প্রতিবারই দেশে বেড়াতে আসার সময় আমার বেশ উৎসাহ কাজ করে। কিন্তু বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার পর থেকে দেশ থেকে রিটার্ন করার আগ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা আমার কখনোই সুখকর হয় না। বলতে পারেন যতটা উৎসাহ নিয়ে আসা হয় তার চেয়ে বেশী তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হয়। পুরো বিষয়টাই এতটা তিক্তকর অবস্থায় পৌঁছেছে যে আমি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এবারের পর আগামী এক দশকেও আর দেশে আসবো না যদি না সিরিয়াসলি কোন জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হয়।
এবার দেশে আসা হয়েছে বেশ কিছু কাজ হাতে নিয়ে, কাজগুলো গোছানোর চেষ্টা করছি। কিছু কাজ হচ্ছে আর কিছু হতে বেশ সময় লাগবে। ঠিক কবে নিউ ইয়র্ক ফেরত যাবো তার সঠিক তারিখ এখনো জানি না। যেহেতু সময় নিয়ে এসেছি তাই অফিসের কাজ নিয়েই আসতে হয়েছে। প্রতিদিন রাতে কাজে বসি আর ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার পরেই বিছানায় যাচ্ছি। বিয়টা অস্বস্তিকর হলেও তেমন কোন অল্টারনেটিভও হাতে নেই। কাজের সুবাদেই ইন্টারনেট না হলে আমার কোনভাবেই চলে না। বাসায় প্রথমে স্থানীয় ব্রডব্যান্ড কোম্পানীর ইন্টারনেট কানেকশান নিয়েছি সেই সাথে গ্রামীনের ৪জি মোডেমটাও রেখেছি ব্যাকআপ হিসেবে। বিদ্যুৎ চলে গেলেও ব্যাকআপ হিসেবে ল্যাপটপ ও বেশ বড়সড় রিচার্জেবল ব্যাটারীও্ আনতে হয়েছে ল্যাপটপ চার্জ করার জন্য। ভয়ঙ্কর প্রিপারেশন আর মোটা অংকের অর্থ ব্যয় না করলে এখানে সে অর্থে কাজ করা কঠিন।
সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই একদিন হঠাৎ করেই ইন্টারনেট নেই। ৪৮ ঘন্টার পরে ইন্টারনেট আসার পর বুঝলাম, একটা কানেকশানের উপর ভরসা করা কঠিন। আরো একটি ইন্টারনেট কানেকশান নেয়া হলো। দুটো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশান থাকার পরেও ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। দু্'দিন পরপরই, তার কাটা পড়েছে জাতীয় সমস্যা ফেইস করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে খারাপ কানেকশানের কারনে রাউটারে কানেক্ট করা গেলেও ইন্টারনেটে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। অবস্থা এতটাই বেগতিক মনে হয়েছে যে আমি দুটো রাউটার বাসায় রেখেছি। মনে পড়ে করোনার সময় থেকে নিউ ইয়র্কে ভেরাইজনের একটা কানেকশান নিয়েছিলাম, প্রায় বছর তিনেক হতে চলেছে। কোনদিনও এক দু ঘন্টার বেশী সার্ভিস ডাউন হতে দেখিনি হলেও তা রাত ৩/৪টার পর হতো।
আমি বসুন্ধরার যে এরিয়াতে আছি সেখানকার প্রায় সবগুলো ব্লকেই বৈদ্যুতিক পিলারে কয়েক শ' ইন্টারনেট তার ঝুলে থাকে। রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই রাস্তার উপর তার ছেঁড়া চোখে পড়ে। ভাবি বসুন্ধরাতেও যদি এই অবস্থা হয় তবে দেশ কিভাবে চলছে। এইভাবে জোড়া তালি দিয়ে আর কত যুগ চলবে? বিষয়গুলো নিয়ে কোন প্ল্যানিং চোখেও পড়ছে না।
এই দেশের মানুষগুলোর গায়ের চামড়া সম্ভবত পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের মানুষের তুলনায় অনেক মোটা। এখানে পানি নোংরা, পানের অযোগ্য। দেশে আসার পর থেকেই আমি ৫ লিটারের পানির বোতল কিনে খাচ্ছি পুরো পরিবারসহ। রাস্তা-ঘাটে অজস্র খাদা-খন্দ দিয়ে ভরা। এখানে সেখানে ময়লা-আর্বজনার স্তুপ। অব্যবহৃত প্লটগুলোতে এত ময়লা জমেছে যে প্রায় প্রতিদিনই এখানে মশক নিধনের ধোঁয়া দিতে হচ্ছে। তবুও মশার নিয়ন্ত্রন সম্ভব হয় না। আমি সৌভাগ্যবান যে আমার এ্যাপার্টমেন্টের সব জানালা এমনকি বারান্দাও নেট দিয়ে ঢাঁকা। আমার এ্যাপার্টমেন্টে মশা নেই বললেই চলে। তবে সন্ধ্যার পর, বিল্ডিং এর নিচতলায় দশ সেকেন্ড দাঁড়ানোর জোঁ নেই। মশা কর্তৃক নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% বাকি ৫০% ভাগ্য বলতে হবে।
সরকারি কিছু কাজ করাতে হবে, অফিস থেকে বললো আবেদন করতে হবে অনলাইনে। কিন্তু সাইটই-তো ঠিকমতো কাজ করছে না। কিসের ডিজিটাল হলো দেশ? গত বছরের ট্যাক্স ফাইলিং এর কাগজ প্রিন্ট করানোর জন্য "লেটার" সাইজ কাগজ পেলাম না আশেপাশে কোথাও। যেতে হলো নীলক্ষেত। সেখানেও ঐ সাইজের কাগজ নেই, বড় সাইজের কাগজ কেটেকুটে লেটার সাইজ করে প্রিন্ট করাতে হলো। আর প্রিন্টারও মাশাল্লাহ। প্রফেশনালি কাগজ প্রিন্ট করে পেট চালানো লোকজনও যদি এই কাজ করে, তবে এদের ভালো বা উন্নত জীবন যাপন করারও কোন অধিকার থাকা উচিত বলে আমার মনে হয় না।
এই দেশটায় সঠিকভাবে কি হয় আমার জানা নেই। চারিদিকে অসংখ্য মাথা, তবুও এদের নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা আছে বলে মনে হয় না। আর হ্যাঁ, এবার দেশে এসে বাটপার শ্রেনীর মানুষের দেখা পেয়েছি বেশ। পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম আমার ছেলের পাসপোর্টে "এন.ভি.আর" ভিসা নেয়ার জন্য। সি.এন.জি. থামতে না থাকতেই বাবার বয়সী দালাল টাইপের লোক এসে কথা বলা শুরু করে দিলো। ভাঁড়া চুঁকিয়ে একচোট তিরস্কার করতে হলো বিরক্ত করার জন্য। অবশেষে একজন পুলিশের কর্মকর্তা এসে আমাকে রক্ষা করলেন। পুলিশের ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছি আরেক মহিলা এসে হাজির, "স্যার, কি কাজ করবেন?" আমি বললাম "আপনার কি কাজ করে দিতে হবে বলেন. করে দিচ্ছি"।
মোবাইল দিয়ে ফেইসবুক আর ইউটিউব দেখলেই সেটাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ দাবী করা অনুচিত। সেটাই যদি বাস্তবতা হয় তবে গোল্লায় যাক সব। বাই দ্যা ওয়ে ডেসকোর এ্যাপ দিয়ে মোবাইলে বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি কারন এ্যাপ কাজ করছে না। সকালে কোথাও গিয়ে দিয়ে আসতে হবে আবারও! যত্তসব ফাইজলামি আর কি!
ছবি কপিরাইট: আমার তোলা
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১:৪৭