( হাসান আজিজুল হকের আরো একটি অসাধারণ লেখা। প্রথম আলো থেকে নেওয়া। )
মানুষের জীবনে কিছুই শুদ্ধ নয়, আমাদের যে চিত্ত তাও নয়। তাই শুদ্ধচিত্তে কিছু বলা কত যে কঠিন। কঠিন স্মৃতিকেও শুদ্ধ রাখা। সহজেই তার মধ্যে পছন্দ-অপছন্দ, আকাঙ্ক্ষণীয়-অনাকাঙ্ক্ষণীয় বাছাইয়ের স্বভাব জড়িয়ে যায়। সে জন্য স্মৃতিকে বিশুদ্ধ করে পাওয়া কঠিন। মানুষ যখন পূর্ণ মানুষ হয়, অনেক অভিজ্ঞতা জমে, জীবনের মার খেয়ে খেয়ে পোক্ত হয়, জীবন যখন আর মসৃণ থাকে না, তখন কি আর আমরা নিরীহ থাকি? যে জীবন আর সংগ্রাম সমার্থক, সেই জীবন ও স্মৃতি তখন নানা জিনিসের মেশালে ভরে যায়।
তুলনায় শৈশবের স্মৃতির মধ্যে আমরা শুদ্ধ থাকি। সেটা চেতনার উšে§ষণ, জীবনের প্রত্যুষবেলা। পৃথিবীর মার তখনো আমাদের ওপর পড়েনি। একটা কোমল-সুন্দর পরিবেশ। সবচেয়ে দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তানও কিন্তু আদরের কোল পায়। যদিও তাদের জীবনটা ঠেকে থাকে খাদ্য পাওয়া না-পাওয়ার ওপর। সেটাই তাদের সরল জীবনের শুদ্ধ অভিজ্ঞতা। পরে তার মধ্যে মতামত ঢোকে, স্বার্থচিন্তা ঢোকে।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে। ব্যাপারটায় দেখতে পাই বড্ড অস্বস্তি। আমি বড় হয়েছি হিন্দুপ্রধান রাঢ় অঞ্চলে। সে জীবনের বহুবিধ উপকরণ মনের ওপর স্থায়ী দাগ ফেলে গেছে। সেখানে ছোট মুসলমান সমাজের যে জীবন, সেটাও দেখেছি। তাই ঈদ-পূজা-পার্বণ নিয়ে বলতে বললে আমি এই সেয়ানা হয়ে ওঠা জীবন নয়, সেই সারল্যের জীবনের দিকে ফিরে তাকাই। সেই জীবন যেন সুরভিত পুষ্পের মতো। আজও হলুদ কল্কে ফুল শুঁকলে পুরোনো দিনের পূজার স্মৃতি জাগে। আমাদের গ্রামে তিনটি পূজার মণ্ডপ বসত। তিনটিই পারিবারিক পূজা। সেখানে তখন বারোয়ারি পূজার চল ছিল না। অবস্থাপন্ন পরিবারের দুর্গোৎসব হলেও অন্য পরিবারের লোকও জড়ো হতো। কালিপূজাও হতো জাঁকজমকের সঙ্গে। দুর্গাপূজার দিন মানে তো মহালয়া। রোদের রং বদলে যেতে দেখে বুঝতাম উৎসবের দিন আসছে। সে অঞ্চলে সবুজ এমনিতে কম। এখানকার মতো ল্যাপ্টানো সবুজ ছিল না। এখানে-ওখানে ছোপ ছোপ সবুজ। বিবর্ণ ধুলোর রঙের মধ্যে কিছু গাছপালায় জড়ানো সবুজ। সব শুকনো। তাই পূর্ববঙ্গে এসে আদিগন্ত সবুজ দেখে আমার মনে হয়, আমার কি তবে নতুন জন্ম হলো? এত স্নিগ্ধ কোমল সবুজ এখানে! সেখানে কি তবে সবুজ ছিল না? তখন আমার আশ্বিনের কথা মনে পড়ে, শরতের আবির্ভাবের কথা মনে জাগে। বিদেশের শরৎ মানে পাতাঝরা, প্রকৃতির বুজে আসা, মন শুকিয়ে আসা। কিন্তু এখানে শরৎ মানে সবুজের বিজয়। পাতা ঝরলেও সঙ্গে সঙ্গে নতুন পাতা গজাচ্ছে। বর্ষার মেদুর আবহাওয়া চলে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট ধপধপে সাদা হয়ে উঠছে। মহাভারত-এ দেখছি শরৎ রাজাদের মৃগয়া ও যুদ্ধের সময়। তখন ধুলো কম, বাতাস পরিষ্কার। আমাদের শরৎ দুর্গাপূজার সঙ্গী।
সে সময় বাড়িতে শাসনের বন্ধন আলগা হয়ে যেত। সারা দিন লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো টো টো করে বেড়াচ্ছি। দিঘিতে নামছি, ঝোপজঙ্গল থেকে এটা-ওটা ফল পেড়ে খাচ্ছি। আর পূজামণ্ডপের সামনে গিয়ে খাড়াচ্ছি। মহালয়ার ভোরে গ্রাম জেগে যেত ভোররাতে। রেডিওতে বীরকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনার কথা বললে এখন নাটকীয় লাগবে। কিন্তু শুনতাম। এ বাড়ি ও বাড়ির দহলিজে বা বৈঠকখানার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। মাসি বা কাকিমারা নারকেলের নাড়ু হাতে তুলে দিচ্ছে, তা খেয়ে আবার আরেক বাড়ি যাচ্ছি। সামনে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছোট মাঠ। সবুজ ঘাসে ঢাকা সেই মাঠের ওপর তারার মতো শিউলি পড়ে আছে। পাশে গত বছরের খড়ের পালা থেকে স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ আসছে। এদিকে বাতাবি লেবুর গাছে লেবু ধরে আছে। সে অতি দুর্লভ গাছ সে অঞ্চলে। ওটা দিয়ে আবার ফুটবলও খেলা চলত। এই পরিবেশে ঠাকুর তৈরির প্রথম স্তরের কাজ শেষ। সিংহের মুখটা বোঝা যাচ্ছে। খড় আর বাঁশের বাতায় দুর্গা-ঠাকুরের আদল ফুটে উঠেছে। তার পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ প্রভৃতি। মা তাঁর পরিবার, ছেলেপুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা পূজার শাস্ত্রীয় দিকগুলো জানতাম না, আগ্রহও হতো না। তখনো যেমন এখনো তেমনি-সামাজিকতা, ধর্মভাব ইত্যাদির ভেতর থেকে আনন্দটুকু, সৌন্দর্যটুকু ছেঁকে নিই। উৎসবে আনন্দিত হওয়ার জন্য খুব বেশি ধর্মভাবাচ্ছন্ন হওয়ার দরকার পড়ত না।
মহালয়ার দিনে অনেক দূরের গ্রাম থেকেও ঢাকের শব্দ থেকে থেকে শোনা যেত, যেন দূরাগত মেঘের গর্জন। আর সে রকম শব্দে পুরো গ্রামটাই যেন জেগে উঠত। জীবনের জন্য আগের দিনগুলোয় তারা অকথ্য খাটুনি পার করেছে। বর্ষার দুর্ভোগ শেষে কৃষকেরা এখন কর্মকান্তি থেকে মাথা তুলছে। মাঠে ধানের সবুজ সমুদ্র তৈরি হয়েছে মাত্র। চাষিরা সেই সমুদ্রের মধ্যে হাঁটু গেড়ে তলার ঘাস-আগাছা নিড়িয়ে একটু স্বস্তিতে বসেছে। এখন তারা নিজেদের দিকেও তাকানোর ফুরসত পাচ্ছে। সবার ঘাড়ে একটা করে গামছা। পরনে ক্ষারে কাচা ধুতি। খাটুনি-সংগ্রাম না করলে জীবন টেকে না। তারপরে এইটুকু আনন্দের জন্যই তো জীবন। এই অবসরে গ্রাম উৎসবের জন্য তৈরি হয়। তখন গ্রামের যারা শহরে চলে গিয়েছিল, যারা একটু ভালো থাকে, তারাও ফিরে এসেছে। তাদের গায়ের রং তুলনায় ফরসা। গ্রামের সব লোক তাদের খাতির করছে। এ রকম সময়ে উৎসবের আমেজ ছোঁয়াচে রোগের মতো আমাদের মতো মুসলমান ছেলেদেরও জাগিয়ে তুলত।
এই তো- পঞ্চমী, মহাসপ্তমী, অষ্টমী ও বিজয়ায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাড়ু খাওয়া। তারপরে মণ্ডপে গিয়ে দেখতাম দুর্গা-ঠাকুর পুরো ফুটে উঠেছেন। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো। সরস্বতীর রং সাদা, গায়ের শাড়ি সাদা। তাঁর রাজহাঁসের লীলায়িত গ্রীবার ভঙ্গি এখনো চোখে ভাসে। তখন ঠাকুরের আদল এখনকার মতো বিচিত্র ছিল না। প্রতিমা গড়ার আদল ছিল একটা ছকে বাঁধা। দুর্গার আকর্ণ বিস্তৃত চক্ষু, কপালে তিনটা নয়ন। অসুরের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে মহিষের মুণ্ডুটা পড়ে আছে। যখন দুর্গার কপালে চক্ষুদান করা হতো, অক্ষিগোলকের কৃষ্ণমণিটা বসানো হতো, তখন অদ্ভুত সুন্দর একটা অনুভূতি হতো। বড়দের ভক্তি দেখতেও ভালো লাগত। চামর দোলানো, ঘণ্টাধ্বনি করা, উলু দেওয়া। সম্মিলিত মানুষের আচরণ আমাদেরও প্রভাবিত করত।
এসবের মধ্যে সেই শরতের রোদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসাময় হিংসাহীন মন জেগে উঠত। সেই মানুষদের কাউকে কাকি ডাকতাম, কাউকে কর্তা ডাকতাম। সবার আদরে মনে হতো, এই পরিবেশটাই মানুষের জন্য কাঙ্ক্ষণীয়।
হাসান আজিজুল হক: কথাসাহিত্যিক
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১০:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




