
(দ্বিতীয় পর্ব)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
অদ্য তারিখে হয়তো আর কোন কেস ছিল না তাই এই একটি কেসের রায় লিখেই হাকিম সাহেব এজলাস থেকে নেমে গেলেন। হাকিম সাহেব চলে যাওয়ার পর এজলাস ভরা লোকজন দেখে ভরকে গেলাম। এজলাসে উপস্থিত অফিসের লোকজন অনেকেই এই কাজের জন্য অশিত বাবুকে উৎসাহ দিতে লাগলেন, কেউ কেউ মিষ্টি দাবী করে বসলেন। ভেবেছিলাম চুপে চুপে কাজ সেরে অশিত বাবুকে নিয়ে মানে মানে কেটে পড়বো। সেটা আর হলো না। তাদের আনন্দ উল্লাস আর দাবীর মুখে আটকে গেলাম। অবস্থাটা এমন হলো যার বিয়ে তার আনন্দ না থাকলেও পাড়াপড়শিদের আনন্দে ঘুম নেই। বাধ্য হয়ে উপস্থিত লোকজনকে অপেক্ষা করতে বলে আশে পাশে কোথায় মিস্টি পাওয়া যায় সেদিকে দৌড়াতে লাগলাম। কাছেই ফকিরাপুল বাজার। ফকিরাপুল বাজারের দিকেই দ্রুত রওনা হলাম। তবে ফকিরাপুল বাজারে যেতে হলো না, বাজারে যাওয়ার আগেই সামনে যে মিস্টির দোকান পেলাম সেখান থেকেই নিজের পকেটে যা ছিল তাই দিয়েই কয়েক কেজি মিষ্টি এনে পুরো অফিসে বিতরণ করে দিলাম। এতে আমার পকেট ফাঁকা হলেও এমন একটি কাজে সহযোগিতা করতে পেরে নিজের কাছে খুব আনন্দই লাগল।
কোর্ট থেকে বের হয়ে বর কনেকে রিক্সায় তুলে বিদায় করে দিয়ে আমরা তিনজন অফিসে চলে গেলাম। বর কনেকে এক রিক্সায় পাঠালেও কিছুদূর গিয়ে দুইজন দুই দিকে গেলেন। কনে গেলেন ইউনিভার্সিটির হলে আর বর গেলেন ভাইয়ের বাসায় যেখানে তিনি থাকেন।
কোর্টের কাজ হলেও কাজীর কাজটি বাকি থাকল। বিয়ে পড়ানোর জন্য কাজীর দায়িত্ব কোর্টে থাকা অবস্থায় আমাদের একজন উপযাচক হয়ে নিয়ে নিলেন। সে যেচে দায়িত্ব নেয়ায় খুব খুশিই হলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সে আর এই দায়িত্ব পালন করলেন না।
প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেলেও অমিত রায়হানের আর বিয়ে হয় না। মেয়ের বাপের ভয়ে দায়িত্ব নেয়া ব্যাক্তিটি পিছুটান দিয়েছে। এখন তার বিয়ে পড়ানোর দায়িত্ব কেউ নেয় না। মেয়ের বাপ ঘোড়াশাল সার কারখানার বড় কর্মকর্তা, যদি ক্ষেপে গিয়ে বরসহ বিয়ের সহযোগিতাকারীদের জেলেটেলে ঢুকিয়ে দেয়, এই ভয়ে সবাই পিছিয়ে যাওয়ায় অশিত বাবু কোর্টের অনুমতি পাওয়ার পরও বিয়ে নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেলেন। কথাটি কাউকে বলতেও পারছেন না আবার চুপ করে বসেও থাকতে পারছেন না। অগত্যা একদিন আমাকেই অফিসে ধরে বসলেন। একা একা চেয়ারে বসে আছি। টেবিলের আশেপাশে কেউ নেই। এমন সময় অশিত বাবু আমাকে ফাঁকা পেয়ে আমার টেবিলের সামনে এসে অসহায়ের মত একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি টেবিলের সামনের চেয়ারে বসতে বলায় চেয়ারে বসেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, প্রামানিক ভাই, আপনারা আমাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখলেন কেন?
আমি তার কথাটি বুঝতে না পেরে কিছুটা আশ্চার্য হয়েই পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম, আমি ঝুলিয়ে রাখলাম মানে!
অশিত বাবু কিছুটা অসহায় ভাবেই বললেন, ঝুলিয়েই রাখলেন তো, আপনারা কোর্টে বিয়ের স্বাক্ষী হলেন, আপনাদের সহযোগিতায় হিন্দু থেকে মুসলমান হলাম, এখন আমার বাকি কাজটা কেউ করতেছেন না।
তার কথা শুনে বললাম, কেন, বিয়ে পড়ানোর দায়িত্ব তো একজন উপযাচক হয়েই নিল, সে কি বলে?
দায়িত্ব নেয়া ব্যাক্তির নাম শুনে অশিত বাবু অশাহতের মতই ভাব করে বললেন, সে পিছুটান দিয়েছে, সে এই দায়িত্ব পালন করতে অপারগতা জানিয়েছে।
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, তাহলে উপায়?
অশিত বাবু হতাশ ভাবেই বললেন, আমি এখন পুরোপুরি মাইনকা চিপায় পড়ে আছি, না মুসলমান হতে পারছি না হিন্দু ধর্মে ফিরে যেতে পারছি। কোর্টে ধর্মান্তর হওয়ার কারণে আমি এখন এদিকেও যেতে পারছি না ওদিকেও যেতে পারছি না। আমার এই অসহায় অবস্থায় আমি অকুলে হাবুডুবু খাচ্ছি। এই অবস্থায় এখ আপনারা ছাড়া আর কাউকে দেখতেছি না, আপনারা যদি আমাকে সহযোগিতা করেন তবে এই সমস্যার সমাধান হবে আর যদি না করেন তাহলে আমাকে আজীবন এভাবেই ঝুলে থাকতে হবে।
তার কথাগুলো আমার হৃদয়ে খুব নাড়া দিল, দায়িত্ব নেয়া ব্যাক্তি পিছুটান দিয়েছে এটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না, আশ্চার্য হয়েই বললাম, বলেন কি! সে তো নিজের থেকেই উপযাচক হয়ে দায়িত্ব নিল, এখন আবার পিছুটান দিচ্ছে কেন?
অশিত বাবু মুখটি কালো করে বললেন, কেন পিছুটান দিল সে কথাও তিনি খুলে বলছেন না।
তার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যাওয়ার কথা শুনে খুব খারাপ লাগল। একটা লোককে গাছের আগায় তুলে এভাবে মই সরিয়ে নেয়াটা উচিৎ মনে হলো না। অশিত বাবুকে সাহস দেয়ার জন্য বললাম, সে যদি দায়িত্ব পালন না করে তাহলে ব্যবস্থা একটা অবশ্যই করতে হবে। তবে এই মুহুর্তে আমি কিছু বলতে পারছি না, দু’দিন চিন্তা করে নেই, তারপর আপনাকে জানাবো।
অফিস থেকে বিকালে বাসায় গিয়ে অশিত বাবুর বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। বিয়ের দায়িত্ব না হয় পালন করলাম কিন্তু বিয়ের পরে মেয়ের বাবার রোষানলের ঝামেলা সামলাবো কি করে সেই চিন্তায় পেয়ে বসল। যদি নারী শিশু আইনে কেস করে বসে তবে নির্ঘাত জেলের ভাত খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। জেলের কথা মনে হতেই মুখ শুকিয়ে গেল। আমার মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখে গিন্নি বলল, কি হয়েছে?
কোর্ট ম্যারেজের কথাটি তাকে আগেই বলেছিলাম কিন্তু কাজির কাজটি আটকে আছে এটা আমিও জানতাম না, যে কারণে গিন্নীকেও বলা হয় নাই। অশিত বাবুর বিয়ের বিষয়টি কিভাবে সমাধা করা যায় সেই বিষয়ের কথা গিন্নীকে জানাতেই গিন্নী অতি উৎসাহী হয়ে বিপদ-আপদের কথা না ভেবেই খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, একজন হিন্দু মুসলমান হচ্ছে তাকে তো সহযোগিতা করা দরকার। তাকে সহযোগিতা করতে পারলে এর ছোয়াবের ভাগিদার আমরাও তো হবো, এটা নিয়ে আবার ভাবাভাবির কি আছে।
আমি বললাম, সহযোগিতা যে করবো যদি কোন সমস্যা হয় তখন সামালাবো কি করে? তাছড়া বাড়িটা তো আমাদের নয় ভাড়া বাড়ি, বাড়িওয়ালা যদি রাজী না থাকে তাহলে এখানে বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়ে যাবো।
এই বিয়েতে যে আইনগত বিপদ আপদ হতে পারে এমন কথা তার কানেই গেল না। একজন হিন্দু আমাদের সহযোগিতায় কালেমা পড়ে মুসলমান হবে এটা যেন আমার গিন্নির কাছে বিরাট ছোয়াবের কাজ মনে হলো। এই ছোয়াব অর্জনের জন্য সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। অতি উৎসাহী হয়ে নিজেই বাড়িওয়ালীকে ডেকে আনল। বাড়িওয়ালীও মহিলা মানুষ, আমার গিন্নির মতই বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তিনিও কোন চিন্তা ভাবনা না করেই প্রস্তাবটি দিতেই লুফে নিলেন। হিন্দু থেকে মুসলমান হবে এমন বিয়ের সহযোগিতা করা মানে বেহেস্তের বারান্দায় পৌছে যাওয়ার মত ছোয়াব মনে করতে লাগলেন, এমন চিন্তা থেকে তিনিও বললেন, বাবা, এসব নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না, আমি তোমার বন্ধুর বিয়ের অনুমতি দিলাম, আমার বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন করো। প্রয়োজনে আমার ড্রইং রুমেই তোমরা বিয়ে পড়াও, আমি বিয়ের জন্য রুম ছেড়ে দিলাম। যদি এই বিয়েতে আমার পক্ষ থেকে কিছু টাকা পয়সাও খরচ করতে হয় তাতেও আমার আপত্তি নাই। তোমরা বিয়ের সব ব্যবস্থা কর, আমার পক্ষ থেকে যত সহযোগিতা করা দরকার আমি করবো।
বাড়িওয়ালীর কথা শুনে আমার দুশ্চিন্তার মাথায় যেন শান্তির সুশীতল বাতাস বইতে লাগল। মনে মনে আশ্বাস্তবোধ করতে লাগলাম কিন্তু তারপরেও পুরোপুরি টেনশন মুক্ত হতে পারলাম না। বাড়ির ঝামেলা না হয় মিটল কিন্তু কাজীর ঝামেলা কে মিটাবে? কাজী নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এখন কাজী কোথায় পাই। এখনকার কাজীরা তো সোয়াবের চেয়ে টাকার ধান্দা বেশি করে থাকে। আর যদি শোনে হিন্দু ছেলের সাথে মুসলিম মেয়ের বিয়ে তাহলে তো কথাই নাই, দুই ঠ্যাং লম্বা করে মোটা অংকের টাকা দাবী করে বসবে। বতর্মান কাজীদের কাছে নও মুসলিমদের পক্ষে আর্থিক সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা পাওয়া খুব দুষ্কর।
কাজীদের সম্পর্কে কিছুটা ধারনা থাকায় এমন সন্দেহের উদয় হয়েছিল। তারপরেও চুপে চুপে বিয়ের কাজটি সমাধা করা যায় কিনা এব্যাপারে খুব চেষ্টা করতে লাগলাম। দুই তিন মসজিদের হুজুরের সাথে কথা বলেও সুবিধা করতে পারলাম না। তারা এমন ভাব দেখালো বিষয়টি খুব জটিল বিষয়, আইন কানুনের ঝামেলা আছে, এটা তারা অল্প টাকায় কোনভাবেই করতে পারবেন না। বিয়ের পিছনে যে অধিক টাকা খরচ করবো এমন আর্থিক সঙ্গতি যেমন অশিত বাবুরও নাই আমার হাতেও অতিরিক্ত কোন টাকা নাই, বিয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করার কারণে কারো সহযোগীতা নেব তাও পারতেছি না। তারপরেও চেষ্টা করে যাচ্ছি। দুইদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করে আশাহত হয়ে ঘরে বসেই উপায় খুঁজতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে পড়ল রাজার বাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা। উনি আমার একদিকে ক্লাসমেট অন্যদিকে খুবই ক্লোজ বন্ধু। একসাথেই দুইজন ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রী কলেছে বিএ ক্লাসে পড়েছি। তখন থেকেই তার সাথে আমার গলা ধরাধরি বন্ধুত্ব। যদিও একজন টুপি-দাড়িওয়ালা লম্বা যুব্বা পরিহিত মসজিদের পেশ ইমাম আর আমি হলাম দাড়ি টুপি ছাড়া টেডি ভদ্রলোক। লেবাসের বিস্তর ফারাক হওয়ার পরেও দুইজনের মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা। হুজুরের কথা মনে পড়তেই মনের ভিতরে একটু আশার আলো দেখা দিল। অন্য হুজুররা আমাকে আশাহত করলেও এই হুজুর অন্তত আমার প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখান করবে না। সেই আশা নিয়েই প্যান্ট সার্ট পরে তৎক্ষনাৎ বাসা থেকে বের হয়ে ছুটে গেলাম তার কাছে।
হজুরের সাথে দেখা করার জন্য সরাসরি রাজারবাগ মসজিদে গিয়ে হাজির হলাম। যোহরের নামায শেষে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। হুজুরের একটি অভ্যাস হলো সব মুসুল্লি নামায শেষে চলে গেলেও ফাঁকা মসজিদেই উনি নফল নামায পড়তেই থাকেন। তার নফল নামাযের এই অবস্থা আমি দীর্ঘ দিন থেকেই দেখে আসছি। অনেক অপেক্ষার পরে নামায শেষ করে ছালাম ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে কাছে চলে এলেন। পরস্পর কুশলাদি বিনিময় করে নিজেদের কথা শেষ করে অশীত বাবুর বিয়ে পড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরলাম। অশিত বাবু কিভাবে মুসলমান হলেন শুনতে চাওয়ায় কোর্ট ম্যারেজের পুরো ঘটনা খুলে বললাম। আমার মুখে মুসলমান হওয়ার পুরো বর্ননা শুনে উনি নমনীয় হয়ে একটা হাসি দিয়ে বললেন, আপনারা যখন এতদূর এগিয়েছেন তখন আমি আর আপনাদের থেকে দূরে থাকি কি করে। যান আপনাদের কাজে আমিও শরিক হতে রাজী।
আমি তখন হুজুরকে বললাম, বিয়ে পড়ানোর দায়িত্ব তো আপনি নিলেন কিন্তু কাজী পাবো কোথায়? আমার কথা শুনে তিনি বললেন কাজী নিয়ে চিন্তা করতে হবে না কাজীর দায়িত্বও আমি নিয়ে নিলাম। হুজুর এতো সহজে দুইটা দায়িত্ব পালন করবে এটা আমার চিন্তার মধ্যেই ছিল না। হুজুর দায়িত্ব নেয়ায় আমি যেন অনেকটা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে গেলাম। মনের ভিতর আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল, অনেকটা স্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম এবার হয়তো আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন তা না হলে এতো জটিল বিষয় এতো সহজে সমাধা হওয়ার কথা কল্পনাতেই ছিল না। অশিত বাবুর বিয়ের দায়িত্বটা হয়তো পালন করতে পারবো।
(চলবে---)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




