
আর্ন্তজাতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পশ্চিমাদের প্রভাব তথা লেনদেনে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য ইউরোপ-আমেরিকার অনুকূলে থাকলেও তা এশীয় এবং আফ্রিকা মহাদেশের জন্য বেশ দুঃশ্চিন্তার কারন বেশ অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে ডলার আমেরিকার মুদ্রা হওয়ায়, দেশটি তার ইচ্ছে অনুযাীয় যে কোন দেশের উপর অর্থনৈতিক স্যাংশন আরোপ করতে পারে। আমেরিকা আগেও বহুবার ডলার-কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে আর এখনো করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া কর্তৃক ঘোষিত ইউক্রেনে "স্পেশাল মিলিটারী অপারেশন" শুরু হওয়ার পর থেকেই আমেরিকা রাশিয়ার উপর একের পর এক স্যাংশন আরোপ করে যাচ্ছে। আর এ কারণেই বিশ্ব-বাজারে ডলার নিয়ে যে সংশয় তৈরী হয়েছে তা মূলত "ব্রিকস" উদ্যোগের গতিকে আরো তরান্বিত করেছে এবং করছে।
ঊদীয়মান অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে রাশিয়া, ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে প্রাথমিকভাবে যাত্রা শুরু হলেও এ বছর আরো কিছু (৬ টি) নতুন দেশের নাম যোগ হয়েছে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে। যাদিও ব্রিকসে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করা দেশগুলোর তালিকায় আরো অনেকগুলো দেশ রয়েছে। সেই তালিকায় বাংলাদেশ থাকায় এবং এ বছর সদস্য পদ লাভ না করায় ঢাকা কিছুটা উদ্বিগ্ন বটে। তবে আমার ধারনা প্রশাসন পুরো বিষয়টিকে কিছু হালকা ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। প্রশাসনের মতো আমিও মনে করি ব্রিকসে যোগ দেয়াটা বাংলাদেশের জন্য অনেকটাই জরুরী। তাহলে বাংলাদেশ কেন এ বছর সদস্যপদ লাভ করতে পারে নি? বিষয়টি ভাববার মতো।
তার আগে কিছু বিষয় খোলাসা করা যাক। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি দেশ নিয়ে ব্রিকসের যাত্রা শুরু হলেও ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ২০২১ সালে উরুগুয়ে, আরব আমিরাত ও বাংলাদেশকে তাদের সম্ভাব্য নতুন সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলো (সূত্র)। ধারনা করা হয়েছিলো ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য সামিটে এই দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম পর্যায়ে নতুন সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিকসে যোগদান করবে। বাস্তবে তেমনটা হয় নি। কিন্তু কেন?
রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর ও পুরোনো। বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রাশিয়া বাংলাদেশকে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে সমর্থন দিয়ে এসেছে। নিজস্ব স্বার্থের কারনে হলেও রাশিয়া বাংলাদেশকে ব্রিকসে দেখতে চাইবে এমনটাই আশা করা হয়েছিলো। অন্যদিকে ২০১৬ সালে চীন প্রথমবারের মতো বাংলাদশকে তাদের কৌশলগত মিত্র ঘোষণা করে (সূত্র)। সেই থেকে চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্ম-কান্ডের অংশীদার হিসেবে সুবিধা দিয়ে এসেছে। ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদানের ব্যাপারে বরাবরই সবুজ সংকেত দিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেয়া হয়নি।
চীন, রাশিয়ার ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থনের পর, মূলত ভারত আর ব্রাজিলের কারনেই বাংলাদেশের সদস্যপদ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। পরিষ্কার ভাষায় ভারত-কে উল্লেখ না করা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সামিটের আগে উল্লেখ করেন যে ব্রিকসের বর্তমান সদস্য রাষ্ট্রগুলো কিছু বিষয়ে মতৈক্যে পৌছাতে পারেন নি। ধারনা করা হয় মূলত আমেরিকা কর্তৃক আরোপিত স্যাংশনের কারনে ভারত ও ব্রাজিল বাংলাদেশকে এখনই সদস্যপদ দেয়ার ব্যাপারে সমর্থন দিয়ে আমেরিকার বিরাগভাজন হতে চায় নি। বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠে সামিটে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে (সূত্র)। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তার অভিযোগও তুলে ধরেছেন।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, নতুন সদস্য রাষ্ট হিসেবে ইথিওপিয়াকে-ও গ্রহণ করা হয়েছে যাদের নমিনাল জি.ডি.পি (১৫৬ বিলিয়ন, ২০২৩) বাংলাদেশ (৪২১ বিলিয়ন, ২০২৩) থেকেও অনেক কম। অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিভিন্ন মাপ-কাঠিতেও বাংলাদেশ ইথিওপিয়া থেকে অনেকটাই এগিয়ে। তার পরেও বাংলাদেশের সদস্যপদ না পাওয়ার তেমন কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করা বেশ কঠিন ব্যাপার।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন ভারত এবং ব্রাজিল উভয়ই আমেরিকার অন্যতম বানিজ্যিক অংশীদার। আমেরিকা প্রদত্ত তথ্যানুযাীয় ২০১৯ সালে ভারত ৫৭.৭ (সূত্র) ও ব্রাজিল ৩০.৮ (সূত্র) বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশদুটো আমাদের সমর্থন দিতে রাজি হয় নি। আর ব্রাজিলের তুলনায় ভারতের আমেরিকায় রপ্তানি বাণিজ্যের আর্থিক মূল্য অনেক বেশী তাই দাদারা বাংলাদেশকে সমর্থন দেয় নি।
এক রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমেরিকা ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ বিলিয়ন ডলারের (সূত্র) আর্থিক সহায়তা বাংলাদেশকে দিলেও দেশটির সাথে সম্পর্ক অনেকটাই তেঁতো হয়ে আছে বিভিন্ন কারনে। বিশেষ করে বাংলাদেশের চীন ও রাশিয়া প্রীতি বা নির্ভরতা আমেরিকাকে আরো বেশী উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সন্দেহ নেই। সম্পর্ককে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চললেও বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে আমেরিকা অনেকটাই নাখোশ। সেই সাথে বাংলাদেশের সাথে চীনের তুলনামূলকভাবে বেশী মাখামাখিকেও ভারত সুনজরে দেখছেনা। অনেকেরই মনে থাকার কথা যে চীন বাংলাদেশের কাছে দুটো সাবমেরিন বিক্রয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী নাখোশ ছিলো ভারত। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত মায়ানমারকে দুটো ভারতীয় সাবমেরিন দিয়েছিলো।
যাইহোক, কিছুদিন আগেই নরেন্দ্র মোদী আমেরিকা সফর করে এসেছেন, কিন্তু তার সফরের আগেই আমাদের মোমেন সাহেব ভারত সফর করে এসেছেন ভারতের মাধ্যমে আমেরিকাকে বাংলাদেশের ব্যাপারে বার্তা দেয়ার জন্য। যদিও এ ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি "নো কমেন্টস" বলে এড়িয়ে যান (সূত্র)। ধারনা করা হয় বাংলাদেশের উপর আরোপিত আমেরিকার ভিসা সংক্রান্ত ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনকে নমনীয় হওয়ার ব্যাপারে মোদীর মাধ্যমে কোন মেসেজ দেয়া হয়ে থাকতে পারে, যদিও এধরনের কোন বিষয়ে ভারত প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য করে নি (সূত্র)।
ছবি কপিরাইটঃ দ্যা বিজনেস স্ট্যানডার্ড।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ৯:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



