কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
১.
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পূর্ববাংলার মুসলমানগণ ইংরেজ সরকার চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে মনে করেছিলেন। তবে স্যার সলিমুল্লাহ এবং বিশিষ্ট অভিজাত নেতারা এই পরিবর্তনকে the mandate of the Emperor হিসাবে গণ্য করেছিলেন। ১৯১২ সালে ভারতে লর্ড হার্ডিঞ্জ আসেন। জানুয়ারিতে একটি মুসলিম ডেপুটেশন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করেন। ঐ ডেপুটেশন দেওয়ার ফলে পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের স্বার্থ বিশেষভাবে লক্ষ রাখার জন্য প্রতিবছর ঢাকায় প্রাদেশিক গভর্নরের ক্যাম্প বসার আশ্বাস পাওয়া যায়। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থায় অধোগতি যাতে না হয়, তার জন্য ঢাকায় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
১৯১২ সালে ২১ জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন–
১. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান–তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। তাদের জন্য ঢাকায় নয় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।
২. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান–তারা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ১০০০০ জনের মধ্যে ১ জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে।
পূর্ববঙ্গে প্রাইমারী এবং হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশুনা করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে। আগে সেটা দরকার। এবং যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলমানদের জন্য যে সরকারী বাজেট বরাদ্দ আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যয় হয়ে যাবে। নতুন করে প্রাইমারী বা হাইস্কুল হবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় চান নি।
৩. পশ্চিবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কিভাবে? এই ভয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
ইতিহাস ঘেঁটে এ বিষয়ে যা পাওয়া যায় আসুন একটু দেখা যাক–
কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত উদীয়মান মুসলমানদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে। চব্বিশ পরগণার জেলা মহামেডান এসোসিয়েশন ১৯১২-র ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যায় স্থাপনের বিরোধিতা করে। বলা হয় এর ফলে সমগ্র প্রদেশের মুসলমানদের শিক্ষাগত স্বার্থে পক্ষপাতদুষ্ট প্রভাব পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি করবে। (সূত্র : দি মুসলিম পত্রিকা)।
মৌলানা আকরাম খান আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ-সবিধা দানের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যবস্থা করবেন না। মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অপেক্ষা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি গুরুত্ত্ব আরোপ করেন। আবদুর রসুল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের পক্ষে ‘বিলাসিতা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তার মতে কয়েকজন ভাগ্যবানের জন্য অর্থ ব্যয় না করে বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা ব্যয় করা উচিৎ। দি মুসলমানের মতে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান, ফলে বাংলার মুসলমানের বিশেষ কিছু লাভ হবে না। বরং গরীব অথবা যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং দু-একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ স্থাপন ইত্যাদি করলে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার সম্ভব হবে।
কিন্তু ইস্টার্ন বেঙ্গল এন্ড আসাম মুসলিম লিগ সর্বসম্মতিক্রমে ঐ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তাঁরা আশা করেন ঐ কেন্দ্রীয় প্রস্তাব কার্যকরী হলে পূর্ববাংলায় শিক্ষাবিস্তারে নতুন বেগের সঞ্চার হবে। ঐ বছরেই সলিমুল্লাহ সরকারের নিকট বাংলার পূর্বাংশের মুসলমানদের জন্য পৃথক তহবিল সৃষ্টির একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু দি মুসলিম পত্রিকায় ঐ দাবী সমর্থিত হয় নি। বলা হয়েছিল ঐ দাবী ‘শিক্ষাগত বিভাগ’ সৃষ্টি করে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করবে। ঐ প্রস্তাবের পরিবর্তে সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিতে মুসলিম শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ‘স্পেশাল মহামেডান এডুকেশন অফিসার’ নিয়োগের দাবী করা হয়।
এ সময়েই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসলমান ছাত্ররা তাঁদের শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যা সমাধানের দাবীতে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা যায় প্রতি ১০,০০০ মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে মাত্র একজন স্কুলস্তর অতিক্রম করে কলেজস্তরে উন্নীত হত। দি মুসলিম পত্রিকায় মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষাবিস্তারের সাহায্যার্থে তাদের আনুপাতিক সরকারি অনুদান দাবী করা হলে মুসলমান ছাত্র আন্দোলন এক নতুন মাত্রা লাভ করে।
১৯১৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ প্রতিবেদনে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত শিক্ষার পরিকল্পনাও পেশ করা হয়েছিল। তাছাড়া উচ্চবিত্ত মুসলমানদের জন্য ঢাকায় একটি কলেজ স্থাপনের প্রস্তাবও করা হয়। দি মুসলিম পত্রিকায় উচ্চবিত্তদের জন্য কলেজ স্থাপনের প্রস্তাবটির বিরোধিতা করা হয়। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা তাদের সন্তানদের শিক্ষাদানের কোনোই অসুবিধা ভোগ করেন না বলেও যুক্তি দেখানো হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি মহামেডান এডুকেশন কনফারেন্সে ঢাকা উইনিভার্সিটি সংক্রান্ত মতভেদের অবসান হলেও ১৯২১ সালের ১ লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
১৯১২ সনের ২৭ মে সনের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে নাথান কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন-- ডিআর কুচলার, ড. রাসবিহারী ঘোষ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দ রায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডবিস্নউএটি আর্চিবল্ড, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়) প্রেসিডেন্সি কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ এইচএইচআর জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি ডাবিস্নউ পিক এবং সংস্কৃত কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ সতীশ চন্দ্র আচার্য সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ভারত সচিব ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন দেন। কিন্তু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্ববান জানান। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমস্ফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিশনের উপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ দেবার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন মাইকেল স্যাডলার।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (স্যাডলার কমিশন) ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। কিন্তু, এ কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় করার নাথান কমিটির প্রস্তাব সমর্থন করেনি। কিন্তু, ঢাকা কলেজের আইন বিভাগের সহঅধ্যক্ষ ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তিরূপে অভিহিত করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের কাঠামো তৈরি করে দেন। একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানও অর্থনীতির অধ্যাপক টি সি উইলিয়ামস অর্থনৈতিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা শহরের কলেজ গুলোর পরিবর্তে বিভিন্ন আবাসিক হলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরূপে গণ্য করার সুপারিশ করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অওতাভুক্ত এলাকায় গণ্য করার কথাও বলা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেরটি সুপারিশ করেছিল এবং কিছু রদবদলসহ তা ১৯২০ সালের ভারতীয় আইন সভায় গৃহীত হয়। ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তাতে সম্মতি প্রদান করেন। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার পি. জে. হার্টগ। তিনি ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।
ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তার ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কি মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন? শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধীতার অবসান করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদ নানাপ্রকার প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ জে হার্টজ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তিনি প্রথম ভাষণেই বলেন, 'এটি কোন মুসলিম কিংবা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি সবার এবং প্রত্যেক মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।' প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে তাকে সাহায্য করেন মি. ডাব্লিউ হোরনেল, স্যার নীলরতন সরকার, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নবাব স্যার শামসুল হুদা ও নবাবজাদা খান বাহাদুর কে এম আফজাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল “সলিমুল্লাহ মুসলিম হল”। এ হলের প্রথম প্রোভস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এ এফ রাহমান। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলিজ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুল্লাহ্ এর নামানুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের’ এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষে এর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বলিয়াদির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথরায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলের আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহে জগন্নাথ হলের প্রথম বার্ষিক সাহিত্যপত্র ‘বাসন্তিকা’ ১৯২৩ সালের প্রথমে প্রকাশিত হয়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের পর প্রভোস্ট হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।
২.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে একটি অপপ্রচার রয়েছে। কিন্তু এটা নিছকই অপপ্রচার। এর কোনো ভিত্তি নাই।
দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ১ জুলাই ২০১১ সংখ্যায় আলী নিয়ামত লিখেছেন-- ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ড. রাসবিহারী ঘোষ, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। কিন্তু এই তথ্যটির কোনো সুত্রউৎস দেননি। কিন্তু নিয়ামত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী মওলানা আকরাম খান, চব্বিশ পরগণার জেলা মহামেডান এসোসিয়েশন, ব্যাইরস্টার আব্দুল রসুল, দি মুসলিম পত্রিকার নাম উল্লেখ করেননি। আলী নিয়ামতের এই অভিযোগে এক ধরনের সত্যের অপলাপ আছে। এবং এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতও আছে।
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর গত ২৫ বৈশাখ এনটিভিতে একই অভিযোগ করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। নূরুল কবীর বাংলাদেশের অন্যতম সাংবাদিক কাম সম্পাদক। সুতরাং তিনি যখন কোনো তথ্য বলেন—দায় দায়িত্ব নিয়েই বলেন। খোঁজ খবর নিয়েই বলেন। রামাশ্যামাযদুমধুদের মত যা মুখে এলো তা বলবেন একজন সম্পাদক এটা মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু তিনিও নিয়ামত আলীর মত এই তথ্যটি কোথায় পেয়েছেন—সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু তথ্যটি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথ কোনো এলেবেলে লোক নন। তাঁর ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী চলছে। তিনি উনসত্তর বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর জীবনের সকল তথ্যই সংরক্ষিত আছে। খুঁজলে পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের পাওয়া যায় না। কাজী মোতাহার হোসেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলেনর অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি অকপটে সত্য বলছে পিছপা হননি কখনো। তিনি তাঁর এক লেখায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কিছু সাম্প্রদায়িক আচরণ তাঁর লেখায় বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা আছে। কিন্তু তিনি উল্লেখ করেননি রবীন্দ্রনাথের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার তথ্যটি। এ বিষয়ে কোনো সত্যতা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তা প্রকাশ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন--এ অভিযোগটি অধুনা পাকিস্তানপন্থী কলমজীবীরা করছেন। কিছু কিছু পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মাঝে মাঝে এ ধরনের রবীন্দ্রবিরোধিতা দেখা যায়। ফরহাদ মজহার রবীন্দ্রনাথে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোন থেকে অনেক ছিদ্রান্বেষণ করেছেন তার 'রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ' বইটিতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে মজহার কোন ছাড় দেন নি। সাদ কামালী নামে একজন গল্পকার-প্রবন্ধকার ফরহাদ মজহারের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান বিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ নানাবিধ ত্রুটি খুঁজেছেন। ডঃ আহম্মদ শরীফও রবীন্দ্রনাথে প্রজা উৎপীড়ণ খুঁজেছেন। অবাক কাণ্ড হল এই রচনাকারদের কোথাও ‘রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন’-- এই তথ্যটি নাই। রবীন্দ্রনাথ যে সব শাক সবজি কলাটা মূলোটা খেতেন, দৈ-খৈ কোথা থেকে খেতেন, কাদের ক্ষেতেখামারে সেসব উৎপাদিত হত—ফরহাদ মজহার এবং সাদ কামালী নানাপ্রকার খাটাখাটুনি করে তাও বের করে ফেলেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন—এই ধরনের রগরগে অতি বিখ্যাত রবীন্দ্রছিদ্রটি তাদের রচনাতে উল্লেখ করেননি। কেন করেননি সেটা একটা কোটি টাকার প্রশ্ন বটে। এই তথ্যটি সঠিক হলে নিশ্চয়ই তারা তাদের রচনাতে উল্লেখ না করে পারতেন না।
২০০০ সনে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) একটি তথ্য জানান যে, ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।” তিনি অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
এ জেড এম আব্দুল আলী দৈনিক সমকালে লেখেন–শোনা যায়, এই তথ্যটি (লেখক আব্দুল মতিন কর্তৃক উত্থাপিত রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোন বইতে আছে। তিনি অনুসন্ধান করে জানান – রবীন্দ্রনাথ ঐ মিটিংএ উপস্থিত থেকে এবং মিটিংএ সভাপতিত্ব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন বলে একজন লেখক উল্লেখ করেন। লেখকটি এই তথ্যটি কোথায় পেয়েছিলেন তার কোনো সূত্র ব্ইটিতে উল্লেখ করেন নাই। আব্দুল আলী জানান, বইটি ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। এবং রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই বানানো গপ্পটি ব্যবহার করা হয়। ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেন নাই।
তাহলে খুঁজে দেখা যাক ১৯১২ সালের ২৮ শে মার্চ তারিখটিকে। খুঁজে দেখব--ঐদিন রবীন্দ্রনাথ কোথায় ছিলেন? কী করেছিলেন?
১৯১২ সালের ২৮ শে মার্চ রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছেন জগদানন্দ রায়কে। জগদানন্দ রায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক, রবীন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের গৃহশিক্ষক ও শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। চৈত্র ১৫, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি লিখেছেন শিলাইদহ থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—‘কয়দিন এখানে এসে সুস্থ বোধ করছিলুম। মনে করেছিলুম সেদিন যে ধাক্কাটা খেয়েছিলুম সেটা কিছুই নয়। সুস্থ হয়ে উঠলেই অসুখটাকে মিথ্যা বলে মনে হয়। আবার আজ দেখি সকাল বেলায় মাথাটা রীতিমত টলমল করচে। কাল বুধবার ছিল বলে, কাল সন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের নিয়ে একটু আলোচনা করছিলুম—এইটুকুতেই আমার মাথা যখন কাবু হয়ে পড়ল তখন বুঝতে পারচি নিতান্ত উড়িয়ে দিলে চলবে না।' (বি, ভা. প, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৬। ২৫৩, পত্র৫)।
প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে জানাচ্ছেন, এদিনই তিনি একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম—‘ স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’।
স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি
মনের মধ্যে অনেক দূরে।
ঘোরাফেরা যায় যে ঘুরে।
গভীরধারা জলের ধারে,
আঁধার-করা বনের পারে,
সন্ধ্যামেঘে সোনার চূড়া
উঠেছে ওই বিজন পুরে
মনের মাঝে অনেক দূরে।
দিনের শেষে মলিন আলোয়
কোন্ নিরালা নীড়ের টানে
বিদেশবাসী হাঁসের সারি
উড়েছে সেই পারের পানে।
ঘাটের পাশে ধীর বাতাসে
উদাস ধ্বনি উধাও আসে,
বনের ঘাসে ঘুম-পাড়ানে
তান তুলেছে কোন্ নূপুরে
মনের মাঝে অনেক দূরে।
নিচল জলে নীল নিকষে
সন্ধ্যাতারার পড়ল রেখা,
পারাপারের সময় গেল
খেয়াতরীর নাইকো দেখা।
পশ্চিমের ওই সৌধছাদে
স্বপ্ন লাগে ভগ্ন চাঁদে,
একলা কে যে বাজায় বাঁশি
বেদনভরা বেহাগ সুরে
মনের মাঝে অনেক দূরে।
সারাটি দিন কাজে
হয় নি কিছুই দেখাশুনা,
কেবল মাথার বোঝা ব’হে
হাটের মাঝে আনাগোনা।
এখন আমায় কে দেয় আনি
কাজ-ছাড়ানো পত্রখানি;
সন্ধ্যাদীপের আলোয় ব’সে
ওগো আমার নয়ন ঝুরে
মনের মাঝে অনেক দূরে।
এই কবিতাটি গীতিমাল্য কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ৪ সংখ্যক কবিতা। এর পর বাকী ১৫ দিনে শিলাইদহে থেকে রবীন্দ্রনাথ আরও ১৭টি কবিতা বা গান লেখেন। এর মধ্যে একটি গান—আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। ১৪ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রচনার স্থান শিলাইদহ। ২৬শে চৈত্র ১৩১৮(এপ্রিল ৮, ১৯১২) বঙ্গাব্দেও তিনি শিলাইদহে। সেখান থেকে লিখেছেন—এবার আমায় ভাসিয়ে দিতে হবে আমার। এপ্রিল ১২, ১৯১২ তারিখে লিখছেন—এবার তোরা আমার যাবার বেলাতে। শিলাইদহে রচিত। তথ্য বলছে-- সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় নয়—শিলাইদহে ছিলেন।
তাহলে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কেন গেলেন? কখন গেলেন? তার একটু হদিস নেওয়া যেতে পারে।
১৯ মার্চ ১৯১২ (৬ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাসে রবীন্দ্রনাথের ইংলণ্ড যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। সঙ্গী মেয়ো হাসপাতালের ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। কবিকে বিদায় জানানোর জন্য বহু ব্যক্তি সেদিন জাহাজঘাটায় উপস্থিত। কবির জিনিসপত্রও জাহাজে উঠে গেছে আগের দিন।–কিন্তু ‘খবর এলো যে, কবি অসুস্থ; আসতে পারবেন না। ঐ গরমে উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ-অভ্যর্থনাদির আদর-অত্যাচারে রওনা হ’বার দিন ভোরে প্রস্তুত হতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে যান। ডাক্তাররা বললেন, তাঁর এ-যাত্রা কোনোমতেই সমীচীন হতে পারে না। রইলেন তিনি; আর ক্যাবিনে একা রাজত্ব করে, তাঁর বাক্স-পেটরা নিয়ে চল্লুম আমি একলা।‘ এটা লিখেছেন ডাঃ মিত্র।
রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখছেন—জাহাজ ছাড়বার আগের দিন রাত্রে স্যর আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে বাবার নিমন্ত্রণ। কেবল খাওয়া দাওয়া নয়, সেই সঙ্গে ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’ অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। দিনেন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেন। অসুস্থ শরীরে বাবাকে অনেক রাত অবধি জাগতে হল। আমরা ঘরে ফিরলাম রাত করে। বাকি রাতটুকু বাবা না ঘুমিয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলেন। ভোরবেলা উঠে বাবার শরীরের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, ক্লান্তিতে অবসাদে যেন ধুঁকছেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে হল।...জাহাজ আমাদের জিনিসপত্র সমেত যথাসময়ে পাড়ি দিল, কিন্তু আমাদের সে যাত্রা আর যাওয়া হল না।‘
আকস্মিকভাবে যাত্রা পণ্ড হয়ে যাওয়ায় খুব বেদনা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ২১ মার্চ ১৯১২ (৮ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখেন—‘আমার কপাল মন্দ—কপালের ভিতরে যে পদার্থ আছে, তারও গলদ আছে—নইলে ঠিক জাহাজে ওঠবার মুহুর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দণ্ড সেইদিনই প্রত্যুষে আমার একেবারে মাথার উপরে এসে পড়ল। রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে। এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া নড়াচড়া প্রভৃতি সজীব প্রাণীমাত্রেরই অধিকার আছে, আমার পক্ষে তা একেবারে নিষিদ্ধ।...’
২৪ মার্চ ১৯১২ (১১ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) বিশ্রামের উদ্দশ্যে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা হন। ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবহিতে লেখা আছে, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীযুক্ত রথীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীমতি বধুমাতাঠাকুরাণী সিলাইদহ গমনের ব্যায় ৩৭৯ নং ভাউচার ১১ চৈত্র ১৫।।৩।. পরদিন সোমবার ১২ চৈত্র ২৫ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ মৌচাক পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের ভগ্নী কাদম্বিনী দত্তকে (১২৮৫—১৩৫০ বঙ্গাব্দ) এক চিঠিতে লেখেন—এখনো মাথার পরিশ্রম নিষেধ। শিলাইদহে নির্জ্জনে পালাইয়া আসিয়াছি।
কোথায় কলকাতার গড়ের মাঠ?--আর কোথায় শিলাইদহ!! তাহলে ২৮ মার্চ ১৯১২ খ্রীস্টাব্দ তারিখে রবীন্দ্রনাথ কি করে শিলাইদহ থেকে অসুস্থ শরীরে কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সভায় উপস্থিত ছিলেন?
ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন জানাচ্ছেন-- রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বার্ষিক অধিবেশনের (২৮-২৯ জুন, ২০১১) আলোচনায় আসে। অধ্যাপক ফকরুল আলমের কথার অংশ থেকে লিখছি..."রবীন্দ্রনাথ একসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরোধী ছিলেন ....কিন্তু....চারপাঁচ বছর পর তার পুরানো পজিশন পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। ....অবশ্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননায় এসেছিলেন।....যারা ইতিহাসকে এক জায়গায় রেখে দেয় তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, তারা সত্যকে বিকৃত করে।...." (কার্যবিবরণী, পৃ:১৭৮)।
এই ইতিহাসবিকৃতি বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠীকর্তৃক রবীন্দ্রবিরোধিতারই একটি নমুণা। নিছক অসত্য তথ্য। গোয়েবলসের সূত্রে তথ্যটি তৈরি হয়েছিল গোপনে--করেছিলেন একজন অজানা লেখক। প্রকাশক ইসলামী ফাউন্ডেশন। আর তা বইতে লিখেছেন মেজর জেনারেল (অবঃ) আব্দুর মতিন। এবং এ বছর রবীন্দ্রনাথের স্বার্ধশত জন্মবার্ষকীর লগ্নে টেলিভিশনের পর্দায় জনগণের উদ্দেশ্য প্রকাশ করছেন--দি নিউ এজ পত্রিকার স্বনামধন্য সম্পাদক নূরুল কবীর। বলছেন নিয়ামত আলী্ নামে একজন কলাম লেখক। তথ্য পেলেই তো হবে না। তা যাচাই বাছাই করার দরকার রয়েছে।
এই ভুখণ্ডে রবীন্দ্রবিরোধিতা নতুন নয়। পাকিস্তান আমলে শুরু। এখন আবারও পাকিস্তানী কায়দার সেরকম বিরোধিতা চলছে। যারা করছেন-তাদের ভাবনার সঙ্গে পাকিস্তানপন্থার একটি সংযোগ আছে। কিন্তু একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে-- রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারই বিরোধিতা করেই থাকেন— তাহলে সেই বিরোধিতাকারী রবীন্দ্রনাথ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছর পরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন কিভাবে? তখন তো পাকিস্তান জামানা নয়। বাংলাদেশও নয়। বৃটিশ রাজত্ব চলছে। বঙ্গবিভাগ থেমে গেছে। পূর্ব বাংলার মুসলমান নেতৃবৃন্দ ক্ষুদ্ধ এই বঙ্গভঙ্গ বাতিল করার জন্য। আবার রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন। সুতরাং পূর্ব বাংলার গ্রামে গঞ্জে এবং খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা প্রদানের কোনো কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তো রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু- মুসলমান, ধনী নির্ধনী, জমিদার-প্রজা মিলে বিপুল আড়ম্বরে সংবর্ধনা দিচ্ছেন। সেখানেতো এই অভিযোগটি কেউ তুলছেন না। কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাহলে?
৩.
১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানায় বক্তৃতাদি প্রদানের জন্য। সফরসঙ্গী হয়েছিলেন—পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধু প্রতীমা দেবী, তাঁদের পালিতা কন্যা নন্দিনী, ভ্রাতষ্পুত্র দিনেন্দ্রনাথ, হিরজিভাই, মরিস, চিনা অধ্যাপক লিম নো ছিয়াঙ এবং ইতালিয়ান অধ্যাপক ফার্মিসি ও তুচ্চি।
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ তারিখে আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়— ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ নারায়ণগঞ্জে বিপুল অভ্যর্থনা গতকল্য রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় পৌঁছিয়াছেন, ঢাকায় অধিবাসীবৃন্দ তাঁহাকে বিপুল অভ্যর্থনা করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে বলিতে গেলে এইবারই রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম ঢাকায় আসিয়াছেন। ইতপূর্বে তিনি ভাল করিয়া ঢাকা পরিদর্শন করেন নাই। স্থানীয় অভ্যর্থনা-সমিতি নারায়ণগঞ্জে বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণ করিয়াছিলেন। নারায়ণগঞ্জ স্টীমার স্টেশন সেদিন জনসমুদ্রে পরিণত হইয়াছিল। স্টীমার ঘাটে আসিবার বহু পূর্ব হইতেই তথায় জনসমাগণ হইতে আরম্ভ হয়। দেখিতে দেখিতে এত লোক জড় হয় যে, কি ঘাটে, কি জেটিতে একটুকুও স্থান ছিল না। রবীন্দ্রনাথের স্টীমার ঘাটে পৌঁছিলে চতুর্দিক হইতে ঘন ঘন আনন্দধ্বনি উত্থিত হয়। কয়েকজন বিশিষ্টনেতা অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে পুষ্পমাল্যে বিভূষিত করেন এবং স্টিমার হইতে নামাইয়া আনেন।…মোটরে চড়িয়া ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেন। ঢাকা শহরের পূর্ব সীমান্তে একদল স্কাউট, বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ও শহরের বিশিষ্ট ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মোটর দৃষ্টিপথে প্রবিষ্ট হইবামাত্র ঘন ঘন জয়ধ্বনি উত্থিত হয়।...তারপর ঢাকার নবাব বাহাদুরের হাউস বোট তুরাগে কবির বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়। তুরাগে যাওয়ার পথটি কলাগাছের চারা দিয়ে সাজানো হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথকে প্রথম অভিনন্দনটি জ্ঞাপন করা হয়েছিল ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ তারিখের বিকেল চারটেয় মিউনিসিপ্যালিটি এবং পিপলস এসোসিয়েশনের উদ্যোগে ঢাকার নর্থব্রুক হলে। সমস্ত হলটি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং বাইরেও ঘন জমায়েত হয়েছিল। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারগণ মানপত্রে লেখেন—
হে জাতীয়তার দার্শনিক প্রচারক। হিন্দু-মুসলমানের স্থায়ী মিলন কেবল সাহিত্য ও শিক্ষার ভিতর দিয়াই সম্ভবপর—বর্তমান বিরোধ ও অনৈক্য সমাধানের এই গুহ্য মন্ত্র তুমি বহু পূর্ব হইতেই প্রচার করিয়া আসিতেছ। …জাতির প্রতি অত্যাচারে নিজকে লাঞ্ছিত মনে করিয়া তুমি রাজদত্ত দুর্লভ সম্মান ঘৃণায় পরিত্যাগ করিয়াছ; দেশবাসীর নিগৃহ হেতু কানাডার নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া আত্মসম্মানবোধ ও দেশনেতার জলন্ত দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছ।
এরপরই ঢাকা জনসাধারণের কর্তৃক একটি মানপত্র পাঠ করা হয়— সেখানেও নাইট উপাধি ত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এখানে একটি লিখিত বক্তব্য দেন।
করোনেশন পার্কে বিকেল ৫.৩০ এ কবিকে আরেকটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উপস্থিত ছিল দশ হাজার লোক। ঢাকা রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন মানপত্রে বলেন যে--
লর্ড কার্জন বাহাদুরের শাসনকালে বঙ্গ বিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ যখন পশ্চিবঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল তখন সেই কুট-নীতির বিরুদ্ধে আপনি কাব্যে ও সঙ্গীতে যে ভীষণ সংগ্রাম ঘোষণা করিয়াছিলেন তাহাও আজ স্মরণ-পথে উদিত হইতেছে।
নবাব বাহাদুর খাজে হাবিবুল্লাহর সভাপতিতে হিন্দু মোসলেম সেবাশ্রমের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয় হয়।
১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর দুপুর আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলে উপস্থিত হন। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী সঙ্ঘ তাঁকে একটি কাব্যাভিনন্দন প্রদান করে।
এখানেই বিকেলে মুসলিম হলে ছাত্র ইউনিয়ন সংবর্ধনার বিপুল আয়োজন করে। ছাত্রসংসদ কবিকে আজীবন সদস্যপদরূপে গ্রহণ করে। মুসলিম হলে সংবর্ধনা সম্পর্কে আবুল ফজলের স্মৃতিচারণ- ‘কবি যখন ঢুকলেন......... হল ঘরের প্রবেশ পথ থেকেই কবির উপর শুরু হয়েছে পুষ্পবৃষ্টি।’ মুসলিম হল ছাত্রবৃন্দ মানপত্রে বলেন যে, বিধাতা বড় দয়া করিয়া, প্রাণহীন ভারতের দুর্দিনে তোমার মত বিরাট-প্রাণ মহাপুরুষকে দান করিয়োছেন। তোমার প্রাণ মুক্ত, বিশ্বময়। সেখানে হিন্দু নাই, মুসলমান নাই, খ্রিস্টান নাই—আছে মানুষ। …একদিকে তুমি মানুষকে নানা কর্মধারায় জাগ্রত করিয়াছ, অন্যদিকে সেই অসীম স্রষ্টার দিকে মনকে আকৃষ্ট করিয়াছ। ‘কর্ম ও ধ্যান’ উভয়ের সামঞ্জস্য সাধনই মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। ইসলামের এই সার বার্ত্তা তোমার ছন্দে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। তোমার এই ছন্দ আমাদিগকে প্রত