নিজের কাঁধের দায় সরাতে বাঙালির দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মত বেকুবি কেউ কোনোদিন করেনি, করবেও না। দেখতে দেখতে আমাদেরও সয়ে গেছে। কে কি করলো বা করলো না, তা নিয়ে কোনো হেলদোলও হয়না আর। তা ছাড়া, কি হবে রে ভাই হ্যাপার মধ্যে যেয়ে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম..
এই তো আমাদের দর্শন? তো করোনার বৈশ্বিক মহামারীতে সে দর্শন কি একটুও পাল্টালো?
করোনায় উন্নত বিশ্ব যখন আইঢাঁই করছে, নিজেদের ভুলে জেরবার হয়ে তাবড় তাবড় অর্থনীতির দেশগুলোও যখন নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, আমরা তখন হেসেছি, উপহাস করেছি। কেউই দায়িত্ব পালন করিনি। না সরকার, না রাজনৈতিক দলসমূহ, না ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, না সিভিল সোসাইটি, না ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ অথবা না আমরা এই জনগণ। সেই যে ইটালি ফেরত এক যুবকের গোষ্ঠী উদ্ধার করে আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছিলাম, তারপর এখন অব্দি আর ওমুখো হওয়ার গরজ পড়েনি আমাদের। এদিকে করোনা নিরবে নিভৃতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে গেছে।
এ দেশে কর্তা ব্যক্তি, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং তাদের পোষ্যকোটালরা ঈশ্বরের সমান সুবিধা ভোগ করে। বাংলার ধুলো-বালি, রোগবালাই তাদের নাগাল পায় না, ভাঙাচোরা হাসপাতালের ছারপোকাওয়ালা চৌকিগুলো তাদের পিঠের মোলায়েম স্পর্শ পায় না, তাদের বিচরণ থাকে নিয়ন আলোর রোশনাইয়ে, আনন্দময় কলকাকলিতে। মানিক বন্দোপাধ্যায় যেমনটা বলেছিলেন ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে- এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’ অনেকটা এ রকম এক অস্পৃশ্যতা দিয়ে তারা পৃথক করেছে আমাদের, কুবের-কপিলাদের।
আমাদের এই ঈশ্বররা ভেবেছিলো যে সংকটকালে ক্ষমতা বা টাকা দিয়ে সর্বাধুনিক সুবিধাটা তারা পাবেন। সে স্বপ্নেই তারা তেলতেলে মুখে বিভিন্ন বাতেলা ঝাড়ছিলেন আর আমরা সে সব ঐশীবাণী পেয়ে ধন্য হচ্ছিলাম। কিন্তু সে স্বপ্ন খুব দ্রুতই দুঃস্বপ্নের সাপ হয়ে যখন বেহুলার বাসর ঘরে ঢুকে গেলো, তখন তাদের কিছুটা হুশ ফিরে আসলো, মেনে নিলেন যে করোনা সাধারণ সর্দি জ্বরের চেয়ে বেশি কিছু। কিন্তু তদ্দিনে গুবলেট যা পাকানোর, তা পাকিয়ে গেছে।
আর আমরা আম জনতারা? আমাদের তো আশার কোনো শেষ নেই। 'আশা নিয়ে ঘর করি, আশায় পকেট ভরি'... অবস্থা। কি এক দৈবশক্তিতে আমরা সব সময় আশা করেছি- আর যারই হোক, আমার করোনা হবে না... প্রথমদিকে যখন ফ্লোরা ম্যাডাম তিন এর ঘরের নামতা পড়ছেন, আমরা তখন নিশ্চিন্ত মনে লুডু খেলেছি। এরপর যখন সংখ্যাটা তিন অংকে পৌঁছে গেলো, তখনও আমাদের কোনো হেলদোল হয়নি। তারপর এক সময় ফেসবুকে দেখতে থাকলাম পরিচিতদের আক্রান্ত হওয়ার খবর, তখন আমরা বললাম- এ কি গেরো রে বাবা! এ তো দেখি গায়ের উপর উঠে আসলো!
এই ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত করোনা এখন ঘাড়ের উপরেই এসে গেছে। গতকাল সকালে আমার এক সহকর্মী ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছে ‘না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের সহকর্মী তানভীর...।’
বছর চারেক আগে এই তানভীর ছেলেটা আমার ফ্লোরে কয়েকটা ডেস্ক পরে বসতো। পরে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। অমিশুক আমার সাথে খুব যে সখ্যতা ছিলো তা নয়, মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হতো। কিন্তু ছেলেটা সবার পরিচিত ছিলো। অফিসের প্রোগ্রামে পারফর্ম করতো। সে ছেলেটা নেই। কাব্য করে বলা যায়- না ফেরার দেশে চলে গেছেন...। কিন্তু যে যাচ্ছে তাঁর কাছে, অথবা তার পরিজনের কাছে এই কাব্যের কোনো অর্থই নেই, বিশেষত যখন তাঁর যাওয়াটা শুধুই আইইডিসিআর- এর একটা সংখ্যা!
করোনা এখন ভদ্রপল্লীর সীমানা মুছে দিতে চাচ্ছে। ঈশ্বরেরাও তাই আতংকিত। কিন্তু সেলাইটা যথা সময়ে না দেয়াতে মহামান্যরাসহ এখন আমরা একই লাইনে দাঁড়িয়ে গেছি। শুধু অপেক্ষা কখন ডাক আসবে- ‘নেক্সট’।
ছবিসূত্র