে একধরনের ধর্মীয় অনুসন্ধানী অবস্থানেও পরিণত হতে পারে। তারা হয়তো কখনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেন, কিন্তু তা হবে নিজস্ব যুক্তি ও অভিজ্ঞতায় নির্মিত—কোনো ভয় বা সামাজিক চাপের কারণে নয়।
❝সন্দেহপ্রবণতা (skepticism) একধরনের স্বাস্থ্যকর মানসিক প্রক্রিয়া, যা না শুধুমাত্র ধর্ম, বরং সমাজ, রাজনীতি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সত্য অনুসন্ধানে সহায়তা করে।❞
৩. ধর্মীয় বিশ্বাসীদের শ্রেণিবিন্যাস (Types of Religious Believers)
মানুষের বিশ্বাস বিভিন্ন মাত্রায় বিভক্ত—কেউ যুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে ধর্ম মেনে চলে, কেউ আবার অন্ধ আনুগত্যে নিজেকে সমর্পণ করে। এই বিশ্বাসীরা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখা ও মানসিক গঠনের মাধ্যমে ধর্মকে দেখে ও মানে। নিচে ধর্মীয় বিশ্বাসীদের প্রধান কয়েকটি শ্রেণির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
৩.১ পরিমিত ধর্মানুসারী (Moderate Religious)
পরিমিত ধারার ধর্মানুসারীরা ধর্মকে অন্তরসত্ত্বায় ধারণ করেন, কিন্তু তা নিয়ে চরম অবস্থান নেন না। তারা সচেতনভাবে যুক্তিকে, সহনশীলতাকে, এবং মানবতাকে গুরুত্ব দেন। এরা বিশ্বাস করেন—ধর্ম মূলত নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির পথ, কেতাবি অনুশাসনের বাইরেও ধর্মের রয়েছে একটি প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
—তারা অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
—সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সম্মানের সংস্কৃতি লালন করেন
—ধর্মকে বিভাজনের হাতিয়ার নয়, বরং আত্মোন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে দেখেন
❝পরিমিত ধারার ধর্মানুসারীরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ ও নৈতিকতার সাথে ধর্মকে সেতুবন্ধন করে দেখেন।❞
৩.২ রক্ষণশীল / ঐতিহ্যবাদী (Traditionalist Religious)
রক্ষণশীল ধারার ধর্মবিশ্বাসীরা মূলত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি অতিমাত্রায় নিষ্ঠাবান। তারা বংশপরম্পরায় চলা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, নিয়মনীতি ও বিশ্বাসগুলিকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেন। এসব নিয়ম অমান্য করলে তা অনেক সময় তাদের কাছে পাপের শামিল মনে হয়।
—তারা ধর্মীয় বিধি ও রীতিকে পবিত্র ও অপরিবর্তনীয় মনে করেন
—সামাজিক আচার-আচরণেও ধর্মীয় অনুশাসন প্রাধান্য পায়
—অন্য ধারার মানুষ বা আধুনিক ভাবনা নিয়ে সংশয় পোষণ করেন
তাদের কাছে ধর্ম মানে হলো—ঐতিহ্য, পরিচয় এবং পরিবারিক শৃঙ্খলার প্রতিচ্ছবি অনেক সময় এদের চিন্তা আধুনিকতা বা যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে, কারণ তারা পরিবর্তনকে একধরনের ভ্রষ্টতা বা ধর্ম থেকে বিচ্যুতি বলে মনে করেন।
৩.৩ চরমপন্থী / মৌলবাদী (Fundamentalists)
এই গোষ্ঠীটি ধর্মকে শুধুমাত্র একটি কেতাবি ব্যাখ্যা ও একমাত্র সত্য হিসেবে মানে। তারা ধর্মীয় গ্রন্থ, ফতোয়া, বা নেতা-প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়, এবং অন্য মত, ধর্ম বা চিন্তার প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব পোষণ করে।
—ধর্মীয় আইন বা বিধানকে তারা বৈশ্বিক আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে
—ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি হিংসা, ঘৃণা কিংবা বৈষম্যমূলক মনোভাব রাখে
—সমাজে ভয়, শাসন ও বিভক্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে
মৌলবাদীরা বিশ্বাস করে যে আমার ধর্মই একমাত্র সত্য, বাকিরা ভ্রান্ত, এবং এই মনোভাব থেকেই সন্ত্রাস, ধর্মান্ধতা ও উগ্রতা জন্ম নেয়। এই শ্রেণির মানুষরা প্রায়শই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, এবং ধর্মীয় মতাদর্শ রক্ষার নামে তারা মানবাধিকার, সংবিধান, এমনকি নিরপরাধ মানুষের জীবন পর্যন্ত ধ্বংস করতে পারে।
৪. দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎস (Source of Conflict)
সন্ত্রাসবাদকে সহিংসতা হিসেবে বিচার করতে হবে, ধর্ম বা গোষ্ঠীর নাম নয় প্রতিটি সহিংসতার পেছনে অবিচার, শোষণ ও বৈষম্যের ইতিহাস খুঁজে দেখতে হবে, ধর্মকে যেন আর কখনো রাজনৈতিক হাতিয়ার বা শাসনের অস্ত্র বানানো না হয়।
৪.১ ধর্মীয় মৌলবাদ বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা
ধর্মীয় মৌলবাদ (Religious Fundamentalism) এমন একটি চিন্তাপ্রবাহ যা ধর্মীয় গ্রন্থের ভাষ্য বা ব্যাখ্যাকে একমাত্র সত্য বলে ধরে নেয়, এবং অন্যসব ব্যাখ্যা, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর সহিংস অবিশ্বাস ও বৈরিতা পোষণ করে। মৌলবাদীরা অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, এমনকি মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতাকেও নিষিদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) ঠিক তার বিপরীত। এটি কোনো ধর্মবিরোধী ধারণা নয় বরং ধর্মীয় সহাবস্থান ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মেনে চলে। এতে সব ধর্মের মানুষ সমান মর্যাদা পায় এবং কারো উপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয় না।
ধর্মীয় মৌলবাদের সমস্যাসমূহ:
—একক ধর্মের আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা
—সামাজিক বিভাজন, জাতিগত নিপীড়ন ও সংখ্যালঘু নির্যাতন
—শিক্ষাপদ্ধতি ও নারীর অধিকারকে সংকুচিত করা
—স্বাধীন মতপ্রকাশকে ধর্ম অবমাননা নামে দমন করা
ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তি:
—ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ
—মতপ্রকাশ, বিজ্ঞানচর্চা ও নৈতিকতার বিকাশ
—নারীর অধিকারে উন্নয়ন
—সহাবস্থান ও বহুত্ববাদকে উৎসাহ দেওয়া
৪.২ ধর্ম ও আধুনিক মনস্তত্ত্ব
ধর্ম একদিকে যেমন মানুষের মানসিক আশ্রয়স্থল, তেমনি আধুনিক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখা যায় যে, ধর্ম মানুষের ভয়, অনিশ্চয়তা ও মৃত্যু-চেতনার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি এক সামাজিক কাঠামো।
আধুনিক মনস্তত্ত্বে ধর্মীয় চর্চার ভূমিকা:
—আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সহানুভূতির উন্নয়ন
—দুঃসময়ে মানসিক শান্তি ও সামাজিক সংহতি
—অনুপ্রেরণা ও আত্মসংযমের চর্চা
—কিন্তু একইসাথে, ধর্মীয় অপরাধবোধ, ভয়ভীতির সংস্কৃতি, ও সহিংসতার প্রবণতাও জন্ম নিতে পারে যখন ধর্ম থাকে একচোখা বা গোঁড়ামিতে আবদ্ধ
বিশ্লেষকরা বলেন—মানুষের মস্তিষ্ক ধর্মীয় অনুশাসনে এমনভাবে শর্তিত হয়ে যায় যে তা অনেক সময় যুক্তি, মানবতা ও বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করতে শেখায়। আবার ধর্মহীনতা থেকেও মানুষ মানসিক শূন্যতায় ভোগে। এই দ্বৈততা থেকেই জন্ম নেয় নাস্তিকতা বনাম ধর্মীয় বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, যেখানে একদিকে যুক্তি, অন্যদিকে তত্ত্ব।
৪.৩ ধর্মের নামে রাজনীতি ও সহিংসতা: ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিহাস সাক্ষী—প্রত্যেক ধর্মের পক্ষেই চরমপন্থীরা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। খ্রিস্টান ধর্মযুদ্ধ (Crusades), ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, হিন্দুত্ববাদী রণনীতি, বৌদ্ধ চরমপন্থী ভিক্ষুদের সহিংস আন্দোলন—সবখানেই ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে মানবতার বিপক্ষে যুদ্ধ করা হয়েছে।
বাস্তব উদাহরণ:
—স্পেনের ইনকুইজিশন
—ইরাক-আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন
—রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন
—হিন্দুত্ববাদী গণহত্যা ও ধর্মান্তরণ-বিরোধী আইন
—ইসলামি চরমপন্থার নাম করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার লড়াই
“সন্ত্রাসবাদ” বনাম “স্বাধীনতা সংগ্রাম”: একটি মূল্যায়ন
সন্ত্রাসবাদ আজ সবচেয়ে বিকৃত ও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত শব্দ। একই ব্যক্তিকে এক পক্ষ সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে, আরেক পক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে মনে করে। এর আসল কারণ হলো—ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিভঙ্গি।
উদাহরণ:
—ফিলিস্তিনের হামাস বা লেবাননের হিজবুল্লাহকে কেউ স্বাধীনতাকামী বাহিনী মনে করে, আবার কেউ জঙ্গি গোষ্ঠী বলে ঘোষণা দেয়।
—আফগানিস্তানে তালেবান যখন রাশিয়া বা আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়েছে, তখন তাদের মুজাহিদিন বলা হয়েছে, পরে আবার জঙ্গি তকমা দেওয়া হয়েছে।
—আমেরিকার চোখে আল-কায়েদা বা আইএস সন্ত্রাসী, কিন্তু তাদের গড়ে তোলার পেছনে কারা ছিল তা আমরা জানি।
এইসব গোষ্ঠী হয়তো সহিংসতা বেছে নিয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা এই পথে এসেছে? কে তাদের ধ্বংস করেছে, দখল করেছে, অবরোধ আরোপ করেছে, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অধিকার হরণ করেছে? পৃথিবীর বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রথমে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—নেলসন ম্যান্ডেলা, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত—কিন্তু পরে সময়ই প্রমাণ করেছে, তারা ইতিহাসের নায়ক।
৫. ইতিহাস ও আধুনিক প্রেক্ষাপট (Historical & Modern Context)
ধর্ম যখন ব্যক্তিগত থাকে, তখন তা শক্তি; কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয় ও দলীয় হয়, তখন তা বিভাজনের কারণ হয়। ধর্মহীনতা যেমন মানসিক শূন্যতা আনতে পারে, তেমনি ধর্মীয় মৌলবাদ সহিংস অন্ধত্ব সৃষ্টি করে। আমাদের প্রশ্ন করা দরকার—ধর্ম, রাষ্ট্র ও মানুষ—এই তিনের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত?
৫.১ ধর্মীয় চরমপন্থা: ক্রুসেড, জিহাদ, সন্ত্রাসবাদ
ধর্মীয় চরমপন্থা মানব ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়, যার শিকড় বহু পুরোনো এবং যার ফল এখনও বিশ্ব রাজনীতিতে তীব্রভাবে দৃশ্যমান।
—ক্রুসেড (Crusades): ১১ থেকে ১৩ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপীয় খ্রিস্টান বাহিনী পবিত্র ভূমি (জেরুজালেম) মুসলিমদের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের নামে একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করে। এটি খ্রিস্টান ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামান্তর হলেও, এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতার পুনঃবণ্টন। এর মাধ্যমে ধর্মকে জঙ্গিবাদে পরিণত করা হয়েছিল।
—জিহাদ: ইসলামের প্রকৃত অর্থে জিহাদ মানে আত্মসংযম বা ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম। কিন্তু কিছু গোষ্ঠী এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সহিংস চরমপন্থার রূপ দিয়েছে, যার উদাহরণ আজকের ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা আসলে রাজনৈতিক নিপীড়নের, সাম্রাজ্যবাদের ও সামাজিক হতাশার ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছে।
—সন্ত্রাসবাদ (Terrorism): ধর্মীয় লেবাসে সন্ত্রাস এখন প্রায় প্রতিটি ধর্মে দেখা যায়। একে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রব্যবস্থা, মিডিয়া ও সামরিক শক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করে থাকে। এদের উৎপত্তির পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, দখলদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।
৫.২ নাস্তিক রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন: সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন
বিশ্বের ইতিহাসে কিছু রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নয়, বরং ধর্মবিরোধী (anti-religious) হিসাবে নিজেদের গঠন করেছিল। এইসব রাষ্ট্রে ধর্মকে মনে করা হতো মাস্তিষ্কের আফিম, এবং তা ছিল সাম্যবাদ বিরোধী।
—সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR): ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে ধর্মকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। চার্চ বন্ধ, পাদ্রীদের হত্যা, মসজিদ ভাঙা ইত্যাদি ছিল রাষ্ট্রীয় নীতি। কিন্তু মানুষের আধ্যাত্মিক অনুরাগ ও ধর্মীয় সংস্কৃতি কখনোই পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের পর, ধর্ম ফের উত্থান লাভ করে।
—চীন: চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মচর্চা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। উইঘুর মুসলিমদের দমন, গির্জা ধ্বংস, দালাইলামার বিপক্ষে অবস্থান এর নিদর্শন। যদিও চীনের জনগণের একাংশ এখনো গোপনে ধর্ম পালন করেন।
মূল শিক্ষা: ধর্মহীন রাষ্ট্র গঠন বাস্তবে মানুষের বিশ্বাস ও মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায়। ধর্ম ব্যক্তিগত হলেও তার প্রতি মানুষের আত্মিক সম্পর্ক গভীর। দমন করে নয়, গঠনমূলক সহাবস্থানেই সমাধান লুকিয়ে আছে।
৫.৩ ভারতের হিন্দুত্ববাদ বনাম ইসলামপন্থা, ইউরোপে ইসলামভীতি, আমেরিকায় খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদ
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আজকের বিশ্ব রাজনীতির এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। ভারতের হিন্দুত্ববাদ বনাম ইসলামপন্থা, ইউরোপজুড়ে ইসলামভীতি এবং আমেরিকায় খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদ—এই তিনটি প্রসঙ্গ আমাদের দেখায় ধর্ম কীভাবে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলে ধর্মীয় পরিচয়কে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিভাজন, সন্দেহ এবং দমন-পীড়নের সংস্কৃতি, যা সমগ্র মানবজাতির সহাবস্থানের আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ভারতে হিন্দুত্ববাদ বনাম ইসলামপন্থা:
ভারতের ইতিহাস বহু ধর্মের সহাবস্থানে গঠিত হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে “হিন্দুত্ববাদ” একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে রূপান্তরিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র ধর্ম নয়, বরং হিন্দু সংস্কৃতি, ভাষা ও আচারকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
—এর ফলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, গোরক্ষা-নিয়ম, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), মব লিঞ্চিং ইত্যাদি ঘটনা বেড়ে গেছে।
—পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসলামপন্থীদের মধ্যেও ধর্মীয় র্যাডিকালাইজেশন হচ্ছে, যা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক আরও দুর্বল করছে।
ইউরোপে ইসলামভীতি (Islamophobia):
ইউরোপে ইসলামকে ভয়, সন্ত্রাস, ও সংস্কৃতি ধ্বংসকারী শক্তি হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।
—বিশেষ করে ৯/১১-পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় মিডিয়া ও রাজনীতিকরা মুসলিমদের বহিরাগত, নারী নির্যাতনকারী বা জঙ্গি হিসেবে দেখাতে পছন্দ করেন।
—ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধ, জার্মানিতে মসজিদে নজরদারি—সবই ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়ার প্রকাশ।
আমেরিকায় খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদ (Christian Nationalism):
বিশ্বের সবচেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবা হতো যে দেশটিকে, সেই আমেরিকাতেও খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদ উত্থান ঘটেছে, যেখানে মনে করা হয়:
•আমেরিকা ঈশ্বরের দেশ
•খ্রিস্টধর্মই জাতীয় আদর্শ
•গর্ভপাত, সমলিঙ্গ বিবাহ, লিঙ্গস্বাতন্ত্র্য ইত্যাদিকে ঈশ্বরবিরোধী মনে করা হয়
এই মতবাদ Donald Trump-এর মতো রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬. আধ্যাত্মিকতা, যুক্তি ও বিজ্ঞানের সন্ধিক্ষণে: মানবচেতনার নতুন দিগন্ত
আধুনিক মানবসভ্যতা আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, যুক্তিভিত্তিক চিন্তাধারা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি—এই তিনটি শক্তি একে অপরকে প্রশ্ন করছে, চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আধ্যাত্মিকতা খোঁজে আত্মার গভীর উপলব্ধি, যুক্তি খোঁজে ব্যাখ্যা, আর বিজ্ঞান খোঁজে প্রমাণ। কিন্তু এই তিন পথ কি সম্পূর্ণ ভিন্ন, নাকি মানুষের চেতনার বিকাশে তারা একে অপরের পরিপূরক? এই প্রবন্ধে আমরা সেই দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সম্ভাবনার আলোকে বুঝতে চেষ্টা করব—একবিংশ শতাব্দীর মানুষ আসলে কোন দিগন্তে এগিয়ে যাচ্ছে।
৬.১ আধ্যাত্মিকতা বনাম ধর্মীয় আনুগত্য: কোনটি সত্যিকার আত্মোপলব্ধির পথ?
আধ্যাত্মিকতা (Spirituality) ও ধর্মীয় আনুগত্য (Religious Obedience) প্রায়শই একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। একজন আধ্যাত্মিক মানুষ নিজের অভ্যন্তরের সত্যকে উপলব্ধি করতে চায়; তার আত্মার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সংযোগ খোঁজে, যেখানে কোনো রীতিনীতি, গোঁড়ামি বা মধ্যস্বত্বভোগীর প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, ধর্মীয় আনুগত্য মূলত বাইরের আচরণে কেন্দ্রীভূত—নির্দিষ্ট পোশাক, উপাসনা পদ্ধতি, রীতিনীতি ও সামাজিক পরিচয়ের ভেতর আটকে থাকে। ফলে অনেকে ধর্ম পালন করলেও আত্মোপলব্ধির কাছে পৌঁছাতে পারেন না। প্রশ্ন হলো, খোদাকে খুঁজতে আমাদের কি নিয়ম-নীতি দরকার, না নিজের মন ও বিবেকের গভীরে যাওয়াটাই যথেষ্ট? আধ্যাত্মিকতা যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অনুভবের জগৎ, ধর্মীয় আনুগত্য সেখানে দলীয়তা ও নির্দেশনার পথ। এই দ্বন্দ্বে আজকের মানুষ দিশেহারা।
৬.২ যুক্তি বনাম বিশ্বাসের লড়াই: ভবিষ্যতের পথ কোথায়?
মানবসভ্যতা শুরু থেকেই দুই ধরণের শক্তির মধ্যে ভারসাম্য খুঁজছে—যুক্তি ও বিশ্বাস। যুক্তিবাদী মানুষ সব কিছুর ব্যাখ্যা চায়; প্রশ্ন তোলে, পরীক্ষা করে, প্রমাণ চায়। বিশ্বাসীরা প্রশ্নে নয়, মেনে নেওয়াতে তৃপ্তি খোঁজে; তারা ভাবেন, সবকিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ফোরণ আমাদের যুক্তিবাদী করে তুলেছে, কিন্তু একইসঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক শূন্যতা ও তৈরি করেছে। ধর্মীয় বিশ্বাস আজও কোটি কোটি মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। কিন্তু যখন এই দুই শক্তি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তখনই দেখা দেয় সংকট। ভবিষ্যতের দুনিয়া কি এই দুই পথের সেতুবন্ধনে চলবে, না কি একে অপরকে অস্বীকার করে আরও বিভাজনের পথে যাবে?
৬.৩ বিজ্ঞান কি আধ্যাত্মিক সত্য খুঁজে পেতে পারে?
এই প্রশ্নটা শুনতে আপাতদৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ মনে হতে পারে, কারণ বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতা দীর্ঘদিন ধরে দুই ভিন্ন খাত হিসেবে বিবেচিত। বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ ও পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চলে; অথচ আধ্যাত্মিকতা অনুভব, অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধির জগৎ। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা যেমন নিউরোসায়েন্স, কোয়ান্টাম ফিজিক্স, কিংবা কসমোলজি—এই ধারণাকে আংশিক চ্যালেঞ্জ করছে। যেমন, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে দেখা যায় সচেতনতা (consciousness) পদার্থের প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। এতে প্রশ্ন উঠে: আমরা কি শুধুই শারীরিক বস্তুর সমষ্টি, না কি চেতনার অংশ? যদিও বিজ্ঞান এখনো “আত্মা” বা ঈশ্বর প্রমাণ করতে পারেনি, তবু এটি বলার সুযোগ রাখে—বিজ্ঞান একদিন হয়তো আধ্যাত্মিক সত্যেরও কিছু ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তবে সেটা হবে একেবারেই ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন পদ্ধতিতে।
উপসংহার: মানুষ, বিশ্বাস ও বিকল্প বাস্তবতার সন্ধানে
আমাদের চিন্তার যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাস—এই চিরকালীন দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। সেই দ্বন্দ্ব আজ শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং অস্তিত্বগত। একদিকে ঈশ্বরের প্রতি গভীর আনুগত্য, অন্যদিকে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি অথবা সংশয়ের গভীর পর্যবেক্ষণ। এই দুই মেরুর মধ্যে অবস্থান করছে এক বিশাল স্পেকট্রাম—আগ্নোস্টিক, সংস্কৃতিনির্ভর, নৈতিক নাস্তিক থেকে শুরু করে পরিমিত ধর্মবিশ্বাসী, ঐতিহ্যবাদী কিংবা মৌলবাদী চিন্তার অনুসারীরা। এই পরিসরে মানুষ কেবল ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করেই ক্ষান্ত নয়, বরং নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব এবং নৈতিক অবস্থানকেও প্রতিনিয়ত খুঁজে চলেছে।
ধর্ম যেমন আত্মিক প্রশান্তি ও নৈতিক ভিত্তির মাধ্যম হতে পারে, তেমনি রাজনৈতিক ও সমাজিক দমন-পীড়নের হাতিয়ারেও পরিণত হতে পারে—ইতিহাস আমাদের সেটা বহুবার দেখিয়েছে। ক্রুসেড থেকে শুরু করে জিহাদ, তালেবান থেকে হিন্দুত্ববাদ—সকল চরমপন্থা যখন নিজস্ব বিশ্বাসকে একমাত্র সঠিক বলে দাবী করে, তখন মানবসভ্যতা হারিয়ে ফেলে সহনশীলতা, হারায় যুক্তিবোধ এবং সর্বোপরি—হারায় মানবতা। আবার অন্যদিকে, নাস্তিকতা বা সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই যুক্তি, প্রমাণ এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দাবি তোলে। কিন্তু মানবজীবন শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে চলে না। অনেক প্রশ্নের উত্তর শুধু চেতনায়, অনুভবে, অথবা আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে খুঁজে পাওয়া যায়—যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ধরা পড়ে না, অথচ তার প্রভাব একান্ত বাস্তব।
এই দ্বন্দ্বের মাঝেই আমরা দেখি, আধুনিক যুগের অনেক মানুষ ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়েও আধ্যাত্মিক হতে চায়। তারা কোনও ধর্মীয় মতের অনুসারী না হয়েও বিশ্বাস করে কসমিক শক্তি, চেতনাজগতের রহস্য, আত্মার অস্তিত্ব কিংবা পুনর্জন্মে। আবার কেউ কেউ শুধুই মানবিক মূল্যবোধকেই ঈশ্বরতুল্য বিশ্বাসে রূপ দেয়। তবে এও সত্য, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটেছে সেই মুহূর্তেই, যখন ধর্ম ও নাস্তিকতা উভয়পক্ষই নিজস্ব মতকে চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ বলে দাবি করেছে। কেউ চায়নি বুঝতে—বিশ্বাস আর যুক্তি, ধর্ম আর বিজ্ঞান, আত্মা আর মস্তিষ্ক—এই সবকিছু মিলেই তো মানুষ। তাই যেকোনো একটিকে বাতিল করে দিলে মানুষ অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
তাই আজকের যুগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও প্রশ্ন করার স্বাধীনতা। কেউ যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলা ঠিক নয়; আবার কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও তাকে মূল্যহীন বা হুমকি মনে করা অনুচিত। কারণ উভয় পক্ষের লক্ষ্য একটিই—একটি অর্থপূর্ণ, সুন্দর এবং ন্যায্য জীবন যাপন।
সর্বোপরি, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেকে প্রশ্ন করা—
—আমি যা বিশ্বাস করি তা কি কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, না নিজে বুঝে গ্রহণ করা?
—আমার বিশ্বাস কি আমাকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করছে?
—আমি কি ভিন্নমত পোষণকারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল?
—আমি কি নিজের মতবাদ অন্যের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি?
আমরা যদি এসব প্রশ্নের সৎ উত্তর দিতে পারি, তাহলে বিশ্বাস হোক বা অবিশ্বাস—উভয় পথেই মানবতা থাকবে অটুট, চেতনা থাকবে মুক্ত।
শেষ কথায়, এই প্রবন্ধ কেবল বিশ্বাসের সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন নয়, বরং মানব অস্তিত্বের গভীর এক অন্বেষণ। আমরা কি কেবল ঈশ্বরে বিশ্বাস করে বাঁচতে চাই, নাকি এমন এক পৃথিবী গড়তে চাই যেখানে বিশ্বাস, যুক্তি, সহনশীলতা ও মানবতা একসাথে বসবাস করতে পারে? সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।