সখিনার কথা জোৎস্নার মায়ের মনে ধরলো,কোন ভাবে তারা ঢাকায় আসার টাকা যোগাড় করে একদিন ঢাকাতে চলে আসলো সখিনার সাথে। কি বিরাট ঢাকা শহর কত গাড়ি, লাল নীল সব রঙ্গিন বাতি জ্বলে চারিদেকে জোৎস্না যতই দেখে ততোই অবাক হয়। তাদের কে সখিনা ১ দিন তার বাসায় রাখলো, পরেরদিন থেকে কাজের খোঁজ শুরু করে দিল জোৎস্নার মা। মা মেয়ে এক বাসায় কাজ করতে পারলে ভাল হতো কিন্তু মা মেয়ে এক বাসায় রাখবে এমন মানুষ ঢাকা শহরে আছে বলে মনে হয় না। যে বাসাতেই যায় বলে হয় মা কে রাখবে না হলে মেয়ে কে। অযথা আর কি করার মা নিজে এক বাসায় কাজে ঢুকে মেয়ের জন্য কাছেই আরেক বাসায় কাজ ঠিক করলো। সে বাসার সদস্য সংখ্যাও চার, দুই ছেলে মেয়ে আর সাহেব বিবিসাহেব। বাসার মেয়েটা জোৎস্নার থেকে কিছু ছোট ৮/৯ বছরের আর ছেলেটা একদম কোলের। সাহেব বিবিসাহেব খুবই ভাল মানুষ, এমন একটা বাসায় কাজ করতে দিয়ে মেয়েটাকে, মা যেন একটু শান্তিতে আছে। প্রায়ই মেয়ের সাথে দেখা করতে যায় মা, বেগম সাহেব কিছু বলে না, দেখা করতে দেয়। জোৎস্নারও ঐ বাসায় মন টিকে গেছিল, বেগম সাহেবের সাথে কাজে হাত লাগাতো আর বাকি সময় মেয়েটার সাথে খেলা করতো। গ্রামের মেয়ে জোৎস্না ঢাকা শহরে এসেও শাড়ি পরার অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। বেগমসাহেব নিজের মেয়ের পুরান কত জামা কাপড় দিল তাও সে পরে না, শাড়িই সারাক্ষণ গায়ে জড়িয়ে থাকে। নিজের চেয়ে লম্বা শাড়ি, হাঁটতে গেলে হোঁচট খায়, তারপরেও ছাড়ে না, তার মা বলেও ছাড়াতে পারেনি। তাই এখন আর কেউ মানা করে না।
বেগমসাহেব একদিন জোৎস্নাকে বললো রান্না ঘরে বাচ্চার ছোট ছোট জামা কাপড় গুলো মেলা আছে চুলার উপরে যা নিয়ে আয়। সেও তাড়াতাড়ি গেল নিয়ে আসার জন্য, কে জানতো ঐখানেই তার মরণ ফাঁদ পাতা ছিল। সে চুলা বন্ধ না করেই তার উপর থেকে কাপড় গুলো নামাতে লাগলো আর তার শাড়ির লম্বা আঁচলে আগুন ধরে গেল। জোৎস্না সেটা খেয়ালই করেনি। হঠাৎ করে গরম আঁচ টের পেয়ে দেখে আগুন, দৌড়ে সামনের উঠানে বের হয়ে চিৎকার করছে আর লাফাচ্ছে , বাতাসের সংস্পর্শে এসে আগুন তার পুরা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে ততোক্ষনে, তার পরনের কাপড়ে আগুন ধরে গেছে সে কাপড় খুলছেও না খালি লাফাচ্ছে। চিৎকার শুনে বের হয়ে এই দৃশ্য দেখে বেগমসাহেব কি করবে তাড়াতাড়ি বালতি করে পানি এনে গায়ে ছিটিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে আগুন নিভে গেল ঠিকই কিন্তু আগুনের তাপে তার সম্পূর্ন কচি শরীর ঝলসে গেছিল। সাথে সাথেই তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। বাসার মালিকরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। যা লাগে সব করা হয়েছিল কিন্তু বেচারী জোৎস্না ৩ দিনের অসহ্য যন্ত্রনায় কাতর হয়ে মারা গেল। গ্রাম থেকে জোৎস্না দুবেলা ভর পেট খাওয়ার স্বপ্নটুকু নিয়েই ঢাকায় এসেছিল ভাগ্য ফেরাতে, তার সে স্বপ্নও সেদিন তার সাথে বিদায় নিয়েছিল। জোৎস্না নামের এইসব মেয়েদের নিয়তীতে হয়ত এমন পরিনতি থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনি আরো হাজার হাজার জোৎস্না কোন না কোন ভাবে প্রতিদিনই এই পৃথিবী থেকে তাদের স্বপ্ন গুলো সাথে নিয়ে বিদায় নিচ্ছে। আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।
********************************************************************
**(আমার খুব কাছের একজনের বাসার কাজের মেয়ে ছিল এই জোৎস্না। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এই ঘটনাটা আমার সামনেই ঘটে ছিল তার আবছা কিছু মনে থাকা স্মৃতি থেকেই মিলিয়ে লিখলাম।)