somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির শহরে ফেরা

২২ শে নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবা মায়ের সরকারী চাকুরী আমাকে দিপু নাম্বার টু বানিয়ে দিয়েছিল।
রাজশাহী আর খুলনা বিভাগ আমি ধারাপাতের নামতার মত পড়তে পারি এক নিঃশ্বাসে।
রাজশাহী, বগুরা, গাইবান্ধা, নওগাঁ, দিনাজপুর, দামুরহুদা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, এদিকে পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, মুলঘর, অভয় নগর, যশোর, ঝিকরগাছা, শার্শা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, আরো আরো আরো....
এই সব যায়গাতেই আমরা থেকেছি বাবা এবং মা'এর বদলীর চাকুরীর বদৌলতে।

এসবগুলোর ভেতরে নাটোর আমার কাছে একদম অন্যরকম, স্মৃতির শহর হয়ে আছে। হয়ত এজন্য যে, এখানেই আমি রংধনু চিনেছিলাম প্রথম আর জীবন নাটকের আবেশটা ধরতে শুরু করেছিলাম।

নাটোর ছেড়ে ঝিকরগাছা এসেছিলাম আমরা সাতাশিতে, আমি তখন থ্রিতে।

রেল স্টেশন থেকে দশ মিনিটের দুরত্বে বন বেলঘড়িয়া ফরেস্ট অফিসের পাশে প্রাচীর ঘেরা শিশু সদনে আমরা ছিলাম।
বিশাল এক এলাকা। মেইন গেট দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই বাঁ হাতে আমাদের বাংলো, তার আগে অবশ্য বেশ ক'টি আম, জামরুল আর পেয়ারা গাছ।
সমস্ত শিশু সদনটাই গাছগাছালী, ফুল আর সবুজে ভরা ছিল।
রাস্তার দুপাশে পেয়ারা গাছের সারি। কোনার দিকে লম্বা লম্বা ইউক্যালিপটাসে ঘেরা মাঠ, বড়রা ওখানে ফুটবল খেলতো,
আর পাশে আমরা ছোটরা খেলতাম নাম না জানা সব খেলা।
তার পরেই ছিল বেত গাছ আর কাগজী লেবুর বাগান, পুরো বসন্ত জুড়ে মৌ মৌ গন্ধ।
পূর্ব দক্ষিণ কোনে বড় এলাকা নিয়ে কাশবন, এক বর্ষায় সেখানে একটা গেছো বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। তার পেছনে বড় পুকুর, ছিপছিপে বর্ষায় আমরা পুকুর পাড়ের কলাবাগানে শেয়াল দেখতে যেতাম।

আমার নাটোর ছিল ছায়াঘেরা, মায়া ভরা।
ঢাকা- নাটোর- রাজশাহী মেইন রোডের দু পাশে ছিল বিশাল বিশাল সব শীল কড়ই গাছ, সকাল দুপুর বিকেল, সব বেলাতে ছায়ায় ঢেকে রাখত। রাস্তায় টক্কর, টক্কর, টক্কর, ঘোড়ার গাড়ী,
গরুর বদলে মহিষের গাড়ি।

নাটোর থাকতে আমরা দোয়েলের গান শুনতাম শীতের হীম হীম ভোরে, আলো ফুটলে মা খালাদের হাতে বোনা উলের মোটা সোয়েটারে শরীর মাথা ঢেকে আপুদের সাথে যেতাম শিউলী ফুল কুড়াতে, কোন কোন দিন বকুল ফুল।
তারপর মসজিদে গিয়ে সুর করে দুলে দুলে আরবী পড়া আর আটটা বাজতেই টিনের বাক্স হাতে নিয়ে নতুন আসা স্কুল ভ্যানে করে বড়গাছায় কিন্ডার গার্টেনে পড়তে যাওয়া।

স্কুলে যাওয়ার পথেই ছিল বেলঘড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
নিচু একতলা টিনশেড বিল্ডিং, সামনে মাঠ, একপাশে আখ বন।
যেকোন ভাবেই হোক, আমরা জানতাম ছুটির ঘন্টা সিনেমার সেই বাথরুমে আটকে যাওয়ার ঘটনাটা ঘটেছিল এই স্কুলে।
যখনি এই স্কুল পেরুতাম, ছম ছম করে উঠতো বুকের ভেতর।

স্কুল ছুটির পরে মা বাবারা ঘুমিয়ে গেলে আমরা বাঁদরেরা, পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হয়ে শিশু সদনের পেছন সীমানা প্রাচীরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম।
ফরেস্ট অফিসের পাশ দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা চলে গেছে নাটোর সুগার মিল পর্যন্ত। এই রাস্তায় কিছুক্ষন পর পরই আখ ভর্তি লরি আসতো। আমাদের কাজই ছিল পেছন থেকে এই আখ টেনে খাওয়া।
আর নাটোরে ছিল তরমুজ; বাজারে গেলেই দেখা যেত এক তলা, দোতলা সমান উঁচু উঁচু তরমুজের গাদা।

আমার নাটোর ছিল সহজ সরল দয়ালু মানুষে ভরা।


সাতাশির পর দিন যত গিয়েছে, নাটোর কেন্দ্রিক আমার স্মৃতিগুলো আরো আরো বেশী সবুজ হয়েছে। শয়নে স্বপনে সব সময় মনে মনে বলেছি,
একদিন আসবো, ফিরে আসবো আবার...

কিছুদিন আগে দাপ্তরিক কাজে মাসখানেকের জন্য উত্তর বঙ্গে থাকতে হয়েছিল। ভুরঙ্গমারী, রাজীবপুর, রৌমারীর চর আর রঙপুর, গাইবান্ধায় প্রাণান্ত ব্যস্ততা শেষে ঢাকা ফেরার পথে বগুরার নট্রামসে একটু থেমেছিলাম। ইডেনের রিয়া'পু এখানে আছে ট্রেইনার হিসেবে, দেখা করার জন্যে।
কথায় কথায় উঠে এলো নাটোর। রিয়া'পু জানালেন এখান থেকে মাত্র এক দেড় ঘন্টার রাস্তা বাসে।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, এত কাছে!!

শেষে আবেগের কাছে হার মেনে, গাট্টি বোচকা এবং ক্লান্ত সহকর্মীদের রিয়া'পুর জিম্মায় রেখে অফিসের গাড়ীতেই নাটোর রওনা দিলাম।

নাটোরে ঢুকতেই বড় একটা ধাক্কা। বিশাল বিশাল শীল কড়ইয়ের অস্তিত্ব বিনাশ করে সেই মেইন রোড এখন পুরোদস্তর তেল চকচকে পীচ ঢালা হাইওয়ে।
মাদল বাজানো ঘোড়ার গাড়ি নেই একটাও, তার বদলে হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে বিশালাকায় সব বাস ট্রাক।
ফরেস্ট অফিস আর বেলঘড়িয়া স্কুলের মাঝামাঝি যায়গায় একটা কালভার্টের পাশে কয়েকটা টং দোকান নিয়ে বাজার মত ছিল, সেখানে এখন বিশাল এক গোল চক্কর।

বুকে চিন চিন ব্যথা নিয়ে একসময় শিশু সদনে ঢুকে আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম।
আমার কাছে মনে হতে লাগল, কোন না কোন ভাবে পুরো সদনের আয়তন ছোট করে ফেলা হয়েছে। অবকাঠামোগত পরিবর্তনতো আছেই।
চার পাশের সীমানা প্রাচীরটাই একবারেই দেখে ফেলতে পারছি আমি গেটের মুখে দাড়িয়েই।

যে বড় মাঠে ফুটবল খেলা হত, সেটাকে মনে হচ্ছে শাহবাগের টেনিস কোর্টের চেয়ে একটু বড়।
যেই হলুদরঙা দোতালা ডরমেটরীতে ছেলেরা থাকতো, সেটার পলেস্তারা খুলে ইট সুরকি বের হয়ে যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করছে।
কিছুই আমার স্মৃতির সাথে মিলছে না।

আমি স্থানুর মত কিছু সময় গেটের মুখে (বা পুরো শিশু সদনে কেন্দ্রে) দাড়িয়ে থাকলাম।
এক ভদ্রলোক এসে জানতে চাইলেন, কারো কাছে এসেছেন?
না, ঠিক তা না
ঘুরতে এসেছেন?
আসলে আমরা এক সময় এখানে ছিলাম, আমার বাবা চাকুরী করতেন।
এই যে, এই বাসাতে আমরা ছিলাম। বাঁ পাশের বাংলোটা দেখিয়ে দিলাম।
আপনার বাবার নাম কি?
বললাম।
উনি চিনলেন। না চেনার কোন কারণ ছিলনা। বাবা এই শিশু সদনের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তাঁর হাতেই এটা গড়ে উঠেছিল।

ভদ্রলোক অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমাকে সব ঘুরিয়ে দেখালেন, কিন্তু আমি কোন প্রাণের ছোঁয়া পাচ্ছিনা।
এক সময় জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, আচ্ছা কোন কারণে কি সদনের আয়তন কমিয়ে ফেলা হয়েছে? আমার কাছে খুব ছোট মনে হচ্ছে...
উনি মৃদু হেসে বললেন, না, আসলে আপনিই বড় হয়ে গিয়েছেনতো....

আমি জেনে গেলাম, মানুষ বড় হয়। আর বড় হলে কখনোই ছোট বেলায় ফেরা যায়না।
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×