গেল শুক্রবার দুপুরের খাওয়া সেরে পিসিতে বসেছি। ব্লগে ঢুকে প্রথম পোস্টের শিরোনাম দেখেই আমার মুর্ছা যাওয়ার মত অবস্থা! বোল্ড করে লেখা ‘ব্লগার বিদ্রোহী ভৃগু আর নেই।’ ধপাস করে বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খেলাম। শিরোনামে পরের অংশে দেজাভু ফেজাভু কি সব লেখা ছিলো, তা দেখার মত মানসিক অবস্থা তখন আর ছিলো না। পরে, কে সংবাদটা দিচ্ছে দেখতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই জানে পানি ফিরে আসলো।
শুধু আমার একা নয়, ওই শিরোনাম যারাই দেখেছে, সবারই কাছাকাছি প্রতিক্রিয়া হয়েছে; পোস্টের নিচে প্রথম দিককার মন্তব্যগুলো দেখলেই বোঝা যায়। কিঞ্চিত সময় পরে নিজের প্রতি ব্লগারদের ভালোবাসার পরিক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে ‘পণ্ডিত’ বিদ্রোহী ভৃগু কবিতার শিরোনাম বদলে দেন।
এটা যেমন একটা উদাহরণ। তেমনি এর বিপরীত উদাহরণও আছে। এমন অনেক ব্লগার এই ব্লগেই আছেন, যাদের নাম ওই একই শিরোনামে ‘বিদ্রোহী ভৃগু’র যায়গায় থাকলে পাঠকের বিশেষ কোনো হেলদোল হতো না। এমনকি শিরোনামটা যদি সত্যিও হতো।
এই পার্থক্যর যায়গাটাই আমার আলচ্য। যে পার্থক্যটা তৈরী করে মানুষের নিজের কর্ম।
সম্প্রতি আমার খুব কাছের একজন মানুষ করোনায় হসপিটালাইজড হয়ে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক কারণেই কথা বলার সুযোগ হয়নি। উদ্বিগ্ন সময় পার হওয়ার পর তাই লম্বা সময় ধরে তাঁর সাথে ফোনে কথা হয়েছে বেশ ক’বার। এক সময় তিনি বললেন- হাসপাতালের ওই নিঃসঙ্গ সময়ে তিনি অতীতে তাঁর কৃত ভালোকাজের কথা মনে করতে চেয়েছেন, যার বদৌলতে আল্লাহর কাছে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা যায়; কিন্তু এমন কোনো কাজের কথা তিনি মনে করতে পারেননি সে সময়।
যিনি এই কথা বলছেন, আমি তাঁকে চিনি বিধায় জানি যে বাস্তবে তিনি অতিরিক্ত রকমের সৎ, নিরহংকারী, চরিত্রবান এবং ব্যবহারে অমায়িক। পরোপকারীও। যার ফলে তারকাচিহ্নিত কোনো ব্যক্তি না হওয়া সত্বেও দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন যায়গায় উদ্বিগ্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ছিলো এবং তাঁর সুস্থতা কামনায় বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রমও এই মানুষেরা গ্রহণ করেছিলো সে সময়।
প্রসঙ্গটা এ কারণে আসলো, তিনি যে ভালো কাজের খোঁজ করছিলেন বিপদ থেকে মুক্তির জন্য, সেরকম একটা বর্ণনাসম্বলিত বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে। যার সারমর্ম হলো- একদা বনি ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি সফরে গিয়ে রাত কাটানোর জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নেন। তাঁরা গুহায় ঢোকার পর একটা বিশাল পাথর উপর থেকে গড়িয়ে এসে গুহার মুখ বন্ধ করে দেয়, যা তাঁরা নড়াতে পারছিলেন না। তখন তাঁরা এই বিপদ থেকে বাঁচতে নিজেদের ভালো কাজকে উল্লেখ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং একজন একজন করে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাঁদের দোয়া কবুল করেন এবং গুহামুখ থেকে পাথর সরে যায়। (হাদিসটা অনেক বড়, চাইলে পড়ে নিতে পারেন)।
সাধারণত আমরা মনে করি যে পরকালে মুক্তির জন্যই ভালো কাজ করা প্রয়োজন। সেটাতো অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু নিজের করা ভালো কাজ, সততা, পরোপকার, দানশীলতা ন্যূনপক্ষে অপরের সাথে ভালো ব্যবহার পৃথিবীর জীবনেও বিপদমুক্তির একটা উপলক্ষ হতে পারে, যা এই হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত। আর একজন মুসলিম হিসেবে এই হাদিস অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।
বর্তমান দ্রুত ছুটে চলা সময়ে পারিপাশ্বিকতার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে দৃঢ় করার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত আমরা নিজের সাথে প্রতারণা করি। যার ফলে ‘অতো সৎ হলে এখন আর চলে না’, ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমনভাবে চলতে হবে’, ‘পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে’, 'সবাই এখন এরকমই', ‘পরেরটা পরে দেখা যাবে’ ইত্যকার নানারকম শব্দবন্ধ তৈরী হয়েছে। আসলে এ কথাগুলো দিয়ে আমরা অন্যায়ের সাথে আপসকামী হওয়ার খারাপ লাগাকে জায়েজ করতে যুক্তি সাজাই; প্রথম দিকে যেগুলো আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই আপসকামীতার চক্রে কখন যে আমি নীতিহীন, ব্যক্তিস্বার্থে বিলীন এক অন্যায়ের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়াই, নিজেও বুঝতে পারিনা। অথচ এর শুরুটা ছিলো হয়তো ছোট্ট একটা অন্যায়ের হাত ধরে। হয়তো একদিন বাসে কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে ভুলে যাওয়ায় ‘যেহেতু সে চায়নি, আমার কি দোষ’ যুক্তিতে ভর করে দশ টাকা বাঁচিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে...।
এই দশটাকা বাঁচানোর প্রবণতাই এক সময় অন্যের দশ লক্ষ কোটি টাকার অধিকার ক্ষুণ্ন করার পথ সুগম করে। তাতে করে অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলো কিছুটা বিপদে পড়ে বটে, কিন্তু অন্যায়কারী ব্যক্তিটি এ জগত-পরজগতের সব কিছুই হারিয়ে ফেলে। এমনকি শেষ যাত্রায় মানুষের ন্যূনতম সহানুভূতিটুকুও আর পায় না; যার অনুসরণ-অযোগ্য প্রমাণ গত কয়েকদিনে বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখেছি।
অন্যদিকে, ন্যূনতম ভালো ব্যবহারের মধ্য দিয়েই যে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব তার প্রমাণতো ব্লগার বিদ্রোহী ভৃগু’র ওই পোস্টেই আছে। একটা ব্লগ নামের পেছনে থাকা না দেখা একজন মানুষের জন্যও কত দরদ! এ ভালোবাসাটুকু তিনি তার নম্র ব্যবহার দিয়েই অর্জন করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা এই ভদ্র আচরণ, নম্র ব্যবহারটুকুও করতে রাজী হইনা।
দু ধরণের উদাহরণ আমাদের চারপাশে ভুরিভুরি থাকলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো আমরা চলি আমাদের মতই। বদলাই না একটুও।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২০ দুপুর ২:৪৭