গতকাল রাতে হঠাৎ করেই ফোনে একটা এলার্ট এলো। ফোন খুলতেই দেখি, ২৭ শে মে আমার দাদা ভাইয়ের ৩০তম প্রয়াণ দিবস। বেশ কিছুক্ষণ স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে থেকেই দাদা ভাইয়ের আবছা হয়ে যাওয়া মুখটা খানিক মনে করলাম। পুরোপুরি পরিষ্কার তাকে মনে করতে না পারলেও এখনো তাকে দেখতে পাই, অনেকটা আলো-ছায়ার মতো। দেখতে দেখতে কিভাবে ৩০টা বছর চলে গেল বুঝতে পারিনি।
ত্রিশ বছর আগে কোন একদিন গ্রাম থেকে খবর এলো, দাদু ভাইয়ের শরীর খুবই খারাপ। বাবা ঐ রাতেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন গ্রামের উদ্দেশ্যে। সে সময়ে বাসে করে আমাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়া যেত কি না মনে নেই, তবে আমরা মূলত দোতালা লঞ্চগুলোতে চড়ে গ্রামের বাড়ি যেতাম। পরে বাবার মুখ থেকে শুনেছি, তিনি গ্রামে গিয়ে পৌঁছেছিলেন প্রায় সকালের দিকে। অবশ্য তিনি গ্রামে গিয়ে দাদুকে জীবিত দেখতে পান নি। দাফন-কাফন শেষ করে বাবা কয়েকদিন পর বাড়ি এলেও সে সময় তার মানসিক অবস্থা বোঝার মতো স্মৃতি বা জ্ঞান ছিলো না।
দাদা ভাই যখন চলে গেলেন তখন আমার ৯/১০ বছর বয়স হবে, স্কুলে যাচ্ছি। কাছের মানুষের চলে যাওয়ার দুঃখ অনুভূতিটা তখনো হয়তো পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারিনি। অবশ্য জ্ঞান হওয়ার অনেক পরে আমার বাবাকে দেখতাম, দাদু ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে আসতো, বরাবরই তার চোখ জলে টলমল করে উঠতো। আজ বাবা নেই সত্যি, তবুও আমি বাবার অনুভূতিটা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি।
আমাদের ছোটবেলায়, দাদুভাই আমাদের বাসাতেই থাকতেন। মনে নেই তবে বাবা-মা'র কাছে শুনেছি তিনি ছ'ফুট দুইয়ের মতো লম্বা ছিলেন। আমাদের গ্রামের বাড়ির দরজা দিয়ে বের হতে তাকে বাকা হতে হতো। তবে তিনি হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন। আমার বাবা অবশ্য ততটা লম্বা ছিলেন না তবে ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষকে বাঙালী হিসেবে লম্বাই বলতে হবে। আমার মা-ও বেশ লম্বা। বড় ভাই ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। পরিবারে আমি ছাড়া সবাই মোটামুটি লম্বা, তবে কেউই দাদা ভাইয়ের উচ্চতা ছাঁড়িয়ে যেতে পারে নি এখনো।
বাবা প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে দাদা ভাইকে বলে যেতেন, "বাবা, অফিসে যাচ্ছি। অসুধটা সময় মতো খেয়ে নিয়েন।" দাদা ভাইয়ের উত্তর ছিলো, "ঠিক আছে, তুমি সাবধানে অফিস যাও বাবা। আমিতো আছি, তুমি চিন্তা করোনা"। দাদা ভাই কখনো কখনো আমাদের নিয়ে টঙ্গীর চেরাগ আলী কাাঁচা বাজারে যেতেন। বাবার অফিস তখন টঙ্গীতেই ছিলো। দাদা ভাই বাজার করার আগেই আমাদের নিয়ে হোটেলে বসতেন, কখনো চা, মিষ্টি খেতেন আমরাও তাই দাদা ভাইয়ের সাথে সব সময় বাজারে যেতে চাইতাম। তিনিও খুশি মনে আমাদের সাথে নিয়ে যেতেন। গরুর মাংশ তার ভীষণ প্রিয় খাবার ছিলো, এটা মনে আছে।
শীতের সকালে, ঘুম থেকে উঠেই দাদা ভাইয়ের রুমে চলে যেতাম। কখনো দেখতাম তিনি নামাজ পড়ছেন, কখনো বা নামাজ শেষ করে টুপি মাথায় বসে আছেন, কখনো বা শুয়ে। আমরাও দাদার বিছানায় গিয়ে তার লেপ-কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়তাম। দাদা ভাই, কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, কখনো দুরুদ পড়ে ফু দিয়ে দিতেন। মা এসে দাদা ভাইকে গরম গরম সকালের চা-নাস্তা দিয়ে যেতেন। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দাদা ভাই মুখে রুটি-পরাটা দিয়ে খাইয়ে দিতেন। চা বেশী গরম থাকলে দাদা পিরিচে ঢেলে খেতেন।
বিকেল বেলা বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গেলেও, দাদা ভাই তীক্ষ্ম নজর রাখতেন আমাদের দিকে।
আজ দাদা ভাই নেই, বাবাও নেই। তারা যেখানেই থাকুন না কেন, মহান রাব্বুল আলামিন তাদেরকেও শান্তিতে রাখুন এটাই প্রত্যাশা করছি।
বিঃদ্রঃ কিছুক্ষণ আগেই মা'কে দাদা ভাইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই বললো, দিনটা ২৭শে মে হবে ২৪শে নয়। কিছুক্ষন ঘাটাঘাটি করে বুঝতে পারলাম আমার ফোন দু'দিন আগে আমাকে এ্যালার্ট করেছে আর আমিও ধরে নিয়েছি আজই তার প্রয়াণ দিবস। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ থাকছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:১২