বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে বর্তমানে এম.আর.সি.এ (মাল্টিরোল কমব্যাট এ্যারক্রাফট) বলতে শুধু আটটি মিগ ২৯ যুদ্ধ বিমান রয়েছে (ফ্লাইটগ্লোবাল)। মনে রাখা প্রয়োজন যে মাল্টিরোল বলতে একাধিক ধরনের মিশন পরিচালনায় সক্ষম যুদ্ধ বিমানকে বোঝানো হয়ে থাকে যা আকাশে শত্রু বিমানের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে, আকাশ থেকে ভূমিতে সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের বোমা নিক্ষেপ, শত্রুর বিমানকে নিজস্ব আকাশে প্রবেশ করতে না দেয়া, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ কিংবা অন্য কোন যুদ্ধ বিমানকে আকাশে নিরাপত্তা সহায়তা দেয়ার মতো মিশন পরিচালনায় সক্ষম। বাংলাদেশের মিগ-২৯ বিমানগুলো বেশ পুরোনো। দীর্ঘদিন ফ্লাই করার পর বিমানগুলো ওভারহলিং করতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনী সে সময়ে কিছু যন্ত্রপাতি যোগ করে বিমানকে কিছুটা আপগ্রেড করে থাকে ব্যবহারের সুবিধার্থে। ভুল না জেনে থাকলে বাংলাদেশ বেশ ক'বছর আগে ইউক্রেন থেকে কয়েকটি বিমান ওরকমভাবেই আপগ্রেড করিয়ে নিয়ে এসেছে (কীমিলিটারী)। বর্তমানে ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান থাকায় বাকি কয়েকটি বিমান সম্ভবত বেলারুশ থেকে ওভারহলিং করানো হবে (টপওয়ার)।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এম.আর.সি.এ যুদ্ধ বিমানগুলো কিছুটা আপগ্রেড করাচ্ছে তার কারণ সহসাই বাংলাদেশে নতুন এ ধরনের কোন যুদ্ধ বিমান আসছে না যদিও এ ব্যাপারে অনেক আগেই (২০১৫-১৬) টেন্ডার ছাড়া হয়েছিলো (কুওয়া)। প্রাথমিকভাবে রাশিয়া থেকে মিগ-২৯ এর উন্নত ভার্সন (মিগ-৩৫) কেনার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটা দামের কারনে হয়ে ওঠেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক টানপোড়ন কাজ করেছে এখানে। এরপর বিভিন্ন সময়ে চাইনিজ কিছু বিমান নিয়ে কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত সেটাও হয়ে ওঠেনি। শেষ-মেষ ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। খুব সম্ভব ইউরোপিয়ান কয়েকটি কোম্পানী আগ্রহ দেখিয়েছিলো। বাংলাদেশ হয়তো এখনো যাচাই বাছাই করছে কিংবা বিষয়টি নিয়ে ঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি।
আমার মতামত: যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের জন্য আমি বরাবরই আমেরিকান যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের পক্ষপাতি। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ দেখাতে পারলেও সবচেয়ে বড় কারণ হলো ওদের যুদ্ধ বিমানগুলো ইতোমধ্যেই বিভিন্ন যুদ্ধে পরীক্ষিত যা অন্যকোন দেশের যুদ্ধ বিমানের নেই। এ কথা সত্য ইউরোপের কিছু বিমানও কম-বেশী পরীক্ষিত কিন্তু আমেরিকার বিমানগুলোর মতো অতটা নয়। বিভিন্ন যুদ্ধ বিমান নিয়ে কথা বলতে গেলে লিখা অনকে বড় হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলবো বাংলাদেশে বিমান বাহিনীর জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দুই স্কোয়াড্রন জেনারেল ডায়নামিকসের এফ-১৬ (ব্লক-৭০/৭২) যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের পক্ষপাতি।
যতদূর জানা যায় তাতে আমেরিকাও চায় বাংলাদেশ তাদের যুদ্ধ বিমান কিনুক যদিও অতীতে বাংলাদেশ এফ-১৬ কিনতে চাইলেও আমেরিকার কংগ্রেসে সেটার অনুমোদন হয় নি। সে সময়ে তারা ভেবেছিলো বাংলাদেশকে এফ-১৬ দেয়া হলে এই বিমান সংক্রান্ত প্রযুক্তি চাইনিজদের হাতে পড়ে যাবে। তবে বর্তমানে সে ধারনার পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি আমেরিকাও চাচ্ছে বাংলাদেশ তাদের বলয়ে থাকুক। অবশ্য বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে আমার ধারনা। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের বিমান বাহিনী প্রধান এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানার জন্য আমেরিকা সফরও করেছেন (ঢাকা ট্রিবিউন)। তার সফরে যুদ্ধ বিমানের পাশাপাশি এ্যাপাচি এ্যাটাক হেলিকপ্টার ক্রয়ের বিষয়টিও জড়িত বলে আমার ধারনা।
আমেরিকা স্ট্র্যাটেজিক কারনে বাংলাদেশকে অন্যান্য ক্রেতা দেশের তুলনামূলকভাবে কমদামে এই বিমান সরবরাহ করবে। একই প্যাকেজে পাইলট ট্রেনিং, খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও বেশ কিছু আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপ যোগ্য মিসাইলও পাবে। রাশিয়া তাদের বেশীরভাগ যুদ্ধ বিমানে দুটো ইঞ্জিন ব্যবহার করে তার অন্যতম কারণ হলো যাতে একটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও অন্যটি দিয়ে বিমান পরিচালনা করা যায়, কিন্তু তাতে জেট ফুয়েল ব্যবহার হয় অনেক বেশী। এফ-১৬ এর ইঞ্জিন একটি হলেও সেটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন বাহিনীতে সুনামের সাথে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে একটি নেতিবাচক দিক হতে পারে সেটা হলো আমেরিকার যুদ্ধ বিমান বরাবরই বেশ উন্নত প্রযুক্তির হওয়াতে এর পর্যবেক্ষন এবং মেইটেননেন্সে বেশ খেয়াল রাখতে হয়। এখনো পর্যন্ত জেনারেল ডাইনামিকস প্রায় ৪ হাজারেরও বেশী এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান তৈরী করেছে যা বর্তমানে ২৫টির মতো দেশের বিমান বাহিনীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে মিগ-২৯ তৈরী হয়েছে ১৬০০ ইউনিট এরও কম আর এর ব্যবহারকারী দেশগুলো মূলত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে বেশ দুর্বল মানের।
বর্তমানে মিগ-৩৫ (মিগ-২৯ এর আপগ্রেডেড ভার্সন) এর আনুমানিক বাজার মূল্য ৫০ মিলিয়ন ডলার অন্যদিকে একটি এফ-১৬ (ব্লক সি/ডি) এর আনুমানিক বাজার মূল্য ৩০ মিলিয়ন ডলার (মিলিটারী মেশিন)। যদিও আলোচনায় উল্লেখিত মডেলগুলো আর দামের ক্ষেত্রে উল্লেখিত মডেল শতভাগ এক নয় তবুও কিছুটা ধারনা দেয়ার জন্য উল্লেখ করা। প্রকৃত দাম জানা প্রায় অসম্ভব তাই উল্লেখিত দামে ১৯/২০ হওয়া অসম্ভব নয়। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে রিটেইল দাম যেমনই হোক না কেন ক্রয়ের ক্ষেত্রে দর কষাকষি করা গেলে বা বিক্রেতা দেশের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে অনেক সময় বেশ ভালো প্যাকেজে পন্য ক্রয় করা সম্ভব। যেমনটা বাংলাদেশ করেছে বোয়িং কোম্পানির সাথে বিমানের ৭৮৭-৯ মডেলের বেসামরিক বিমান ক্রয়ের ক্ষেত্রে (সিম্পল ফ্লাইং )।
এই যুদ্ধ বিমানগুলোতে ব্যবহার যোগ্য মিসাইল এবং এদের দাম নিয়েও যথেষ্ট ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বিষয়গুলো অনেকটাই জটিল এবং বেশ আলোচনার অবকাশ রয়েছে তবুও একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এফ-১৬ বিমানে আকাশ থেকে আকাশে ব্যবহার যোগ্য স্বল্প দূরত্বের বিমান বিধ্বংসী একটি এইম-৯ (সাইডওয়াইন্ডার) মিসাইলের দাম তুলনামূলকভাবে মিগ-২৯ এ ব্যবহৃত একই ধরনের রাশিয়ার নির্মিত আর-৭৩ (আর্চার) মিসাইলের চেয়ে বেশী হওয়ার কথা (সঠিক দাম জানা সম্ভব হয় নি)। যদিও আর-৭৩ মিসাইল তুলনামূলকভাবে বেশী ভয়ংকর বা কিল রেশিও ভালো বলেই সবাই জানে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের আকাশসীমা অপেক্ষাকৃতভাবে ছোট হওয়ার দীর্ঘ দূরত্ব কিংবা দৃষ্টিসীমার বাইরের (বিভিআর) যুদ্ধ বিমান আক্রমণের জন্য মিসাইল কেনা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা প্রয়োজন স্বল্প দূরত্বের মিসাইল। খুব সম্ভবত সে কারনেই আমাদের বিমান বাহিনীতে বর্তমানে শুধু আর-২৭ (বিভিআর) মিসাইল ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইউ.এস এয়ার ফোর্স বর্তমানে আর কোন এফ-১৬ ক্রয় না করলেও যুদ্ধ বিমানটির উন্নত সংস্করণ এখনো উৎপাদিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে রাশিয়াও তার বিমান বাহিনীর জন্য আর মিগ-২৯ নতুন করে ক্রয় করছে না তবে খুব সম্ভবত বিমানটির উৎপাদন অব্যাহত থাকবে মূলত অনুন্নত দেশগুলোর বিমান বাহিনীর জন্য।
ইউরোপিয়ান জেট যেমন দাসাল্ট রাফায়েল (দুটো ইঞ্জিন, ১১৫ মিলিয়ন ডলার), সুইডিশ সাব গ্রাইপেন (একটি ইঞ্জিন, ৮৫ মিলিয়ন ডলার) ও ইউরোফাইটার টাইফুন (দুটো ইঞ্জিন, ১২৪ মিলিয়ন ডলার) নিয়েও বেশ আলোচনা হয়েছে তবে এগুলোর দাম অনেক বেশী বলে আমার মতে এগুলো বাংলাদেশের জন্য ততটা উপযুক্ত নয়।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত থাকায় বাংলাদেশের আকাশ সীমা নিয়ে খুব বেশী ভীত হওয়ার তেমন কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। অন্যদিকে মায়ানমার থাকার কিছুটা চিন্তা সবসময়ই আমাদের মাথায় রাখতে হবে বা রাখা উচিত বলে আমার মনে হয়। আমেরিকার স্যাংশনের কারনে ওরা সুদূর ভবিষ্যতেও আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান জেট ক্রয় করতে পারবে না। অন্যদিকে কিছুদিন আগেই আর্ন্তজাতিক আদালতের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের জলসীমা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটার নিরাপত্তার বিষয়টিও আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। মায়ানমার আগে থেকেই মিগ-২৯ ব্যবহার করছে। সম্প্রতি রাশিয়ার তৈরী সুখোই এসইউ-৩০ অর্ডার করেছে যা মিগের তুলনায় বেশ আধুনিক। মূলত রাশিয়ান এবং চায়নিজ প্রযুক্তি নির্ভর মায়ানমার বিমান বাহিনীর তুলনায় প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকার জন্য এবং সম্ভাব্য কনফ্লিক্ট এড়িয়ে চলার জন্য ইউরোপ-আমেরিকার বিমান ওদের জন্য বরারবই সারপ্রাইজিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।
সরকার প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলেও আপনার খারাপ প্রতিবেশী আপনার সাথে উসকানি দিয়ে বা গায়ে পড়ে যে লড়তে আসবে না সেটা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়াটা বোকামি। কিছুদিন আগেও ওদের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও সে খবর এসেছে। সবার সাথে ভালো সম্পর্ক বজার রাখার পাশাপাশি শক্তিশালী বিমান বাহিনী বাংলাদেশের জন্য বিলাসিতা নয় বরং অত্যাবশ্যক। বাণিজ্যিক কারনেই চট্টগ্রাম অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাই দক্ষিণের আকাশ সীমার পূর্ণ নিরাপত্তার জন্যে হলেও অন্তত ২৪টা আধুনিক (৪++ প্রজন্মের) মাল্টিরোল যুদ্ধ বিমান প্রয়োজন। বাংলাদেশের আকাশসীমাকে মূলত সাউথ এবং নর্থ এই দুটো জোনে (এয়ার ডিফেন্স) ভাগ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এফ-১৬ হতে পারে অন্যতম অস্ত্র। প্রয়োজনে এফ-১৮ এর কথাও ভেবে দেখা যেতে পারে। সেটা অবশ্য অন্য এক আলোচনার বিষয়।
দ্রষ্টব্য: আমি কোন সামরিক বিশেষজ্ঞ নই, নিতান্তই ব্যক্তিগত গবেষণার আলোকে নিজের মতামত তুলে হয়েছে। অনেকেই মনে করতে পারেন আমি কেন এই বিমান কেনার কথা বলছি। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য সরকার "ফোর্সেস গোল ২০৩০" ঘোষণা করেছে আরো অনেক আগেই। সেই মোতাবেক নতুন যুদ্ধ বিমান কেনার কথা। তারই আলোকে আমার এই আলোচনা।
ছবি কপিরাইট: লকহিড মার্টিন