উপরের ছবিটি মহামতি আইভি লেডবেটার লি'র; যিনি আইভি লি নামেই বেশি পরিচিত। আইভি লি'কে আধুনিক জনসংযোগের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে এই ভদ্রলোক সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও দ্রুতই তিনি তাঁর নিজস্ব ট্রাকে চলে আসেন এবং একটা জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শুরুতেই রুজভেল্ট এর বিপক্ষ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী জনসংযোগের কাজ পান; ওই আজকের ইন্ডিয়ার ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোরের মত। নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী পরাজিত হলেও লি মোমেন্টাম পেয়ে যান ভালোমতোই।
এর পরপরই তাঁর প্রতিষ্ঠান জন ডি রকফেলার এর নেতৃত্বাধীন কয়লাখনির মালিকদের সাথে কাজ করেন, ওই সময়ে বিভিন্ন ঘটনা-দূর্ঘটনার কারণে খনিশ্রমিকরা কঠিনভাবে ধর্মঘট পালন করছিলেন। এই খনিমালিকদের সাথে কাজ করার মধ্য দিয়েই আইভি লি’র বিখ্যাত হওয়ার পথ মসৃণ হয়ে ওঠে।
এটা ভূমিকা। আইভি লি'র গুণগান নিয়ে এই পোস্ট না। আমি কথা বলবো উপরের ছবির পাশে লেখা আইভি লি'র একটা মন্তব্য এবং সমকালীন প্রেক্ষাপটে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। বলা হয়, কয়লা খনিমালিকদের সাথে কাজ করার কিছুকাল আগে বেশ কিছু রেল দূর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নেতিবাচক ভাবমূর্তির মুখে পড়া আটলান্টিক সিটি রেল কোম্পানির সাথে ড্যামেজ কন্ট্রোলিংয়ের কাজে যুক্ত হন লি। সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত প্রেসের মুখোমুখি হওয়া এবং কাউকে কোনো তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকতো। বর্তমানে আমরা যেমনটা করি আর কি! এরকম প্রেক্ষাপটে তিনি কোম্পানিকে প্রেসের কাছে বাস্তব অবস্থা জানিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন এবং পৃথিবীর প্রথম প্রেস রিলিজটি পাঠান। এই প্রেস রিলিজের মাধ্যমেই বিশ্বের জনসংযোগ নতুন মাত্রা নিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করে।
আইভি লি'র মন্ত্রই ছিলো ‘অন্য কারও কাছ থেকে ভুল বার্তা পাওয়ার আগেই আপনি সত্যটা জানিয়ে দিন’ এবং এই মন্ত্র নিয়েই তিনি ভবিষ্যতের জনসংযোগের ধারা ঠিক করে দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলতেন ‘আগে বা পরে মানুষ সত্যটা জানবেই, তাই আগেই তাদেরকে সত্যটা জানিয়ে দিন’ যেটা উপরের ছবিতেই লেখা আছে।
পাশ্চাত্যে আইভি লি'র এই মন্ত্র মেনে চলার চেষ্টা করলেও আমাদের কাছে ওই মন্ত্র মূল্যহীন। আমরা তা মানার প্রয়োজন বোধ করি না। আমাদের বরং বিপুল আস্থা ১৯২৩ সালে প্রণীত দ্য অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এর উপরে!!! সরকারি চাকুরিতে ঢুকলেই বোধহয় সবার মাথার ভেতরে গেঁথে দেওয়া হয়- ‘শোনো, এই যে কালা কালা আদমী দেখছো, এগুলো তোমাদের প্রজাসম। এদের কাছে সত্য কথা প্রকাশের কোনো দরকার নেই।’ আজকাল অবশ্য বেসরকারি কর্পোরেটগুলোরও একই অবস্থা!
বৃটিশরা এই দেশ থেকে লেজ গুটিয়েছে সোয়া শ’ বছর আগে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা ওই লেজ দোলানোর আবেশে এখনও মজে আছি, লুজার ইংরেজের সব কালাকানুন মেনে চলছি অক্ষরে অক্ষরে। যার একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ হলেন মিজ মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা এবং তাঁর পেছনে থাকা সরকার বাহাদুর।
কোনো সময় প্রেসের সামনে আসেননি, কাজ করেন সম্পূর্ণ একটা টেকনিক্যাল সাইডে, এমন একজন কিভাবে দিনের পর দিন এতগুলো ক্যামেরা/টিভি ক্যামেরার সামনে সাংবাদিকদের চোখা চোখা প্রশ্নগুলো স্মার্টভাবে সামলে যাচ্ছেন তা বিস্ময়ের। ভদ্রমহিলার উপস্থাপনায় আমি সত্যিকারার্থেই মুগ্ধ। প্রথমদিকে প্রায় সব আকাঙ্খিত তথ্য এড়িয়ে গেলেও ইদানিং ফ্লোরা ম্যাডাম আক্রান্ত রোগীদের এলাকার নাম বলতে সম্মত হয়েছেন। আমরাও সে তথ্য পেয়ে বর্তে যাচ্ছি।
আমার এলাকায় সংক্রমণের হার ঢাকার মধ্যে বেশি, কলোনি লকডাউন করা হয়েছে- ফ্লোরা ম্যাডাম মারফত এই খবর পাওয়ার পরই রাতারাতি রাস্তা থেকে এতদিন যাদের পিটিয়ে পুলিশ সরাতে পারেনি সেই পাংখা পোলাপানের গুষ্ঠি উধাও, বিভিন্ন গলির মুখে গলিওয়ালারা নিজ খরচে বাংলা বাঁশ লাগিয়ে নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে ‘প্রবেশ নিষেধ’। তবুও কিছু মানুষ আছে রাস্তায়, তবে সেটা নিতান্তই প্রয়োজনে।
সত্য প্রকাশেই মঙ্গল, একজন আমেরিকান আইভি লি সেটা পাশ্চাত্যকে বুঝিয়েছিলেন শতবর্ষ আগে। ওরা বুঝেছিলোও। সে কারণেই আমাদের থেকে ওরা এগিয়ে আছে। হয়তো হলেও হতে পারে যে এই করেনা সংকটে বিধ্বস্ত হয়েই আমরা সেটা বুঝবো এবং নতুন করে এগুতে শুরু করবো। যেহেতু লি'র আমেরিকা এখন আবার তথ্য গোপন শুরু করেছে। বৃত্ত পূর্ণ হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:৫৫