এই শহরের এক নিশ্ছিদ্র দোতলা বাড়িতে আমার বসবাস।আমি ছাড়াও এখানে বসবাস করে আরো দুই প্রাণী। সুখ এবং দুঃখ।তারা আমার প্রতিবেশী। আমার ঘর একতলার উত্তর পশ্চিম কোণে।দক্ষিন-পশ্চিম কোণে দুঃখের ঘর আর উত্তর পূর্বে থাকে সুখ।প্রতিবেশী হিসেবে তাঁরা মোটেই ভাল নয়। সুখ-দুঃখ সারাদিন ঝগড়া করেই সময় কাটিয়ে দেই।মাঝখানে পড়ে থাকি আমি।মাঝে মাঝে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আমি ও তাদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করি।কিন্তু কোনমতেই তাদের পোষ মানাতে পারি না।তাঁরা নিজেদের স্থানে অটল।আমি ব্যার্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি। আমার কারোর বাসায় গিয়ে একটুখানি গল্প করার ফুরসত মেলে না।তবে মাঝে মাঝে সুখ দুঃখ আসে আমার বাসায়।।গল্প করি একসাথে।মাঝে মাঝে একই বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখি,কল্পনা আঁকি।কোন এক দিন গরম গরম সিঙারা আর ধোঁয়া উঠা চায়ের সাথে আমাদের মিলন তিথি বেশ জমে ওঠে।
দুঃখ কখনো কখনো আমার সাজানো ঘরে হানা দেয়।আমি প্রতিবেশী হিসেবে তাকে অপছন্দ করলেও সে ঠিকঠাক আমার ঘরে আসন পেতে বসে।তাকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে বলতে থাকে।সে কখন কার সাজানো স্বপ্নগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে,কার মাথার ছাদ কেড়েছে,কোন মায়ের মুখ থেকে সন্তানের জন্য গড়া হাসি তুলে নিয়েছে,প্রেমিকার জন্য নিয়ে যাওয়া প্রেমিকের হাতের ফুল বাসি করে দিয়েছে,আররো কত কি।কথাগুলো বলে দুঃখ ভয়ঙ্কর অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে।আমি ভয় পেয়েযাই।আমি তার ওই বিষাক্ত নীল হাসি দেখে নিজেকে তার থেকে আড়াল করি।নিঃশব্দ পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাই,দরজা খুলে দিই।দুঃখ বুঝতে পেরে সশব্দ পায়ে দুড়মুড়িয়ে বের হয়ে যায় আমার ঘর থেকে।আর বের হওয়ার সময় আমার চোখে তার চোখ থেকে বেড়িয়ে আসা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়।আমার চোখ জ্বালাপোড়া করে। আমি কিছু দেখতে পাই না।জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকি।তারপর সুখ এসে আমাকে টেনে তোলে।চোখে মুখে জলের ছিটে দেয়।আমি আবার দেখতে পাই।
সুখ ও মাঝে সাঝে তার নিজের গল্প করে আমার সাথে।আমি ই নাকি এই মহল্লার তার প্রিয় বন্ধু।সে গল্প করে।আমি তার গল্পে হারিয়ে যাই।এইতো সেদিন বলছিলো পাশের মহল্লার রেহানা বেগমের ছোট ছেলেটা লিউকোমিয়ায় ভুগছিল।ছেলেটি মড়ার মত বিছানায় পড়ে থাকে।সুখ যায় মাঝে মাঝে সেখানে।তাদেরকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়,নতুন করে পথ চলার স্বপ্ন দেখায়।সুখের কোন এক আত্মীয়ের মেয়ে কৈশোরেই কোন এক মানুষরূপী হায়েনার হাতে ধর্ষিত হয়।সেই মেয়ে এতো অল্প বয়সেই বেঁচে থাকার সব সদিচ্ছা হারিয়ে ফেলে।সুখের সেখানেও যাতায়াত আছে।ওই মেয়েকে কষ্ট ভোলায় সাহায্য করে।নতুন উদ্যমে পথ চলতে স্বপ্ন দেখায়,সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে টিকে থেকে কিভাবে মাথা উঁচু করে চলতে হয় সেই প্রেরণা যোগায়।সে আরো কত গল্প,কত কথকতা। আমি সুখের গল্প শুনে উচ্ছ্বসিত হই।হৃদয় মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য জেগে ওঠে।নতুন করে যুদ্ধ করার প্রেরণা পাই,বেঁচে থাকার স্বাদ জাগে,স্বপ্ন দেখার লোভ হয়।আমি স্বপ্নে মসগুল হয়ে যাই।সুখের মত স্বপ্নে,সুখস্বপ্নে।
যত কিছুই হোক সুখ দুঃখ আমার প্রতিবেশী। আমি তাদের ছাড়া বাঁচতে পারি না।দুঃখ যেমন আমাকে অতলে ফেলে রেখে চলে যায়,তেমনি সুখ আমাকে সেই অতল থেকে কিভাবে ধবধবে সাদা মুক্তো খুঁজে আনতে হয় সেই পথ চিনিয়ে দেয়।।র তাঁরা আমার জীবন ঘিরে আবর্তিত হয়,আমি তাদের। আমরা একে অপরকে ছাড়া কখনো বাঁচতে পারি না,পারছি না,বোধহয় পারবো ও না।হয়তো তাদের ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য অর্থহীন হয়ে যাবে।তাই সুখ দুঃখের হাত ধরেই আমি আমার গন্তব্যে নিঃশব্দে পৌঁছে যেতে চাই,ধরতে চাই অদেখা স্বপ্নগুলো,ছুঁতে চাই স্বপ্ন ঘিরে বেড়ে উঠা কঠোর বাস্তবতাটুকু।