somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পয়লা মে : কী হতে যাচ্ছে নেপালে ?

৩০ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাঠমান্ডুকে দেখে মনে হয় না, শহরটা বড় এক সংঘাতের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা—সব চলছে। রাস্তায় ভিড়। কিন্তু দেশের বিরাট অঞ্চলে চলছে হরতাল। তরাই অঞ্চলে চলছে নৈরাজ্য। সরকারি মন্ত্রীরা যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই মাওবাদী বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। কোনো একক কর্তৃত্ব দেখা যাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত মাঠে অবস্থান জোরদার করায়। এই ২৮ এপ্রিল ছিল নেপালের সংবিধান প্রণয়নের শেষ তারিখ। কিন্তু সংবিধানসভায় দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। সরকারি জোটের দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারছে না, এমনকি নিজেদের মধ্যেও নেই ঐক্য। সরকারি জোটের অংশভুক্ত নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির ৭০ জন এমপি তাঁদের দলের প্রধানমন্ত্রীকে ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (মাওবাদী) হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বলেছেন। তাঁরা চান মাওবাদীদের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যের সরকার হোক। প্রধানমন্ত্রী সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা মাওবাদীদের সংগঠন ভেঙে দিতে এবং জোতদারদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমি ফিরিয়ে দিতে বলেছেন।

মাওবাদীদের চিন্তার মধ্যে সংসদীয় দেনদরবারের থেকে বড় হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের কাঠামো বদলের প্রশ্ন। সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ে সরকারকে আর সময় দিতে চাইছে না তারা। এখন তাদের লক্ষ্য, কর্মীদের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চূড়ান্ত লড়াইয়ের ডাক দেওয়া। আগামী ১ মে হলো সেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিন।

নেপাল এখন সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছে। সেদিন তারা কাঠমান্ডুতে স্বল্পতম রক্তপাতে সরকার উচ্ছেদ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এপ্রিল মাসজুড়ে বিপ্লবী ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, আদিবাসী, নারী এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সম্মেলন হয়েছে। সবাইকে একটাই বার্তা দেওয়া হচ্ছে: মাওবাদীরা আর জঙ্গলে ফিরে গেরিলাযুদ্ধ করবে না। তারা আর পিছু হটবে না। এবারের সংঘাত হবে রাজধানী আর শহরে শহরে এবং তারা জিতবে নয়তো মরবে।

নেপালে এখন দুটি ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। একদিকে ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), অন্যদিকে রাষ্ট্র। জনগণের মধ্যে মাওবাদীদের রয়েছে শক্ত ভিত্তি। তাদের ছাত্র-যুব সংগঠন সুশৃঙ্খল এবং তাদের গণমুক্তিফৌজ সাহসী। বিপরীতে রাজতন্ত্রনির্ভর, অসংগঠিত এবং সেনাবাহিনীর বন্দুকের জোরে টিকে থাকা সামন্ত-ধনীনির্ভর রাষ্ট্র জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মাওবাদীদের অভ্যুত্থানে রাজা জ্ঞানেন্দ্র সিংহাসনচ্যুত হলেও বিপুল ভূসম্পত্তি, তামাকের ব্যবসার একচেটিয়া এবং বিরাট ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য রয়েছে তাঁর। বড় বড় অবকাঠামো, জলবিদ্যুত্ প্রকল্পগুলো আছে বিদেশি মালিকানায়। কিন্তু মাওবাদীদের অনুমতি ছাড়া তারা সেগুলো চালাতে পারছে না। আধাসামন্তবাদী ও আধা ঔপনিবেশিক নেপাল এখন সংগঠিত শ্রমিক ও কৃষকের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

১৯৯০ সালে শহুরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজা বীরেন্দ্র সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হন। কিন্তু অচিরেই প্রমাণিত হয়, সেটা অভিজাতদের গণতন্ত্র। মাওবাদীরা এর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, গেরিলা বাহিনী বানায়। তাদের জনযুদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাদের প্রধান দাবি হলো নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান সভা আহ্বান করা। সমাজের সব শ্রেণী-পেশা-জাতির প্রতিনিধিদের নিয়ে এ ধরনের সভাকেই তারা নতুন নেপালের কর্মশালা বলে অভিহিত করতে চায়। রাজতন্ত্র উচ্ছেদের সংগ্রামে অন্য বুর্জোয়া দলগুলোর সঙ্গে তাদের সাময়িক সমঝোতাও হয়। অবশেষে, ২০০৬ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম হয়। শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী মাওবাদীরা অস্ত্র ত্যাগ করে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারাই আবির্ভূত হয় বৃহত্তম দল হিসেবে। তাদের প্রধান দাবি হলো ভূমিসংস্কার, বঞ্চিতদের ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘুদের স্বায়ত্তশাসন এবং নেপালকে ভারতের খপ্পর থেকে বের করে আনা। ক্ষমতাসীন হয়ে সড়ক ও অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে তারা বড় বড় কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু নেপালের সেনাবাহিনী বেসামরিক সরকারের কর্তৃত্ব মানতে রাজি না হওয়ায় এবং বাকি দলগুলোর জোটবদ্ধ ষড়যন্ত্রে প্রচণ্ডের প্রধানমন্ত্রিত্বে মাওবাদীদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদত্যাগ করে।

আবার তারা গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়। তাহলেও নেপালে অনেকেই মাওবাদীদের এই উত্থানে সুখী নয়। সবচেয়ে অসুখী সাবেক রাজকীয় সেনাবাহিনী। রাজতন্ত্র না থাকলেও এই সেনাবাহিনী আগের নিয়মেই উচ্চবর্ণের লোক দ্বারা চালিত হচ্ছে। মার্কিন ও ভারতীয়রা হলো এই সেনাবাহিনীর উপদেষ্টা। সারা দেশেই রয়েছে সেনানিবাস। তবে এখন তারা কাঠমান্ডুর নিরাপত্তার দিকেই বেশি মনোযোগী। অন্যদিকে মাওবাদী সাবেক গেরিলারা শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের শিবিরের ভেতর রয়েছে। কিন্তু সেখানেও তারা চালিয়ে যাচ্ছে বন্দুকের বদলে বাঁশের লাঠি হাতে প্রশিক্ষণ।

এ অবস্থায় ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। একদিকে জনসমর্থিত সত্যিকার শক্তি, অন্যদিকে সত্যিকার দাঁত-নখওয়ালা কাগজের বাঘ। গত দুই বছর জনগণ বিভিন্ন দলগুলোর আসল চরিত্র দেখেছে। এই অভিজ্ঞতা মাওবাদীদের জনপ্রিয়তাও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আর তারা অপেক্ষা করতে নারাজ। গত কয়েক মাসে লাখ লাখ মাওবাদী-সমর্থক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মিছিল করে এসেছে। মাওবাদীদের কাছে এসবই ছিল চূড়ান্ত বিপ্লবের মহড়া। তারা এখন দ্বিমুখী কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে। একদিকে গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এলাকা প্রতিষ্ঠা করে সেসব অঞ্চলের সামাজিক রূপান্তর ঘটিয়ে জনগণকে কাছে টানছে, অন্যদিকে শহরাঞ্চলে গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাওবাদী গণমুক্তিফৌজের উপ-প্রধান প্রভাকর বলেছেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশনে যাব না। জনগণই এই সরকারের ভাগ্য ঠিক করে দেবে।’ অন্যদিকে শান্তিচুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ৯৬ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনী নতুন সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে। মাওবাদীরা একে বলছে গৃহযুদ্ধের ষড়যন্ত্র।

বিষ্ণু পুকর নামের এক মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গেলে জনগণ তা মানবে না। অনেক মানুষ মারা গেছে, আর নয়। এবার ঘটবে সর্বাত্মক বিদ্রোহ। সবকিছু এখন নির্ভর করছে মাওবাদীদের ডাকে নেপালের জনগণ কতটা সাড়া দেয়, তার ওপর। তার জন্য আমাদের ১ মে দিবস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

[কাউন্টারকারেন্টস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর।
জেড ব্র্যান্ডট : ব্লগার। লেখাটি গত ২৮ তারিখ প্রথম আলোতে প্রকাশিত]
জেড ব্র্যান্ডটের ব্লগে গেলে মূল লেখাটি পাওয়া যাবে
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১২:৪৮
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×