খুব কম স্মৃতি আছে তোমাকে ঘিরে, সেই স্মৃতিগুলোও ফিকে হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, তোমার চেহারাটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা আজও তরতাজা। মনে পড়ে তোমার এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুকে জামায়েত এ ইসলামী এর কর্মীরা যখন নৃশংস ভাবে হত্যা করলো তুমি একমাস স্তব্ধ হয়ে ছিলে। এই একমাস তোমাকে যখনি দেখতাম গম্ভীর মুখে পায়চারি করছো আর সিগারেট খাচ্ছ। একদিন স্কুল থেকে এসে শুনি তুমি নাকি আম্মুকে নিয়ে বেড়াতে গেছো, নানা নানু আমাকে তাই বুঝালো, জানো সারাটা রাত অভিমানে ঘুমাইনি। ২০ দিন পর আমরা তোমাকে দেখতে গেলাম হস্পিটাল এ!!! শুনলাম তোমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে আমাকে কেউ বলেনি কারণ আমি নাকি ছোট, অবুঝ, চির চেনা সেই দুষ্ট হাসি দিয়ে আমাকে বল্লা রাগ করেছ? আমার চোখ ভরা জল, বুক দিয়ে ঠেলে কি যেন উঠে আসছিলো, ৫ বছরের জীবনে সর্বপ্রথম তীব্র অভিমান আর কষ্টের সাথে পরিচয় হলো। তোমার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়লাম, কি উদ্ভূত আমার অভিমান এক নিমিষে হাওয়া।
৯০ এর নির্বাচন বিএনপি জয় লাভ করে আবদুর রহমান বিশ্বাসকে প্রেসিডেন্ট করলো, তীব্র রাগে তুমি থর থর করে কাঁপছিলে, আম্মু, আমি, ভাইয়া আমরা তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি। আম্মু তোমাকে বার বার বলছিলো হালিম তুমি এমন কোরো না ডক্টর তোমাকে উত্তেজিত হতে মানা করেছে। আমরা টের পাইনি তোমার মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছিল।
এরপর তোমাকে আর কোনদিন আমরা দেশ নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি, জাহানারা ইমাম এর ডাকে জনতার মঞ্চে গেলে আমাদের কিছু না বলে, পরিবারের সবার সাথে তোমার দূরত্ব তখন বেড়েই চললো, মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে বলতে কেন যুদ্ধ করলাম? আজও কেন ওই বদমাশদের বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হয়? ১২ বছরের কিশোর এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবে?
এর কিছু দিন পর এলো ৯৪ সালের ৬ই জুন রাত্রি, সারাটা দিন আগের মতই চুপচাপ তুমি, একটু বেশিই গম্ভীর, রাত্রিতে আমি খুব শব্দহীনভাবে ডাইনিং রুম এ প্রবেশ করি যাতে তোমার মৌনতায় ব্যাঘাত না ঘটে। ভেতরে ঢোকা মাত্রই তোমার সাথে ধাক্কা লাগার উপক্রম হয়। তুমি লুঙ্গি পরে ঘরের একটি চেয়ারে বসে আছো। হাতের সিগারেটটা তখনো জ্বলছে। ‘কেমন আছো বাবা?’- আমি বললাম। তুমি উত্তরে বললে ‘এই তো...’। ‘তুমি এখনো ঘুমুতে যাওনি কেন, বাবা?’ ‘খুব শীঘ্রই যাবো।’- বললে কিন্তু গেলে না।
এক ঘণ্টা পর বুকের ভেতর মোচড় দিলো দৌড়ে গেলাম কিন্তু তুমি আবারো আমাকে ফাকি দিয়ে চলে গেছো, ভাইয়া অন্যদের নিয়ে তোমাকে হস্পিটাল নিয়ে গেছে, কেনো যেনো মনে হলো তোমার সাথে আর দেখা হবে না। ভোর বেলা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে গেলো সবাই, কিন্তু তুমি তখন অন্য ভুবনে। কতগুলো বছর তোমাকে খুঁজেছি তোমাকে পাই নি। এবার পেলাম গণ জাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন আকাশ পানে বজ্র মুঠী ছুড়ে বলছিলাম “একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠ আরেকবার” দেখি তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে চির চেনা সেই দুষ্ট হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছো, বাবা আজ শাহবাগে আর কেউ যায় না, আমাদের নাস্তিক বলে হত্যা করার ফতোয়া জারি হয়েছে, আমার অফিস এ হামলা হয়েছে, তোমার বৌমাকে ( তুমি তো ওকে দেখইনি ) তুলে নেবার হুমকি দিয়েছে....... তাও আমি শাহবাগ যাই। কেনো জানো? আমি জানি যে দিন সবকয়টার রায় হবে তোমাকে আমি আবার এই শাহবাগেই খুঁজে পাবো। এখন কটা বাজে জানো? ঠিক ১০:৩০, তুমি ফাকি দিয়ে চলে গিয়েছিলে হস্পিটাল এ, এরপর গভীর রাতে অন্যভুবনে চলে গেছো। এরপর থেকে ৬ই জুন রাতে আমি আর ঘুমাতে পারি না। সবকয়টার রায় হোক আমি জানি এরপর থেকে ৬ই জুন রাত আমার আর নির্ঘুম কাটবে না, কারণ আমি জানি তখন তুমি আমার পাশেই থাকবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াবে। পাড়াবে না বলো?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




