আমি ছোট বেলা থেকেই একজন পরজীবী মানুষ, আমার অনুপ্রেরণার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন হয়। যেমন ভালো কফি, ভালো সিগারেট, ভালো বই ইত্যাদি। ইদানিং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জীবন্ত অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হচ্ছে, কেউ ভালো একটা কাজ করলে তাকে আমি চিনি বা না চিনি আমি অনুপ্রাণিত হয়ে যাই। মানুষটিকে এবং তাঁর কাজটিকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলি।
মিডিয়ার এই রমরমা যুগে অনেক নায়ক নায়িকা আমরা পেয়েছি, যাদের দেখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। ব্যাপারটা কেমন হচ্ছে জানি না, কিন্তু মিনি সাইজের ঐশ্বারিয়া, শারুখ খান দেখতে দেখতে বুকের মধ্যে কেমন জানি আতঙ্ক হয়। আমি ছোট বেলায় গল্প শুনতাম চন্দ্র শেখর আজাদ, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, বঙ্গবন্ধু, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এনাদের, আদর্শের সিংহ ভাগ জুড়ে এনারাই আছেন। হয়তোবা ব্যাক ডেটেড চিন্তা ভাবনা, কিন্তু আমি মানুষটা বরাবরি একটু সেকেলে। আমার বন্ধুরা প্রায়ই মজা করে বলে আমি ১৮০০ শতাব্দীর মানুষ। কিন্তু যে কথাটা আমি প্রায়ই একা বসে ভাবি, আমার পরবর্তী প্রজন্মকে কার উদাহারন টেনে অনুপ্রাণিত করবো? এরা যেমন ইঞ্জিরি বলে ফট ফট করে এদের সামনে ১০০ বছরের পুরানো উদাহরণ টানলে দু একটা বিলেতি গালি খেতে হতে পারে। এই ভাবনা চিন্তার ডামাডোলে হঠাৎ বুঝতে পারলাম এমন মানুষ আমার চারপাশেই আছে কিন্তু এরা বড় প্রচারবিমুখ, নামীদামী মানুষেরা এঁদের নিয়ে মাথা ঘামান না, লেখার সময় পান না। আমার যেহেতু অফুরন্ত সময় তাই ভাবলাম এঁদের নিয়ে লিখে ফেললে আমার লাভ, কারণ এঁরা যখন বিখ্যাত হয়ে যাবে তখন হয়তো এঁদেরকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ নাও মিলতে পারে। আর আমার মত পরজীবী মানুষ যারা আছেন তাদেরও লাভ।
প্রথমেই যে দুজন মানুষের কথা বলবো তাঁরা হলেন অনন্যা এবং অ্যানি। এই দুজনকে চিনি বেশীদিন হয়নি, কিন্তু দুজনের স্পষ্টবাদিতা প্রথম দিনেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। এই দুজনেরই ভালো ভালো ক্যারিয়ার অপশন থাকা সত্ত্যেও ঢাকার বাইরে গিয়ে সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করছে, আজকে যখন সবাই রাজধানী মুখী তখন তখন এই ব্যাতিক্রম আমাকে মুগ্ধ করেছে। একদিনের কথা বলি এঁদের একজনকে এসএমএস করলাম অনেকদিন খোঁজ খবর নেয়া হয়নি তাই, এসএমএস পাঠিয়ে উত্তর আসলো না দেখে একটু লজ্জিত হলাম কারণ কাজের চাপে একটু রাতই হয়ে গিয়েছিলো। আমার লজ্জিত মন অবাক হতে সময় নিলো না কারণ উত্তর আসলো "ভাইয়া ভালো আছি পরে কথা বলবো একজন ইমারজেন্সি রুগী দেখছি"। আমি পরেরদিন কথা বলে বুঝলাম মফঃস্বল শহরে এই বাচ্চা মেয়েটা রাত ১টা ২টা পর্যন্ত রুগী দেখে। অন্য দিকে আরেকটি মেয়ে দিনরাত এক করে ছুটে বেরায় মানসিক ভাবে যাদের সাহায্য প্রয়োজন তাদের কাউন্সিলিং করে। সাভারে রানা প্লাজা থেকে শুরু করে মোবাইল এ বিভিন্ন অজানা অচেনা মানুষকে পরামর্শ দেয়।
এখন বলবো আরও তিন জনের কথা মাসুদ, মুনা এবং ফয়সাল। তিনজনই তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে এই তিনজন গড়ে তুলছে বাংলা টেক্সট টু স্পীচ সফটওয়্যার। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মানুষকে নিয়ে কাজ করার সংখ্যা আমাদের দেশে খুব কম, প্রযুক্তিবিদ তো আরও কম। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মানুষরা যাতে বিনামূল্যে বাংলা ভাষার বই শুনতে পারে তাই এঁরা তিনজন ভালো ভালো আরামের চাকরি ছেড়ে দিনরাত খেটে তৈরি করছে ওপেন সোর্স বাংলা টেক্সট টু স্পীচ সফটওয়্যার। রাত নেই দিন নেই নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে।
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে এঁদের দেখি অনুপ্রাণিত হই, পরজীবী মানুষের মত এঁদের স্বপ্ন কে নিজের ভেতর ধারণ করি, নিজের কাজের শক্তি খুঁজে পাই। আমার দুশ্চিন্তাও কেটে গেছে, আমার পরবর্তী প্রজন্ম কে বলবো এই তোরা দ্যাখ তোদের আন্টি, আঙ্কলদের। তোদের এঁদেরকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।
আমার স্বপ্ন বৃক্ষরা তোমাদের প্রতি আমার ভালোবাসা থাকলো, থাকবে আজীবন। এই দেশ যখন বার বার হতাশা উপহার পাচ্ছে, তোমরাই তখন নতুন উদাহারন তৈরি করছো, সাহায্য করছো আমার মত পরজীবী মানুষকে নতুন আশা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে। বড় দুঃখী, অভিমানী আমার এই মমতাময়ী 'মা', অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পাননি উনি সন্তানদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি তোমাদের এই প্রচেষ্টা তাঁর বুকে শান্তির মৃদু হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে।
সজিব স্যার, সামিরা জুবেরি হিমিকা আপনাদের ধন্যবাদ এই মানুষগুলোর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনারা অনেক বড় মাপের মানুষ আপনাদের নিয়ে লেখার যোগ্যতা এখনও হয়নি এখনো, কিন্তু লিখে ফেলবো একদিন ধুম করে হে হে হে অনুমুতি না নিয়ে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




