আগুনের গাছ- এক গুচ্ছ আধুনিক আরবি কবিতা
কবি: অ্যাডোনিস
___________________________________________________
অনুবাদ: আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
সিরিয়ান-লেবানিজ কবি অ্যডোনিসের জন্ম ১৯৩০ সনে পশ্চিম সিরিয়ার কাশাবিন নামের একটি গ্রামে। অ্যাডোনিস তার ছদ্মনাম, আসল নাম আলি আহমাদ সাঈদ। অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের লেখকদের মতো তিনিও আবিস্কার করেছেন নির্বাসনের বেদনা ব্যাধি, তজ্জনিত সন্তাপের অপার বিস্ময়-বিদ্রোহ। তিনি একদিন বলেছিলেন আমি এমন একটি ভাষায় লিখি যেটি আমাকে নির্বাসন দিয়েছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি হল 'The Songs of Mihyar the Damascene(1961)' সেখানে তাকে আবিষ্কার করতে দেখা যায় এমন একটি কাব্যকৌশল যার মাধ্যমে তিনি কবিতার সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্বের সাথে অভিজ্ঞতার সুক্ষ্ণ পরিশীলীত বুনন, কবিতার আকর্ষণীয় নান্দনিক এবং নির্বাসনের প্রতীকী কাব্যভাষার মিলন ঘটান। ফলত ধীরে ধীরে তার কবিতা হয়ে ওঠে জটিল, নাটকীয়তায় ঋদ্ধ, বিবিধস্বরে স্নাত এবং ভাষা আর ফর্মের দিক দিয়ে অনেক নিরীক্ষাপ্রবণ। এর সাথে সাথে তিনি সংম্রিশণ ঘটিয়েছেন ক্লাসিক্যাল আরবি কবিতার মরমী গভীরতা আর স্বদেশ আশ্রিত বিপ্লবী এবং আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। সেতু গড়েছেন আরবি ভাষার সাথে পশ্চিমা আর গ্রীক-বিব্লিক্যাল ঐতিহ্যের। কবিতাকে মুক্ত করেছেন ঐতিহ্যগত, গতানুগতিক রীতিনীতি থেকে। তার দীর্ঘ লেখক জীবনে তিনি দুইবার নবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন।
আমার কলেজের সহকর্মী, ইরাকি কবি আব্বাস বোস্কানির অনুরোধে কিছু আরবিভাষী কবির কবিতা পড়ার সুযোগ ঘটে।যেমন নিজার কাব্বানি, অ্যাডোনিস, মাহমুদ দারবিশ, , বাদর শাকির আল সাঈযাব, সারগন বউলুস প্রভৃতি কবির কিছু কবিতা পড়ে ফেলি ।তবে প্রথমবার পড়েই অ্যডোনিসের কবিতার সামগ্রিক উপস্থাপনরীতিটি ভাল লেগে যায়। বিশেষ করে ভাব ও ভাষার নিরীক্ষাপ্রবণতা, প্রতীকের জাদুময় প্রয়োগ, পরাবাস্তবতা, তার তীব্র পৌরুষ, আরবি কবিতার গনগনে আগুন আর তাতে জ্বলে ওঠা নির্বাসিত এক কবির পরিশীলিত, নান্দনিক প্রাণময়তা। বন্ধুদের সাথে আমার পঠন-অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলাম। ধন্যবাদ।
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
০১/০৭/২০১০
______________________________________________
পাপের ভাষা
আমি আমার উত্তরাধিকার পুড়িয়ে ফেলি
বলি ’আমার দেশ হল কুমারী, আর
কোনো কবর নেই আমার যৌবনে।’
আমি ঈশ্বর ও শয়তান দুজনকেই অতিক্রম করি
(আমার পথ ঈশ্বর আর শয়তানের পথের অতীত)।
আমি আমার বইয়ের ভেতর দিয়ে
উজ্জ্বল সবুজ বজ্রমালার মিছিলে হাঁটছি
আর চিৎকার করছি:
আমার পরে কোনো বেহেস্ত নেই
কোনো পতন নেই
আমি পাপের ভাষা শেষ করে দিয়েছি।
সিসিফাস
আমি শপথ করছি আমি পানির উপরে লিখব
আর সিসিফাসের সাথে বহন করব নৈঃশব্দের পাথর।
আমি শপথ করছি আমি সিসিফাসের সাথে থাকব,
সিসিফাস - যে জ্বরে আর স্ফুলিঙ্গে আহত
আর অন্ধ হয়ে খুঁজছে শেষ পালকগুচ্ছ
যা দিয়ে লিখবে ধুলির কবিতা -
হেমন্ত আর ঘাসের জন্য,
আমি শপথ করছি আমি সিসিফাসের সাথে থাকব।
পতন
আমি আমার ভাষা নিয়ে
মহামারী আর আগুনের মাঝখানে
এইসব বাকহীন পৃথিবীর সাথে বাস করি।
আমি বেহেস্ত আর আপলের বাগানে
মা হাওয়া আর অভিশপ্ত গাছ আর ফলের
মালিকের মাঝখানে
প্রথম আনন্দ আর প্রথম হতাশা নিয়ে বাস করি।
আমি বাস করি মেঘ আর বিদ্যুতের মাঝখানে
একটি পাথরে -যেটি ক্রমশ বড় হয় আর
একটি পুস্তকে যেটি শিখিয়ে দেয়
গোপনীয়তা আর পতনের কাহিনী।
প্রার্থনা
হে ফিনিক্স আমি প্রার্থনা করি
তুমি ছাইয়ের ভেতরে থাকো
তুমি আর মিট মিট করে জ্বলে ওঠো না
অথবা জেগে ওঠো না আজ রাতে।
আমরা তোমার রাতের অভিজ্ঞতা এখনো নিই নি
অন্ধকারের ভেতর নৌকা ভাসাইনি এখনো।
হে ফিনিক্স আমি প্রার্থনা করি কুহকের বিনাশ হোক
আমাদের বসত হয় যেন আগুন আর ছাইয়ে।
হে ফিনিক্স আমি প্রার্থনা করি-
পাগলামি হয় যেন আমাদের সঙ্গী।
দর্শন ১
পোড়া কাঠের মুখোশ পড়ে,
হে আগুন আর রহস্যের প্রাসাদ
আমি অপেক্ষা করছি সেই ঈশ্বরের
যে অগ্নিশিখা গায়ে দিয়ে
সমুদ্রের পাকস্থলির ঝিনুক থেকে চুরি করা-
মুক্তোর মালায় সজ্জিত হয়ে এদিকে আসবে।
আমি অপেক্ষা করছি সেই ঈশ্বরের যে নিজেই বিহ্বল
দ্বিধাগ্রস্থ, রাগ করছে কান্না করছে নত হচ্ছে
আর ছড়াচ্ছে ঔজ্জ্বল্য।
তোমার মুখ হে মিহাইয়ার
সেই ঈশ্বরকে অভিবাদন জানায়।
দর্শন ২
হলুদ গম্বুজে - নীচুমখ বইগুলোতে হঠাৎ চোখ রেখে
দেখতে পাই একটি ফুটো শহর হওয়ায় উড়ছে।
একটি সিল্কের দেয়াল আর নিহত নক্ষত্র
দোল খাচ্ছে একটি সবুজ বোতলে।
দেখতে পাই রাজপুত্রের উপস্থিতিতে
একটি কান্নার মূর্তি -
বিচ্ছিন্ন অঙ্গসমূহের মাটির তাল,
অবলুণ্ঠিত।
কথোপকথন
তুমি কে? তুমি কাকে নেবে হে মিহাইয়ার?
তুমি যেখানে আছ সেখানে আছে ঈশ্বর
আর শয়তানের অতল গহ্বর
গহ্বর আসে আর যায়
আর পৃথিবীই তোমার একমাত্র অবলম্বন।
আমি ঈশ্বর বা শয়তান কাউকে নিই না
কারণ প্রত্যেকেই এক একটি দেয়াল
প্রত্যেকেই বন্ধ করছে আমার চোখ।
কেনই বা দেয়ালের বৃথা পরিবর্তন বা বদল
যখন আমার সংশয়ই তারই সংশয়
যে আলোবিতরণকারী ও সর্বজ্ঞ।
আগুনের গাছ
একটি পাতার পরিবার বসে আছে একটি ঝর্নার কাছে,
কান্নার দেশকে মোচড় দিচ্ছে আর
পানির কাছে পাঠ করছে আগুনের পুস্তক।
আমার পরিবার চলে গেছে নিঃশব্দে
আমার জন্য একটুও অপেক্ষা করে নি।
এখন কোনো আগুন নেই, নেই কোনো দাগ।
ভ্রমণ
ভ্রমণ করছ বিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছ,
হে সূর্য
আমি কিভাবে তোমার এই পদচিহ্নের কৌশল শিখি?
মাতৃভূমি
যে মুখ শুকিয়ে যায় বিষাদের মুখোশে
আমি তার কাছে মাথা নত করি।
আমি মাথা নত করি সেই রাস্তার কাছে
যার উপর দাঁড়িয়ে কান্না ভুলে যাই।
যে বাবা তার মুখে পাল উড়িয়ে -
সবুজ মেঘের মত মরে গেল
আমি তার কাছে মাথা নত করি।
যে শিশু প্রাথর্না আর জুতো পালিশের জন্য বিক্রি হয়ে যায়
(আমার দেশে আমরা সবাই প্রার্থনা করি আর জুতো পালিশ করি)
যে পাথরে আমার ক্ষুধা দিয়ে খোদাই করি এই বলে যে - ওরা
আমার চোখের মনিতে বিদ্যুৎ আর বৃষ্টির পানি হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
এবং সেই বাড়ি যার মাটি আমি বহন করি আমার ভবঘুরে জীবনে
তার কাছে আমি মাথা নত করি
এ সবই আমার মাতৃভূমি।