বর্ষাকাল আমার খুব ভাল লাগে না, ঝামেলার মনে হয়, শুধুমাত্র যে দিনটা বেকার থাকি, সেই দিনটায় ভাল লাগে, সেটারও প্রথম কারন ঘুম আর দ্বিতীয় কারন মনের ভেতর কেমন একটা প্রেম প্রেম খেলা খেলে যায়, প্রেমিকা না থাকলে, ও খেলাও শালা বৃথা; তবে কবিদের ব্যাপার আলাদা। বসন্ত ঋতুটা আসলে মানুষের থেকে সম্ভবত পশু পাখিদের কাছে প্রিয় বেশী, এর কারন হলো এই ঋতুটা এদের মিলনের মোক্ষম সময়, এই ঋতুতেই পশু পাখিরা সব থেকে বেশী বাচ্চা উৎপাদন করে থাকে। আমি এবং আমার মত যারা গেঁয়ো ছেলেপুলে আছে, অর্থাৎ যারা বড় হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে, তাদের কাছে শীতকালটাই সম্ভবত সবথেকে প্রিয় বেশী। কেন প্রিয় মূলত সেটাই তুলে ধরবার জন্য এই লেখা। লেখার মান যাই হোক, আমি নিশ্চিত এই লেখা অনেককেই তাদের ফেলে আসা কিছু রঙ্গীন দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আজকে প্রথম পর্ব তাই ভূমিকা লিখতে হলো। আজ লিখব শীতে সিনেমা দেখার স্মৃতি নিয়ে।
.
অন্যসব সময়ের থেকে শীতকাল এলেই গ্রামে ছেলেপুলেদের সিনেমা দেখতে যাবার ধুম পরে যেত, এর অন্যতম প্রধান কারন হল চুরি করা সহজ হতো আর প্রচন্ড কুয়াশা। চুরি করা সহজ হতো কীভাবে বলি, শীতের সময় ভারী ভারী সব শীতের কাপড় পরতাম আমরা, দুই তিন কেজী চাল জ্যাকেট বা সোয়েটার অথবা চাদরের আড়ালে আনায়াসে চালান করে দেয়া যেত, কেউ সহজে সন্দেহ করতে পারত না। সেই চাল বিক্রি করা টাকা দিয়েই সিনেমা দেখা হতো সিংহভাগ ছেলেদের, এর বাইরে কেউ কেউ টিফিনের টাকা, কেউবা বাবার পকেট মেরে, কেউবা টিউশনি পরীক্ষার ফি এর কথা বলে বলে টাকা সংগ্রহ করত। যেদিন সিনেমা দেখতে যেতাম, সেদিন মোটামুটি ২০ থেকে ৩০ জন করে একসাথে যেতাম, দু চারদিন আগে থেকেই প্লান করা থাকত, এরপর নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা শুরু, হাঁটা শুরু করলে মনে হতো যেন একটা মিছিল! হাতে জলিল বিড়ি, কত শত গল্প (সব ১৮+), এর লুঙ্গি ধরে টান, ওর চাদর নিয়ে টানা হাচরা, কত কি যে! আহা! বলে রাখি, আমাদের গ্রাম থেকে সিনেমা হলের দূরত্ব ছিল মোটামুটি চার মাইল, শর্টকাট রাস্তায় গেলে সেটা ৩ মাইলের মত প্রায়! শর্টকাট রাস্তায় গেলে যেতে হতো লোকেদের ধানক্ষেত, সবজিক্ষেত মাড়িয়ে, এর জন্য কতবার যে কত লোকের দৌড়ানি খেয়েছি সে হিসেব মেলা ভার।
.
মেইন রোড দিয়ে গেলে তো মহা বিপদ, রাতের বেলা গ্রামের অনেক পরিচিত লোকেরা বাজার সওদা করে বাড়ি ফিরত, তাদের ভেতর একজনও যদি আমাদের ভেতরের একজনকেও দেখেছে তো পরদিন সকালে ২০/৩০ জনের একজনেরও রক্ষা নাই, একটা মাইরও মাটিতে পড়বে না। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় অনেকবার এমন হয়েছে যে হুট করে সামনে গ্রামের পরিচিত কাউকে চোখে পড়ল, অথবা এমন হতো যে, তিনি পরিচিত নন তবু পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে, তখন ভয়ে আমরা কি করতাম; কেউ কেউ রাস্তার ধারের কোন খালে লুকিয়ে যেত, কেউবা কারো বাড়ির পিছনে, কেউ গাছের আড়ালে, আর যারা এসবের কিছুই করার সময় পেত না, সে সোজা সাপ্টা পাছার কাপড় তুলে রাস্তার পাশের ক্ষেতের আলে বসে পড়ত প্রাকৃতিক কর্ম সাড়ার ভান করে! পাছার কাপড় তুলতে লজ্জার কিছুই নাই কারন আর একটু এগোলেই সিনেমা হলের খুব কাছে একটা বিল আছে, সেখানে সবাইকেই লুঙ্গি বা প্যান্ট খুলে মাথায় নিতেই হবে। তখন ব্রীজ ছিল না, আমরা সেই বিলটা এভাবেই পার হতাম, সবাই, কারোরই রক্ষা নাই। ঐ বিল বাদেও অন্য রাস্তা ছিল, তবে ধরা পরার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ!
.
তখন সিনেমা হলগুলি আজকের মত ছিল না, এখন তো বন্ধই হয়ে গেছে বলা যায়। তখন একদম লোকে লোকারণ্য ছিল সিনেমা হলগুলি। টিকেট কিনতে যেয়ে ছোট্ট একটা জায়গা দিয়ে একবারে ৮/১০ জনের হাত ঢুকিয়ে দিতে হতো, সে সময় এমন একজনকে টিকেট কিনতে দেয়া হতো যার হাতের ছাল উঠে গেলে বা কেটে গেলেও বাসায় কেউ জিগ্যেস করবে না বা সন্দেহ করবে না। ১৫/১৬ টাকায় ফার্স্ট ক্লাস এর টিকেট, ঝালমুড়ির ঝাঁঝালো গন্ধ, ৭/৮ পদের জর্দায় পান, কেটু সিগারেট, সিট স্বল্পতার জন্য সিট নিয়ে অন্য গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে মারামারি, আহা! কীভাবে ভুলি সেই দিনগুলি। কয়দিন হলো? মাত্র তো কটা বছর, আমরা তো এখনো বুড়ো হওয়া তো দূরে থাক, বিয়েই করি নাই অথচ; সময়? কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, উল্টে পাল্টে সেই রঙিন দিনগুলিকে তছনছ করে দিচ্ছে!
সিনেমা দেখে বাড়িতে ফিরবার পর সকালের চিত্র যদি এমন হতো যে; হুট করে কোন বড় ভাই বা চাচা সামনে এসে বলতেছে, “কীরে টুনু মিয়া, বড় হয়ে গেছিস না? মনে হয় আমরা কিছু জানিনা?” তখন আর বুঝতে বাকী থাকত না যে আমাদের টিমের ভেতর অবশ্যই একজন ধরা পরেছে এবং তার যথেষ্ট ধোলাই হচ্ছে! আমার বাসাতেও যে একটু পরেই জেনে যাবে সেটা বুঝতে বেশী দেরী নাই কারন যে ধরা পড়ত সে মাইরের ঠেলায় বাকিগুলার নাম বলে দিতে বাধ্য। তখন আমাদের বেশীরভাগ ছেলেরা করতাম কি, বাসায় জানার আগেই দু তিনটা জামা কাপড় স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে নানু, ফুপু বা খালামনির বাসায় দৌড় দিতাম। দু তিনদিন পর খালু, ফুপা বা নানু এসে বাবা মাকে বুঝিয়ে রেখে যেত!
.
সেই দিনগুলি আর নাই। প্রত্যন্ত কোন গ্রামেও নাই। এমনকি নদীর ওপারের কোন চরেও নাই। আর কখনো কোনদিনও আসবে না। আমাদের বয়সে, আমাদের সময়ে আমাদের দিন ছিল এরকম, এখন প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চাও তার অবসর কাটায় মোবাইলে গেমস খেলে, ফেসবুকিং করে, ইউটিউবে হলিউড মুভি দেখে! সারাদিন বিছানা আর পড়ার টেবিল! সেই জন্য আমি সবসময়ই বলি যে আমরা সত্যিই অনেক বেশী ভাগ্যবান যে এই সময়ে আমাদের জন্ম হয় নাই। আমরা গ্রামে থেকে, গ্রামীণ শৈশব এবং কৈশোরটাকে পেয়েছি একদম শতভাগ। সবসময়ই আমি নিজেকে মান্ধাতার এবং গেঁয়ো পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি, সবসময় নিজের শেকড়ের ভাষাটাকে আঁকড়ে থাকবার চেষ্টা করি, অনেকেই অনেক সময় বলেন যে; তুমি তো আবৃত্তি চর্চা কর, এভাবে কেন কথা বল? ওভাবে কথা আসলে আমি বলি না, কথাই আমাকে বলায়! ঐ শেকড়ে যে কি সুখ, কত আনন্দ সে আমি লিখে বুঝানো একেবারেই সম্ভব না। সেইসব দিনের কথা মনে হলে এখন নিজেকে মনে হয় অন্য দেশের মানুষ; স্বপ্ন দেশের মানুষ!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৭:৪৯