ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে আমার আগ্রহ অনেক দিনের । পথ চলতে মাঝে মাঝে রাস্তার বিলবোর্ডে অনেক ব্যাংকের 'ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক' পরিচালনার ঘোষনা আগ্রহের তীব্রতা বাড়িয়েছে । কিন্তু সময় করে ও গুছিয়ে এ বিষয়ে পড়াশুনা করার তাগিদ বা সুযোগ কোনোটাই হয়ে ওঠে নি । সম্প্রতি বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতায় নানাভাবে এই বিষয়টা উঠে আসায় কিছু পড়াশুনা করতে একরকম বাধ্যই হলাম । তারই বাইপ্রোডাক্ট এই লেখা । এখানে আমি মূলত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার ইতিহাস ও সাধারনভাবে ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে আমার বোঝাটা শেয়ার করতে চেয়েছি। ধারাবাহিকভাবে এরপর ইসলামী ব্যাংকের কর্মনীতি, আয়, তত্ত্ব ও প্রয়োগে সঙ্গতি ও অসঙ্গতি নিয়েও লেখার ইচ্ছে রইলো । গঠনমূলক যেকোনো সমালোচনা বা মতামত আমার বোঝাটাকে আরো শাণিত করবে ।
আল নাজ্জার-ইব্রাহিম-আনসারী লিখিত 'ইসলামী ব্যাংক কি ও কেন ?' পাঠ করে জানা যায়, ১৯৬৩ সালের আগে মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামী ব্যাংক গড়ে ওঠা বিষয়ে কোনো আন্দোলনই হয় নি এবং ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের পরেই বিশ্বে প্রথম ইসলামী ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে । প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে মুসলিম দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে স্ব স্ব দেশে অর্থনীতি ইসলামীকরনের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, দেশে দেশে ইসলামী ব্যাংক গঠন তারই ফলশ্রুতি । তাছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ কর্মসূচী "Sturactural Adjustment Programme" এর আওতায় বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশের সরকার উদারীকরণ নীতির মাধ্যমে প্রথম ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়া আরম্ভ করে । এ ক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা পালন করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা শামী'য়াল ডারভিশ, আব্বাস মীরাখন ও মহসীন খান ।
আমাদের দেশে ইসলামী উন্নয়ন সংস্থার অংশীদারিত্বে কয়েকজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনা হয় । দেশে বিদ্যমান কোম্পানী আইনের অধীনে বানিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে 'ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড' নামে প্রথম এ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় । ইসলামী ব্যাংকের অনুমোদিত মুলধন ১০০ কোটি টাকা যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন প্রায় ৬৪ কোটি টাকা । বানিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে বলে আইনগত অবস্থান বোঝার সুবিধার্থে বানিজ্যিক ব্যাংকের সংজ্ঞাটি খেয়ালে রাখা ভালো । "মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে ব্যাংক স্বল্পসুদে বা লাভে অর্থ আমানত গ্রহন ও অপেক্ষাকৃত বেশি সুদের বা লাভে বিভিন্ন খাতে ঋণ দান করে এবং তার কাছে উত্থাপিত চেকের মর্যাদা প্রদান, বিনিময় বিল বাট্টাকরন, বিভিন্ন প্রকার বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টিসহ নানাবিধ আর্থিক কার্যাদি সম্পন্ন করে তাকে বানিজ্যিক ব্যাংক বলে ।" এই সংজ্ঞার আওতায় এলে অন্যান্য বানিজ্যিক ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের পার্থক্য কোথায় ??
এখন ইসলামী ব্যাংক সৃষ্টির সময়কার বিশ্ব রাজনৈতিক অবস্থার দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক । সত্তরের দশকের সে সময়ে আরব-ইসরায়েল বৈরিতায় আরব দেশগুলো ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়লো, প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়লো, মিশর-ইসরায়েল দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া হয়ে গেল এবং তার ফলে বিশ্বের নানা জায়গায় মুসলিম মৌলবাদ একটি জঙ্গি ধারা হিসেবে দেখা দিতে শুরু করলো -এমনকি ইরান বা তুরস্কের মতো দেশেও , এমনই পরিস্থিতির সাথে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার একটি ভাবগত সাযুজ্য ও কালগত আপতন দেখা যায় । ব্যাপারটি কি নেহাতই কাকতাল ?? বিজ্ঞজন এ বিষয়ে ভালো আলোচনা করবেন ।
এছাড়াও কথা থাকে । ইসলামী চিন্তাবিদেরা বলে থাকেন, ইসলামী ব্যবস্থা কোনো সাময়িক বা যুগ বিশেষের ব্যাপার নয় ।সমস্ত দেশ ও কালের জন্যই তা প্রযোজ্য । " ইসলাম এক চিরন্তন ও শাশ্বত জীবন ব্যবস্হা বলিয়া উহার উপস্থাপিত রীতি-নীতি ও আদর্শ সমাজজীবন পুনর্গঠনের জন্য চিরকালীন মৌলিক ব্যবস্থা, তাহার কোনোটাই সাময়িক বা ক্ষণিক নহে। " [মওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহিম-ইসলামের অর্থনীতি, ১৯৯৪,পৃ -১৮] তাহলে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত পৃথিবীর দেশে দেশে যে অর্থ লেনদেন হলো, তার ইসলামিক কোনো ভিত্তি ছিল কিনা জানা দরকার । না থাকলে অর্থের কারবার সারা বিশ্বে তো বটেই এমনকি মুসলিম সমাজেও 'হারাম' পদ্ধতিতে ঘটেছে ।
আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডসহ অপরাপর ইসলামী ব্যাংকসমূহ দেশে প্রচলিত কোম্পানী আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে । ইসলামের নামে ধর্মপ্রাণ মানুষদের আমাণত জমার পরিমাণ বৃদ্ধি ও লভ্যাংশের মারপ্যাঁচে কম সুদে লাভের অংক ভারী হবার কারনে এখন ইসলাম ধর্মাবলম্বী নয় এমন মালিকদের পরিচালিত ব্যাংকসমূহও সাধারণ ব্যাংকিং এর পাশপাশি ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করেছে ।
বাংলাডেশে বর্তমানে সম্পূর্ণ ইসলামী ব্যাংক আছে ৮ টি :
১. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
২. আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক
৩. আইসিবি ইসলামী ব্যাংক (সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক)
৪. সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক
৫. এক্সিম ব্যাংক অব বাংলাদেশ
৬. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
৭. শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক
৮. ফয়সল ইসলামী ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংকিং এর শাখা আছে ৮ টি :
১. এবি ব্যাংক
২. সিটি ব্যাংক
৩. প্রাইম ব্যাংক
৪. সাউথ-ইস্ট ব্যাংক
৫. ঢাকা ব্যাংক
৬. প্রিমিয়ার ব্যাংক
৭. এইচএসবিসি
৮. আল-ফালাহ ইসলামী ব্যাংক
এছাড়া শাখায় সাধারণ ব্যাংকিং এর পাশপাশি ইসলামী ব্যাংকিং এর শাখা আছে তিনটির : ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেড । সাধারণ ব্যাংকিং এর তুলনায় অধিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকায় নতুনভাবে ইসলামী ব্যাংক স্থাপন ও চলমান সাধারন ব্যাংকসমূহের ইসলামীকরন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে ।