somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ প্রথম প্রেম দ্বিতীয় জন্মের আগে

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

ক্যাম্পাসের সামনে এসে দেখি ভিড় জমে আছে এককোণে। আসাদ, জনি, মাহি, বিপুল সহ সব পোলাপান একটা কিছুকে ঘিরে জটলা পাকিয়েছে, উৎসাহী চোখে কথা বলছে নিচুস্বরে। আমি কৌতূহলী হয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম, দেখি তো কাহিনি কি!

কাছাকাছি পৌঁছুতে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম। ওটাকে কি কণ্ঠ বলা যায়? ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে, কর্কশ, মনে হচ্ছে প্রতিটা শব্দ পাথর আর ধাতুর সংঘর্ষে পয়দা হয়ে গলা ফেটে বেরুচ্ছে, 'ওর চুল অন্ধকারে নদীর স্রোতের মতন। নাকের পাশে স্বপ্নের মতো একটা তিল আছে। এখানে পড়ে। তোমরা কেউ চেনো?' আশেপাশে প্রতিধ্বনি হবার উপযুক্ত পরিবেশ বা জায়গা নেই, তবু শেষের 'চেনো?' প্রশ্নটা দু তিন বার প্রতিধ্বনিত হোল গুমগুম করে।

আমি ভিড়ের ভেতরে ঢুকে চমকে গেলাম। যে বস্তুটা কথা বলছে, তাকে দেখে। জিনিসটা দৈর্ঘ্যে স্বাভাবিক, আমাদের মতই লম্বা, কিন্তু প্রস্থে প্রায় তিন মানুষের সমান। কালো কাঁচের গুঁড়ো আর লাল জেলির সংমিশ্রণ ঘটালে যেমন দ্যাখাবে, তেমন থকথকে একটা কিছু দিয়ে সারা শরীর তৈরি; দেহের বিভিন্ন জায়গায় শিরা উপশিরার বদলে অসংখ্য ফাটল দ্যাখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটা ফাটল থেকে ধীরে ধীরে হলুদ দুর্গন্ধময় একটা কিছুর ক্ষরণ ঘটছে, সেগুলো আবার বাতাসের সংস্পর্শে আসতেই শুকিয়ে মিশেও যাচ্ছে শরীরের সাথে। আশ্চর্য ব্যাপার, এতকিছু সত্ত্বেও জিনিসটার আকার মানুষের মতো; চারকোণা শরীরের নিচে দুটো থামের মত পা, শরীরের ওপরে একটা আনারসের মতোন মাথাটা বসানো। নাক কান নেই, চোখ বলতে সাদা একটা টেনিস বলের মাঝে আঁকা কালো ফুটকি, সেটা আবার নড়ছে অবিরত এদিক ওদিক।

-'কিরে,' আমি নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে আসাদের পেটে খোঁচা দেই। 'এইটা কি?'

'জানি না', আসাদ জবাব দেয়, 'একটু আগে ক্যাম্পাসে ঢুকেছে। সবাই তো প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলাম, পরে দেখি কিছু কয় না, শান্তশিষ্টের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে এদিক ঐদিক তাকায়, আমরা একজন একজন করে কাছে ঘেঁষতেই এক মেয়ের বর্ণনা দেওয়া শুরু করল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম পরিচয়, কাকে খুঁজছে; বলে নিজের নাম নাকি দানো।'

জিনিসটা সম্মতিতে আনারস নাড়ায়, 'আমি দানো। ওর হাতদুটো আগুনের মতো, স্পর্শ করলে ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম হয়। ওর ভুরূতে সাতটি তারার তিমির। চেনো ওকে?'

আমরা একজন আরেকজনের মুখে তাকাই, তারপর মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা, 'এসেছে আরেক পাগল। নিশ্চিত মীরাকে খুঁজে। ওরে কল দে তো কেউ।'

দানো হাসি দেয় কথা শুনে, হাসি বলতে আনারসের ওপরে আনুভূমিক একটা ফাটল চড়চড়িয়ে প্রসারিত হয়, ভক করে তার ভেতর থেকে হলুদ চটচটে তরল বেরোয় খানিকটা, তারপর চামড়ায় মিশে যায় হিসস শব্দ তুলে, 'মীরা? ওর নাম মীরা? কি সুন্দর!'

আমার কৌতূহল জাগে। মীরার সাথে এখনো পরিচয় ঘটে নি আমার, কোন ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী কে জানে! আমি জিজ্ঞেস করি, 'মীরাকে খুঁজছ কেন? কি করেছে ও তোমার?'

-'কি করেছে?', দানোর কণ্ঠে বিস্ময় জাগে খানিকটা, 'না, কিছু করে নি। ওর সাথে কথা হয়েছিল আমার, অনেক আগে; এখানে আসতে বলেছিল। আমি বোধ হয় ওর প্রেমে পড়ে গেছি।'

'কেন?'

-'কেন মানে?', দানো এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন অবুঝ শিশু আমি, বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি, 'মীরার চোখ দেখেছ তোমরা? স্মৃতির চোরাবালি! ওর সাথে সময় কাটালে মনে হয় যেন মেঘের অপার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সৃষ্টির প্রাচীন নাদে ফিরে যাচ্ছি; ওর ঠোঁটে উপত্যকার লিলির মতো, আমার প্রথম স্বেচ্ছা-পাপের মতো রোমাঞ্চকর গোপন স্বাদ। ওকে না ভালবেসে কেউ বাঁচে কিভাবে?'

আমার কৌতূহল আরো বাড়ে। মাহি আমার ক্লাসমেট, পুরান বান্ধবী, ওকেই চেপে ধরি এবার, 'মীরা কে রে? ভার্সিটিতে আজ পর্যন্ত দেখলাম না, এখন দেওদানো এসে প্রশংসা করে আর আমি শুনি, শরমের ব্যাপার। পরিচয় করিয়ে দিবি?'

মাহি মুখ বাঁকায়, 'দরকার নাই ভাই। মীরা যে জিনিস, তোর দূরে থাকাই ভালো। মাথা ঘুরে যাবে।'
-'কি জিনিস ও? বল না!'

'তুই জানিস না, ওর প্রব্লেম আছে। বেচারি ভালমত কারো সাথে কথা বললে বা হাসলে, এমন কি তাকালেও বিপদ, সাথে সাথে অন্য মানুষটা ওর প্রেমে পড়ে যায়। আমি সেই স্কুল লাইফ থেকে ওর ফ্রেন্ড, আজ পর্যন্ত এর কোন ব্যতিক্রম দেখলাম না। ও তো মাঝখানে অন্য জিনিস নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছে, সেম অবস্থা। দেখিস না, এই কোথাকার কোন 'দানো' পর্যন্ত দিওয়ানা হয়ে পিছু ধরেছে!

মাহির পাশে আরেকটা মেয়ে, একেও চিনি না, সম্মতিতে মাথা নাড়ে, 'আসলেই, মীরা মেয়েটা বেশি সুন্দরী। কারো সাথে ওর ম্যাচিং হয় না। আর দোষই বা দেই কিভাবে, মীরাকে যারা পছন্দ করে এরা তো মীরা ছাড়া কিছু দেখে না, ওর বাহ্যিক অস্তিত্ব দেখেই পাগল হয়ে যায়। এভাবে রিলেশন হয়? সম্পর্কে তো একটা ভারসাম্য লাগে! এটা প্রেম না পাগলামি?'

মাহি যোগ করে, 'পাগলামি ছাড়া কিছু না। ওইদিন দেখি মীরা ব্যাবিলনের সাথে বসে আসলাম মামার দোকানে ফুচকা খাচ্ছিল, পরের দিনই শুনলাম সে প্রপোজ করেছে, ওকে রাণী বানাতে চায়। মীরা মানা করল, আর বেচারা ব্যাবিলন দুঃখে ওইদিনই বিলুপ্ত হয়ে গেল।'

-'ব্যাবিলন বলতে, প্রাচীন শহর ব্যাবিলন?!' আমি নিশ্চিত হবার জন্যে সাবধানে জিজ্ঞেস করি।

'হুঁ। তার আগে মালয়, বালি, শ্যাম, ইন্দোচীনের সাথে কয়েকদিন ঘুরতে দেখেছিলাম। কেউই ওর সৌন্দর্য সহ্য করতে পারে নি। আমাজনের সাথে সম্পর্ক টিকেছিল সপ্তাখানেক, তারপর যে কে সেই। এরা তো সাধারণ ব্যাপার, গত বছর আকাশ থেকে এক ফেরেশতা নেমে এসেছিল ওর টানে, ও এখন মানুষ হয়ে গেছে, এই ভার্সিটিতেই কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছে। মীরা তাকে পাত্তাও দেয় না।'

মাহি আর কিছু বলছিল, কিন্তু আমি তা শুনতে পাইনি, কারণ পৃথিবীর সব আলো আর শব্দ তখন কেন্দ্রীভূত হয়ে একটু দূরে এক ঈশ্বরীর ওপরে পড়েছে যার নাম নিশ্চয়ই, আমি নিজের প্রাণ বাজি রেখে বলতে পারি, মীরা। মীরার চলনে ভল্গা-মিসিসিপির ছন্দ, মীরার শরীরে নীহারিকা শিখার গন্ধ, মীরার মুখ মেঘের মত আলোর পিছে লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালছিল, আমি সমস্ত শরীর-মন-দেহ সমর্পণ করতে পারি, না, সমর্পণ করতে বাধ্য এই নারীর কাছে; আমি এখনি যাব, গিয়ে মনের কথাটা বলব ওকে এই-

চটাস শব্দে আমার মাথার পেছনে ব্যথা জ্বলে উঠলে আমি সম্বিৎ ফিরে পাই। প্রথমে বুঝতে একটু সময় লাগে কি ঘটল, তারপর দেখি মাহি বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর হাত বিপদজনকভাবে তখনও ওপরে ওঠানো, 'সেন্স ফিরে পাইছিস, নাকি দিব আরেকটা?'
আমি মাথা হাতাই, 'না না, একটাই যথেষ্ট!'
-'বুঝলি আগে কেন মীরার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই নাই?'

'এখন বুঝলাম। আসলেই ডেঞ্জারাস রে! আমি তো চিন্তাই করতে পারি নি এতোটা অপার্থিব আকর্ষণশক্তি মেয়েটার! থ্যাঙ্কিউ দোস্ত', আমি মীরার থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে (আসাদ আর বিপুল তখনও ওর দিকে তাকিয়ে খাবি খাচ্ছে) দানোর দিকে তাকাই। কথা বলছে মীরা ওর সাথে। দানো প্রথমে স্থির চোখে কিছুক্ষণ শুনল মীরার কথা, মীরা নিশ্চয়ই ওকে প্রত্যাখ্যান করছে, কারণ তারপর ভগ্নমনোরথ হয়ে ভেঙে পড়ল বেচারা, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মাঝে মাটিতে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে পড়ল দানোর বিচ্ছিরি শরীর, তারপর হিসস শব্দ তুলে মিলিয়ে গেল বাতাসে।

আহা, বেচারা বিচ্ছেদের জ্বালা সহ্য করতে পারল না।

জটলা ভেঙে গেল ক্ষণিক পরে। যে কয়জন ছেলে মীরাকে দেখেছে তারা সবাই একেক জন একেক দিকে ছোটা শুরু করল। কেউ মীরাকে নিয়ে সাহিত্য লিখতে, কেউ ফুল কিনতে, কেউ তার ছবি আঁকতে। জিনিসটা দেখে আমার মাথায় তখনি বুদ্ধি খেলল একটা। মোবাইল বের করে কল দিলাম একটা নাম্বারে, তারপর বললাম ক্যাম্পাসে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসতে।
-'কাকে কল দিস?', জিজ্ঞেস করল মাহি।

আমি জবাব না দিয়ে হাসলাম, তারপর বললাম, 'মীরাকে বল এক ঘণ্টা পর লাইব্রেরিতে বসতে। আমি একটা জিনিস পরীক্ষা করে দেখতে চাই।'

মাহি সন্দেহের চোখে তাকালেও, আপত্তি করল না। আমার মাথায় আরেকটা চাঁটি মেরে মীরাকে ডাকতে সামনে চলে গেল।


২.


যে নম্বরে কল দিয়েছিলাম, ওটা আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধুর নম্বর। নাম মাসুদ।

এই প্রিয় শ্যালকটির জ্বালায় দুটো বছর সমস্ত কলেজের একটা ছেলেও আমরা প্রেম করতে পারি নি। অবশ্য সরাসরি দোষ হয়তো বা ওর নয়। এমনিতে ও চুপচাপ, মেধাবি একটা ছেলে। কিন্তু সমস্যা একটাই- কোন মেয়ে ওকে দেখলে ঠিক থাকতে পারত না। প্রেমিকের আসনে বসিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ওর অজান্তেই প্রেম করা শুরু করে দিত। ওর কাছে নাকি অ্যাপোলো-অ্যাডোনিস কেউ কিছু না, ও যেখানে যায় 'বসন্তের হিমেল বাতাস বইতে শুরু করে', ও হাসলে 'সমস্ত পৃথিবীটা আলো হয়ে ওঠে', কোন মেয়ের দিকে তাকালে 'হৃদয়ের ভেতরটা পর্যন্ত যেন উন্মুক্ত করে দেখতে পায়'!

খালি সাধারণ মেয়েরা না, মাসুদের প্রেমে অন্যরাও পড়ত ধুপধাপ। ক্লিওপেট্রা আপা ওর সাথে কথা বলার জন্যে প্রতিদিন কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমাদেরকে চকলেট ঘুষ দিতেন যেন মাসুদকে তাঁর কথা বলি। তিন জন স্বর্গের অপ্সরা ওকে দেখবে বলে কলেজে নতুন কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। সরস্বতী দেবী ওকে প্রত্যেক পরীক্ষায় নম্বর বেশি দিতেন, একবার যদি মাসুদ তাঁর দিকে ফিরে তাকায়! শালার এমনও রেকর্ড আছে যে শাদা খাতা জমা দেওয়া সত্ত্বেও সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ফার্স্ট হয়েছে পরীক্ষায়। এই রকম একটা গ্রিক গডের সাথে কম্পিটিশনে আমাদের মতো নিতান্ত সাধারণ অসুন্দর মনুষ্য জাতির সদস্যরা কি ভাত পাবে?

পেতামও না। এবং বর্তমানে ওর ভার্সিটির ছেলেদের কাছে যা শুনি, এখন তারাও পায় না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মাসুদ কখনো এই প্রেমপ্রার্থিনীদের প্রেমে পড়ে নি। হয়তো দুএকবার কথা বলত, তারপর যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতো। আমরা জিজ্ঞেস করলে হাসতো, বলতো ওর নাকি অস্বস্তি লাগে!

মীরাকে দেখে তাই কৌতূহল জেগেছিল আমার, আকর্ষণ ক্ষমতা কার বেশি? কে কার প্রেমে পড়বে? মীরা মাসুদের, না মাসুদ মীরার? তখন প্রেমে পড়া মানুষটার কি কি পরিবর্তন হবে? নাকি কিছুই হবে না, দুজন স্বাভাবিক মানুষের মতো একে অপরের সাথে পরিচিত হবে, তারপর ফিরে যাবে নিজেদের জগতে?

এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই কল দিয়েছিলাম ওকে। মাঠে বসে ছিলাম ওর অপেক্ষায়, আমার চারপাশে পোলাপান সব গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ মাঠটা নিশ্চুপ হয়ে গেলে বুঝতে পারলাম, হ্যাঁ, মাসুদ এসে পৌঁছেছে। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ও হেঁটে আসছে এদিকে, আর সবগুলো মেয়ে হা করে করে তাকিয়ে যেন গিলছে ওকে। আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে লাইব্রেরির দিকে টেনে নিয়ে এলাম।

'কিরে ব্যাটা, হঠাৎ কল দিয়ে আসতে বললি, ঘটনা কি?', ও অবাক মুখে জিজ্ঞেস করল।
-'আছে। আয় লাইব্রেরিতে আয়। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই একজনের।'

লাইব্রেরির সামনেই মাহি দাঁড়িয়ে ছিল। ও আমাকে কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেল, তারপর দেখল মাসুদকে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'ওই, মীরা কই? ভিতরে?'

প্রশ্নটা ওর কানে গেল বলে মনে হয় না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার বন্ধুর দিকে। মাসুদ ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক ছোট্ট একটা হাসি দিল, তাতেই যেন ওর পুরো শরীর কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় ওর দুই চোখে দুটো 'লাভ' সাইন ফুটে উঠবে, আর ও গায়ে ভেজা শাড়ি জড়িয়ে মাসুদকে ঘিরে পুরনো বাংলা ছবির মতো চমৎকার কোরিওগ্রাফিতে নাচানাচি শুরু করে দেবে।

আমি হাসলাম মনে মনে। এবার আমার পালা।

পিঠে বিশাল এক গাট্টা খেয়ে হিচকি উঠে গিয়ে মাহির প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে ছেদ পড়ল, আমি সেই সুযোগে মাসুদকে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। মুখ বিকৃত করে পিঠ ডলতে ডলতে মাহি তাকাল আমার দিকে, 'বজ্জাত কত জোরে কিল দিছিস! একেই কল দিলি তখন, না? এটা কি মীরার পুং সংস্করণ ছিল?'
-'বলতে পারিস।'
'তোর বন্ধু মানুষ তাহলে। পরিচয় করিয়ে দিবি?', দুষ্টুমিমাখা মুখে জিজ্ঞেস করে ও। আমি আরেকবার কিল দেখাই। মাহি এবারে লাইব্রেরির ভেতরে উঁকি দেয়, 'তোর কি মনে হয়, কি হবে এখন?'
-'আয় আগে ভেতরে যাই। ওরা তো একজন আরেকজনকে চেনে না। কথা বলিয়ে দেই চল', আমি বলি।

'আমম, আমার মনে হয় না তার কোন দরকার আছে', মাহি লাইব্রেরির এক কোণায় ইঙ্গিত করে বলল, 'দ্যাখ।'

আমি দেখলাম, লাইব্রেরিতে আর কেউ নেই, শুধুমাত্র মীরা পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে বসে আছে একটা চেয়ারে। তার পাশেই কৌতূহলী চোখে বসেছে মাসুদ, মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। দুজনে কথা বলছে একটা কিছু নিয়ে। কথা বলতে বলতে মীরা মাসুদের চোখে তাকাল, মাসুদ-ও চোখ না নামিয়ে দৃষ্টি ধরে রাখল একটানা।

তারপর। তারপর যেন সময় থেমে গেল মুহূর্তের জন্যে। লাইব্রেরির মধ্যে লু হাওয়া আর জলোচ্ছ্বাসের পাগলা নাচন আর শোঁ শোঁ শব্দের এক মিলিত সিম্ফনি শুরু হয়ে গেল যেন। মাটি কাঁপতে লাগল, তাকের ওপর থেকে বইগুলো সটাক সটাক করে ছিটকে পড়ে হাওয়ায় উড়াউড়ি করা শুরু করল, আর বাতাসের প্রতিটি ছোট্ট কণায় দ্রিম দ্রাম করে কম্পন হতে লাগল, যেন সৃষ্টির আদিম সত্ত্বায় ফিরে যাচ্ছে সবকিছু আবার। আমি আর মাহি মিলে খুব কষ্ট করে লাইব্রেরির দরজাটা চাপালাম, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় পিঠ দিয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। ভেতর থেকে তখনো ধুমধাম বিস্ফোরণ, আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের চাপা শব্দ ভেসে আসছে। আমাদের দুজনকে এ অবস্থায় দেখে একটা সুদর্শন ছেলে এগিয়ে আসে, 'কি হোলো? কোন সমস্যা হয়েছে?'

আমি সজোরে মাথা নাড়ি। মাহি অবশ্য কি ভেবে সংক্ষেপে খুলে বলে মীরা আর মাসুদের কথা। ছেলেটা বিস্ময়ভরা চোখে কিছুক্ষণ শোনে, তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, 'শব্দ তো থেমে গেছে মনে হয়। চলো ভেতরে গিয়ে দেখা যাক।'

আমরা সতর্ক পায়ে দরজা খুলি, তারপর তাকাই এদিক ওদিক। বইগুলো সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, চেয়ার টেবিল উল্টে গেছে, আর এক কোণে একটা অপরিচিত কাপল নির্লিপ্ত বসে গল্প করছে। অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই। এরা কোত্থেকে এলো? আমি চোখ সরিয়ে মাসুদকে খুঁজতে যাব এমন সময় ছেলেটাকে আমার পরিচিত লাগতে থাকে।

আরে ওটাই তো মাসুদ!

কিন্তু ও মাসুদ কি করে হয়? মাসুদের সেই আগের অপার্থিব সৌন্দর্যের জেল্লার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই, ওকে এখন খুব শান্ত, নিরীহ লাগছে; কিসের গ্রিক গড, মনে হচ্ছে স্রেফ আরেকটা সাধারণ ছেলে। আমি ওর পাশের মেয়েটার দিকে তাকাই। তার মানে এই নাকের পাশে তিলওলা সাধারণ দেখতে মেয়েটাই মীরা? মেয়েটা কিউট আছে, অস্বীকার করব না, কিন্তু দেখেই পাগল হবার মত সুন্দরী তো না। কোথায় গেল আমার দেখা সেই ঈশ্বরী মীরা এবং তার অলৌকিক আকর্ষণ? আমি মাহির মুখের ভাব দেখে বুঝলাম ও-ও আমার মত বোকা হয়ে গেছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটায়, ওর মাথায়ও একই প্রশ্ন ঘুরছে।

কি ঘটেছে এখানে?

আমরা ওদেরকে বিরক্ত না করে এলোমেলো পায়ে বাইরে চলে আসি। সিঁড়িতে বসে পড়ি। আমাদের সাথের সুদর্শন ছেলেটা তেমন অবাক হয় নি, সে শান্ত কণ্ঠে ব্যাখ্যা করে-

'বুঝলাম। জিনিসটা ঠিক কেমিস্ট্রির নিয়মের মতন। কিছু মৌল থাকে, তুমুলভাবে সক্রিয়; বিস্ফোরক প্রকৃতির। এরা কারও সাথে বন্ধন গড়লে তা টেকে না। ভেঙে যায়। কিন্তু একটা সক্রিয় মৌল যদি আরেকটার মুখোমুখি হয়, তখন তাদের মাঝে একটা বিক্রিয়া ঘটে, বিস্ফোরণের মাধ্যমে একটা বন্ড তৈরি হয় দুজনের মাঝে। আর কাউকে তারা আকর্ষণ করে না। কিংবা আকর্ষিত হয়-ও না। তখন তারা নিজেদের পূর্বেকার সেই বিস্ফোরক প্রকৃতি হারিয়ে ফেলে স্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

আর তাদের মধ্যকার যে বন্ধন, সেটা খুব শক্ত হয় তখন। সহজে ভাঙা যায় না। মীরা-মাসুদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে মনে হয়। অদ্ভুত সুন্দর পুরো ব্যাপারটা, তাই না?'

বলে ছেলেটা সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে যায়। আমার হঠাৎ সন্দেহ হয়, বলি,
'কেমিস্ট্রির পাঠ দিয়ে গেল...মীরাকেও মনে হোল চেনে...এটা কি সেই প্রাক্তন ফেরেশতা ছিল?'

-'হুঁ', মাহি অন্যমনস্কভাবে জবাব দেয়। ও ভাবছে একটা কিছু। 'আচ্ছা, তাহলে সব টেকসই বন্ধন, বা রিলেশন যাই বলিস, সব কি ধুপ করে হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের মাঝ দিয়ে তৈরি হয়?'

আমি কলেজের ভুলে যাওয়া কেমিস্ট্রি ক্লাসের লেকচার স্মরণ করার চেষ্টা করি, 'নাহ। বন্ধন তৈরির আরও নিয়ম পড়েছিলাম। অনেক মৌল আছে যেগুলি বিক্রিয়ায় বিস্ফোরণের ধারকাছ দিয়ে যায় না। বহুদিন আরেকটা মৌলের সংস্পর্শে কাছাকাছি থাকতে থাকতে একসময় দুজনে প্রচন্ড শক্তিশালি বন্ধন তৈরি করে ফেলে। একটু সময় লাগে, এই আর কি।'

মাহি বড় বড় চোখে কথাটা শোনে। 'স্রেফ একটু সময়?', শুনে ও হাঁফ ছেড়ে নার্ভাস হাসি দেয় একটা, 'তাহলে তো আমাদের মতো নরমাল পাব্লিকের আশা আছে এখনো, কি বলিস?'

আমার মাথার ভেতরে কিছু একটা ক্লিক করে ওঠে তখন। কি বোকা, কি বোকা আমি! অন্ধ হয়ে ছিলাম, এতদিনে জিনিসটা ধরতে পারলাম!

আমি জবাব দেই না। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি, যেন জীবনে এই প্রথমবার দেখছি মাহি নামের মেয়েটাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৫০
৪৫টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×