(মারিও ভার্গাস য়োসা , ২০১০ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, ক্রিষ্টিয়ান সাইন্স মনিটর ১৯৭৭ সালে তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছিল। লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের রাজনীতি ও সাহিত্য বিষয়ে বলেছিলেন ইয়োসা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সমালোচনা করেছিলেন , ফিদেল ক্যস্ট্রোর কিউবান বিপ্লবকে চিহ্নিত করেছেন “ একটি মহান প্রবঞ্চনা ” হিসাবে, এবং বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে যারা আছেন তাদের চেয়ে লাতিন আমেরিকান লেখকদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বেশী দায়বদ্ধ হতে হবে ।)
সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছেন : রিচার্ড এল ফ্রিকার
এপ্রিল ২২, ১৯৭৭ - পেরুভিয়ান লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা মনে করেন লাতিন আমেরিকায় মানবাধিকারের বিনিময়ে একনায়কতন্ত্র ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোকে সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র মারাত্মক ভুল করছে। তিনি আরো অনুভব করেন যে এই অঞ্চলে সহিংস পরিবর্তনের যুগের আবসান হয়েছে এবং ফিদেল কাষ্ট্রোর বিপ্লব ছিল “এক মহা প্রবঞ্চনা”।
জনাব ভার্গাস ইয়োসা নিজের এবং এই অঞ্চলের অনান্য সরকারগুলোর কড়া সমালোচক হিসাবে সমধিক পরিচিত। লাতিন আমেরিকান লেখককুলের প্রবীণতম সদস্য হিসাবে হিস্পানিক সাহিত্যের প্রায় সব প্রধান পুরস্কার তিনি সঞ্চয় করেছেন এবং এই দেশে ব্যপকভাবে বক্তব্য রেখেছেন।
লাতিন আমেরিকান লেখকদের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে জনাব ভার্গাস য়োসা বলেন , যে সাধারণভাবে তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের তুলনায় লাতিন লেখকরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশী দায়বদ্ধ। “ লাতিন আমেরিকায় সাহিত্য একই সাথে শৈল্পিক সৃষ্টি এবং সামাজিক অবিচার প্রকাশ এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার হাতিয়ার” বলে তিনি উল্লেখ করেন।
“ স্বৈরতন্ত্র, নিষেধাজ্ঞা এবং দমননীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং সংবাদপত্র যা করতে পারেনি সাহিত্য তাই করেছে এবং করছে। সুতরাং সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সবসময় সাহিত্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং আছে।”
তিনি অনুভব করেন যে স্বৈরতন্ত্রের অধীনে বসবাসকারী লেখকদের অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের সপক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং নিজ নিজ দেশের জনগণের অবস্থার উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
“ আমি মনে করি আপনি যদি একজন শিল্পী বা লেখক হতে চান, তাহলে আপনার এমন একটি সমাজ প্রয়োজন হবে যেখানে সংস্কৃতি মানেই বিশেষ কিছু এবং যেখানে জনগণের অংশগ্রহন থাকবে। এটা নিকারাগুয়া এবং গুয়েতেমালার মতো দেশে সম্ভবপর হবে না যেগুলো আদিম এবং বর্বর স্বৈরশাসকদের দ্বারা শাসিত।”
জনাব ভার্গাস য়োসা সহানুভুতির সাথে সমাজে সন্ত্রাসের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন সামাজিক অবিচারের দ্বারাই সন্ত্রাসের উদ্ভব ঘটে কারণ “ সেখানে, তৃতীয় বিশ্বে অসংখ্য অন্যায্যতা আছে এবং এইসব সামাজিক, অর্থনৈতিক , এবং সাংস্কৃতিক অসাম্য মারাত্মক সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।”
স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোকে কমিউনিজমরে হাত থেকে রক্ষা করার নামে সমর্থন করার অভ্যাস বিষয়ে, তিনি বলেন “চরম মূঢ়তা”, তিনি আরো বলেন “ কমিউনিজমের প্রসার ঘটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করা”। “ তিনি জোরালোভাবে বলেন লাতিন আমেরিকা জুড়ে একনায়করা নিজেদেরকে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ক্রুসেডার হিসাবে উপস্থাপন করে” এবং এইসব একনায়কদেরকে যেহেতু তাদের জনগণ ঘৃণা করে সেহেতু তারা সহজাতভাবে অনুভব করে যে তাদের শত্রুর শত্রু হলো তাদের বন্ধু। তিনি মনে করেন, অতীতে , একনায়কদের সাথে বন্ধুত্ব লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক ছিল। “ যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ধরনের নীতির অনুসরণ অব্যাহত রাখে, তাহলে লাতিন আমেরিকার সাথে তার ভবিষ্যত সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হবে” বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জনাব ভার্গাস য়োসার মতে লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্র হলো সবচেয়ে দুর্লভ বস্তু। তিনি উল্লেখ করেন প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো ভেনিজুয়েলা এবং কোষ্টারিকা, মেক্সিকো এবং কলম্বিয়ার ক্ষেত্রে বলেন একনায়কতান্ত্রিক শাসন সত্বেও সেখানে কিছু ব্যাক্তি স্বাধীনতা বিদ্যমান। ” বাকী সবগুলো দেশেই নানা রূপে স্বৈরতন্ত্র বিদ্যমান”।
তিনি অনুভব করেন সহিংস বিপ্লবের যুগ লাতিন আমেরিকা পেরিয়ে এসেছে। “আমার মনে হয় বেশীরভাগ মানুষই এ ধরণের সমাধানকে সন্দেহের চোখে দেখে”। তিনি বলেন অনেক লোক বিশ্বাস করে লাতিন আমেরিকার নির্দিষ্ট কিছু একনায়ক এই অঞ্চলের সহিংস পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট। “ কি ঘটছে চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং উরুগুয়েতে, কোন না কোনভাবে তা সহিংস বিপ্লব সম্পর্কে এই বিশ্বাসেরই ফলাফল” বলে তিনি মনে করেন।
জনাব ভার্গাস য়োসা বিশ্বাস করেন দক্ষিণ আমেরিকা যেসকল সমস্যা মোকাবেলা করছে তার অধিকাংশই শুধুমাত্র পারস্পরিক সংহতির ভিতর দিয়েই সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, শুধুমাত্র অন্যান্য দেশগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে কিউবা তার জাতীয় পরিচয় পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং সোভিয়েত আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে পারে।
আরো আনেক লাতিন আমেরিকান শিল্পী সাহিত্যিকদের মতো ষাটের দশকের কিউবান নিরীক্ষা জনাব ভার্গাস য়োসার নিকটও ছিল হাতাশার অধিক। “এটা (কিউবা) ছিল খুবই বড় প্রবঞ্চনা, মোহমুক্তি , আমি সহ আরো অনেক লোকের জন্য” বলে তিনি স্বীকার করেন।“ আমি বিশ্বাস করেছিলাম শুরুতে কিউবান বিপ্লব যেটা কিউবা নির্মাণ করতে চেয়েছিল যা ছিল একেবারে বিশেষ ধরণের সমাজতন্ত্রের মডেল, এমন একটি বিপ্লব যা স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারকে সম্মান করবে।”
তিনি বলেন এখন এটা জানা খুবই দুরূহ যে সতিকার অর্থে কিউবার স্বাধীন কোন পছন্দ ছিল কিনা নাকি তারা পরিস্থিতি তাদেরকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে - উদাহরণ স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের কারণে - সোভিয়েত পথ বেছে নিতে হয়েছে। “ সত্য হলো এই যে তারা এই পথ বেছে নিয়েছিল এবং সম্পূর্ণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনস্ত হয়ে পড়েছিল”।
জনাব ভার্গাস য়োসার বিশ্বাস কিউবার “অধস্তনতার” কারণে লাতিন আমেরিকান সংস্কারকদের কাছে সোভিয়েত দর্শন আর আকর্ষণীয় থাকেনি। তিনি আরো যোগ করেন ,তার মানে এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হিসাবে লাতিন আমেরিকার সামনে প্রতিভাত হয়েছে।“ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমস্যাগুলো ভিন্নতর। লাতিন আমেরিকার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল কারণ যেসকল বহুজাতিক কোম্পানী এবং কর্পোরেশন আছে তারা আনেক ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকাকে শোষণ করেছে।এটা যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত খারাপ একটা ভাবমূর্তি তৈরী করেছে , কারণ আমরা জানি যে যুক্তরাষ্ট্র মানে কেবল কর্পোরেশন নয়। য়ুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভালো জিনিস আছে , কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠির মাঝে এই খারাপ ভাবমূর্তিই এখনো বিরাজমান।”
জনাব ভার্গাস য়োসা বিশ্বাস করেন লাতিন আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য অন্যদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ অনুকরণ করা উচিত নয়। “ আমি অনুভব করি যে সকল ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে তাদের ব্যর্থতার কারণ তারা তাদের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে ”। তিনি মনে করেন অনুন্নয়নশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য লাতিন আমেরিকাকে তার নিজস্ব মডেল তৈরী করতে হবে ।“ আমরা বিদেশী অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করবো , তবে আমাদেরকে অবশ্যই খুবই স্বতন্ত্র এবং সৃজনশীলভাবে সেটাকে সংগঠিত করতে হবে। আমি মনে করি এাঁটই একমাত্র সমাধান।”
এমনকি অহিংস , আংশিক গণতান্ত্রিক পথেও যদি উন্নয়ন ঘটেও , জনাব ভার্গাস য়োসা বিশ্বাস করেন তারপরও লেখকদের দায়িত্ব থেকে যায় এই ব্যবস্থায় কোন গলদ আছে কিনা তা খুঁজে বের করার।
“ আমি মনে করি সাহিত্য হলো সবচেয়ে অননুবর্তী প্রতিষ্ঠান। আমি মনে করি না সাহিত্য কখনো সুখের বিবৃতি হিসাবে বিদ্যমান ছিল। আমি মনে করি সাহিত্য সবসময়ই অসুখের বিবৃতি। আমি মনে করি আপনি লিখেন কারণ আপনার সমস্যা আছে।”