ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্ট আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। বহুদিন বহুবার মানুষের কষ্ট দেখে চোখে জল এসেছে। তার চেয়ে বড় কষ্ট পাই কারো কষ্টে কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব থেকে। বড় হওয়ার পর থেকে ব্যাপারগুলো আরো অনেক বেশী জেঁকে ধরেছে মনে হয়।
মাত্র চার-পাঁচদিন আগের ঘ্টনা। অফিস শেষ করে জ্যাকসন হাইটের দিকে হেঁটে যাচ্ছি বাংলাদেশে কিছু টাকা পাঠাবো ভেবে। তখনও আমার পকেটে ২/১ ডলার ছাড়া কোন টাকা নেই। আমার বাসা থেকে জ্যাকসন হাইটসে যাওয়ার পথে আমি যে ব্যাংকগুলো ব্যবহার করি, তার তিনটে ব্রাঞ্চ পড়ে। প্রথমটা এলমহার্স্ট হাসপাতালের উল্টো দিকে, তবে ইদানীং সেখানে হোমলেস আর মাতাল লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ার আমি এই ব্রাঞ্চ এড়িয়ে চলি। লোকগুলো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, ঢোকার বা বের হওয়ার সময় দরজা খুলে দেয় এই আশাতে যাতে কেউ তাদের দু'এক টাকা দেয়। আমিও দিয়েছি প্রথম দিকে এখন অবশ্য দেই না। কারণ পরবর্তী দেখলাম লোকগুলো টাকা দিয়ে মদ/গাঁজা কিনে খায়, প্রায়ই রাস্তার এখানে সেখানে পড়ে থাকে।
এই ব্রাঞ্চের উল্টো দিকেই একটা মোবাইল ফুড ভেন্ডর আছে। যারা যায়রো যাতীয় খাবার বিক্রি করেন। এর এটা বাংলাদেশী লোক চালায়, তার কাছ থেকেও বহুদিন খাবার কিনে খেয়েছি, মোটামুটি মানের। আমি ভেন্ডরের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় দেখলাম এক ককেসিয়ান ভদ্রলোক, বাঙালী দোকানদারকে বলছে, "আমি খাবার কিনবো না, কিন্তু ঐ খাবারটির দাম কত?" লোকটি ময়লা টি-শার্ট পড়া। কিন্তু পাশ কাঁটিয়ে কয়েক কদম যাওয়ার পর আমি পেছনে ঘুরে তার চেহারা দেখার চেষ্টা করলাম। চেহারায় কোন হোমলেসনেস এর কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। খুব সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে চাকরি-বাকরি হারিয়ে কোন সমস্যায় পড়েছেন বলে মনে হলো। সত্য-মিথ্যে আল্লাহই ভালো জানেন! আরো কয়েক কদম হেটে যেতেই মনে হচ্ছিলো লোকটা খুব সম্ভবত ক্ষুধার্ত, তাকে আমার সাহায্য করা উচিত। আমেরিকায় এসে "ক্ষুধা" শব্দকে আমি নতুনভাবে অনুধাবন করতে শিখেছি।
লোকটা শুকনো মুখে চলে যাচ্ছিলো, তার মুখে ক্ষুধা এবং হতাশা দুটোই বেশ পরিষ্কার বোঝা গেল। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মি আসকিং, আর ইউ হাঙ্গরি?"
সে মৃদু হেসে বললো: "ইয়াহ বাট দে আর এক্সপেন্সিভ"।
আমি বললাম, "কাম উইথ মি স্যার"।
ভেন্ডরের কাছে গিয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, "হোয়াট ইউ ওয়ানা হ্যাভ?"
সে চিকেন যায়রো খেতে চাচ্ছিলো। আমি বাঙালী দোকানদারকে বললাম, "ভাই, এই ভদ্রলোককে একটা চিকেন যায়বো দেন।"
এবার লোকটা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো, "ক্যান আই হ্যাভ এ কোক?"
আমি হেসে দিয়ে বললাম, "স্যোর, গো এহেড"।
সে একটা ক্যান হাতে নিয়েই, ঢোক ঢোক করে খেতে শুরু করলো, মনে হলো সে তৃষ্ণার্তও ছিলো।
বাঙালী লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই কত হলো? এ পর্যায়ে আমার পকেটে হাত চালিয়ে ওয়ালেট বের করেই মাথা নষ্ট হবার যোগাড়। দেখি পকেটে ১টাকা আছে! ইজ্জত আমার যায় যায় অবস্থা। বাঙালী ভাইকে বললাম আপনি যায়রো বানাতে থাকেন ওনার জন্য আর আমি রাস্তার ওপাশ থেকে ব্রাঞ্চে গিয়ে টাকা নিয়ে আসি।
অনিচ্ছা স্বত্বেও আমার অপছন্দের কাজ করতে হলো, হোমলেস ওয়ালা ঐ ব্রাঞ্চে গিয়ে টাকা তুলে এসে বিল পরিশোধ করলাম। ঘুরে যে হাটা শুরু করবো বলে পা বাড়িয়েছি আমার পথে, ককেসিয়ান লোকটা একটু জোরেই বললো, "থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার"।
আমি "ইউ ওয়েলকাম, টেক কেয়ার" বলে খুশি মনে হাটা শুরু করলাম।
পুরোটা পথ হাটলাম আর ভাবলাম রাব্বুল আলামিন মানুষকে কখন, কিভাবে, কোথায় পরীক্ষা করেন, কি অবস্থায় কিভাবে রাখেন সেটা বলা মুশকিল। এক সময় বিশেষ করে স্কুল/কলেজ জীবনে তার মতো আমিও কত ক্ষুধায় কাতর থেকেছি! আজ যখন অন্য কাউকে ঐ অবস্থায় দেখি তখন খারাপ লাগে বৈ কি! তবে আমার জীবন থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি সেটা হলো, নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেকেই চেষ্টা করে যেতে হবে। কিছু পথ নিজেকে একাই হাটতে হয়, কিছু পথ বরাবরই দীর্ঘ মনে হয়। পথ চলতে গিয়ে শহীদ হওয়া অসম্ভব নয়, তবে মানুষ কখনোই শহীদদের কথা প্রতিদিন মনে করে না, জয়ী বা বীরদের স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে। ব্যর্থতার গল্প কেউ শোনে না, শুনতেও চায় না, মানুষ বরাবরই সফল হতে চায়, সফলতার গল্প শুনতে চায়, অনুপ্রাণিত হতে চায়। আপনার গল্প আপনাকেই রচনা করতে হবে, সফলতা বা ব্যর্থতা দু'টোই আপনার হাতে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২২ রাত ১১:১১