আমাদের রাষ্ট্রপতি মহোদয় জনাব ট্রাম্প আজ বিকেলেই সম্ভবত ৫০ টিরও বেশী দেশের আমদানীকৃত পণ্যের উপর নতুন শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনিও একটি তালিকাও প্রদর্শন করেছেন। হোয়াইট হাউসের এক্স একাউন্টের টুইটেও দেশগুলোর নাম, ঐসব দেশে আমদানিকৃত আমেরিকান পণ্যের উপর আরোপিত বর্তমান শুল্কের পরিমান ও আমেরিকায় আমাদানিকৃত ঐসব দেশের পণ্যের নতুন শুল্কের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ও তাদের ওয়েব সাইটে রাষ্ট্রপতি মহোদয় এ ব্যাপারে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, সময় নিয়ে পড়তে পারেন (সূত্র)।
ট্যারিফ / শুল্ক
পৃথিবীর সব দেশের সরকারই বিভিন্ন ধরনের আমদানিকৃত পণ্যের উপর কম-বেশী ট্যারিফ/শুল্ক নির্ধারণ করে থাকে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কোন দেশ থেকে আমাদানি করা হচ্ছে, কি ধরনের পণ্য আমদানি করা হচ্ছে, ঐ দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক অথবা ঐ দেশের সাথে আমদানিকৃত পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন চুক্তি আছে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সাধারণে এই শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। আমদানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক মূলত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায় (সরকারি/বেসরকারি) কিংবা ব্যক্তি দিয়ে থাকেন যা মূলত সরকারের কোষাগারে জমা হয়।
একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য। ধরুন জনাব রহিম একজন বাংলাদেশী যিনি আমেরিকার ডেল কম্পিউটার কোম্পানী থেকে একটি কম্পিউটার আমদানি করতে চাচ্ছেন বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য। আমেরিকায় কম্পিউটারটির বাজারমূল্য ধরুন ১০০ ডলার (আনুমানিক ১২,০০০ টাকা @ ১২০ টাকা = ১ ডলার রেট)। পণ্যটি ক্রয়ের পর তিনি সমুদ্রপথে পণ্যটি নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে যার জন্য শিপিং বাবদ তার খরচ হয়েছে ৫ ডলার। বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে আসার পর বাংলাদেশে শুল্ক বিভাগ জনাব রহিমকে ৭০ (আনুমানিক ৭০% শুল্ক) ডলার শুল্ক প্রদান করে পণ্যটি নিয়ে যেতে বলেছেন। জনাব রহিম ৭০ ডলার পরিশোধ করেন এবং পন্যটি খালাস করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে আসার জন্য আরো ২ ডলার পরিবহণ খরচ হিসেবে পরিশোধ করলে। পণ্যটি ক্রয় থেকে তার হাতে আসা পর্যন্ত তিনি সর্বমোট খরচ করলেন ১৭৭ ডলার বা (২১,৫৯৪ টাকা)। ধরে নিলাম সর্বসাকূল্যে সেটা ২২ হাজার টাকা। তিনি পণ্যটি ৫০০০ টাকা মুনাফায় বিক্রি করেছেন জনাব এক্স এর কাছে ২৭ হাজার টাকায় (উদাহরণ হিসেবে

লক্ষ্য করুণ, বাংলাদেশ সরকার শুল্ক হিসেবে জনাব রহিমের কাছ থেকে মূল দামের ৭০% শুল্ক আদায় করেছে। এই শুল্ক যদি মূল দামের ১০% হতো তবে জনাব রহিমের ক্রয় খরচ আরো কম হতো (১১৭ ডলার / ১৪,২৭৪ টাকা) ও ৫০০০ টাকায় মুনাফার বিক্রি করতে চাইলেও তিনি পণ্যটি ১৯ হাজার টাকায় বিক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু ৭০% ট্যারিফ বা শুল্ক থাকায় তার প্রকৃত ক্রয় মূল্য অনেক বেশী বেড়ে যাচ্ছে। যা হয়তো জনাব এক্স-কে অনুৎসাহিত করতো আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত কম্পিটার ক্রয় না করতে। দেশে থেকেই একই ক্ষমতার কম্পিউটার হয়তো ক্রয় করতে চাইতেন আরো কম দামে। যদি তিনি ক্রয় করেনও তার মানে দাঁড়ালো ট্যারিফ মূলত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ভোক্তা প্রদান করে থাকেন (এ ক্ষেত্রে জনাব এক্স)। পন্যের সার্বিক চাহিদা কম থাকলে অনেক সময় বিক্রেতাও (জনাব রহিম) ট্যারিফ বা খরচের কিছুটা নিজেও বহন করে বিক্রেতার কাছে ১৮৫০০ টাকায়ও বিক্রি করতে পারেন। মূলত এভাবেই ট্যারিফ বৃদ্ধি বা কমানো পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ভূমিকা রেখে থাকে ও বৈদেশিক পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত বা অনুৎসাহিত করে রাখার মতো ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশে ও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য
বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্টের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কখনোই আমেরিকার অনুকূলে (ফেভারেবল) ছিলো না। এই বাণিজ্যে বাংলাদেশ বরাবরই সুবিধা পেয়ে এসেছে বা একতরফাভাবে লাভ করেছে বা বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট থেকে আমদানির তুলনায় রপ্তানি অনেক বেশী করেছে। পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশই এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা করে লাভ করেছে। বাণিজ্যে আমেরিকার ঘাটতি অনেক বেশী। এটাকে আমি স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছি কারণ দু'দেশের অর্থনীতির আকার ও তাদের ভোক্তাদের মাঝে ক্রয় ক্ষমতার ব্যবধান অনেক বেশী ব্যাপক। তদুপরি মনে রাখতে হবে যে এই বাণিজ্য ঘাটতি আমেরিকার সার্বিক অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছে। অতীতে চীনও এভাবেই এক তরফা ব্যবসা করে আজকের অবস্থানে এসেছে, এ কথা স্বয়ং শি জিংপিং-ও অস্বীকার করতে পারবে না।
বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বর্তমানে প্রায় ৮.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের সরকারের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ সর্বমোট ১০.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে (এর মধ্যে কাপড়জাত পন্য সম্ভবত প্রায় ২ বিলিয়ন)। ২০২৩ সালের তুলনায় যা ১.১% বেশী। অন্যদিকে ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রপ্তানির পরিমাণ ছিলো ২.২ বিলিয়ন ডলার যা ২০২৩ সালের তুলনায় ১.৫% কমে এসেছে (সূত্র)। অন্যভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবসায় ঘাটতি/ব্যবধান আরো বেড়েছে। এটা মোটাদাগে কখনোই আমেরিকার জন্য অনুকূলে নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতির এই একই চিত্র বিশ্বের প্রায় সব দেশের সাথেই কম-বেশী রয়েছে। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন চাইছে এই ব্যবধান কমিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার প্রচেষ্টার একটি পন্থা হিসেবে সরকারি আয় আরও বাড়াতেই মূলত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কারণ দিন শেষে বাণিজ্য ঘাটতির জন্য মূল্য চুকাতে হবে আমেরিকার জনগণকেই।
দ্বিতীয় পন্থা হিসেবে আমেরিকার রপ্তানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই তাদের দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রবেশে বাধা সৃষ্টির জন্য অনেক আগে থেকেই বিশাল শুল্ক আরোপ করে রেখেছে। যেমন উপরে উল্লেখিত জনাব রহিমের উদাহরণটি ধরে নিতে পারেন। এর পেছনেও অনেক কারণ রয়েছে। যেমন পৃথিবীর সব দেশই চাইবে নিজ দেশের ব্যবসায়গুলো যেন তুলনামূলক প্রতিযোগীতায় না পড়ে কারন বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো উৎপাদন ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই বেশী। তাদের পন্য বাংলাদেশে অবাধে প্রবেশ করতে দিলে বাংলাদেশের বাজারে স্থানীয় ব্যবসায়গুলো বাণিজ্য হারাবে। এ ধরনের রক্ষণশীল নীতি বেশ স্বাভাবিক বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট সমস্যা হিসেবে আর্বিভাব হতে পারে।
কিছু ভাবনা
মোটাদাগে বলতে গেলে আমেরিকা থেকে অতীব প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া খুব বেশী পণ্য আমদানি করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা সেটা বেশ ভালোই জানেন বলে আমি মনে করি। যেমন আমরা স্বাভাবিক সময়ে এক ডজন ডিম ৩ ডলারের মতো দামেও ক্রয় করেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক একটা সমস্যার কারণে ডিমের দাম আমেরিকায় বেশ বেড়ে গিয়েছে। রোজার সময় কিছুদিন আগেও আমি এক ডজন ডিম ক্রয় করেছি ৯ ডলারের বেশী দিয়ে। কারণ ডিমতো খেতে হবে। কিন্তু ভাবুন তো সেটা বাংলাদেশের সকল সাধারণ মানুষের পক্ষে কি সম্ভব হবে? ক্রয় ক্ষমতা থাকলে আপনি ১০ ডলারেও এক ডজন ডিম খাবেন আর এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ মূলত যেসব পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, সেগুলো অনেকটাই নিত্য প্রয়োজনীয়। কাপড়-চোপড়তো বটেই। যুক্তরাষ্ট্রের একজন ক্রেতা একটা টি-শার্ট এর দাম ২/৩ ডলার বাড়লেও ক্রয় করার ক্ষমতা রাখে তাই আমার ব্যক্তিগত ধারনা ট্রাম্প-এর আরোপিত নতুন শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানিতে কিছুটা নেতিবাচক ভূমিকা রাখলেও মোটাদাগে খুব বেশী আহামরি কোন সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না। যদিও সেটা সময়ই ভালো বলতে পারবে, আমরা শুধু অনুমান করতে পারি কিছুটা। তাই এটা নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে বলেও আমি মনে করি না। তবে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে যদি অন্য কোন প্রতিযোগী রাষ্ট্র প্রতিযোগীতামূলক দামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেকেও ছাড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম বা আফ্রিকার কিছু দেশও থাকতে পারে তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আরো কিছুটা সতর্ক হতে হবে অবশ্যই।
আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন, ক'দিন আগেই বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকতা এসে বাংলাদেশের আর্মি প্রধানের সাথে দেখা করে গেছেন। বাংলাদেশের আর্মির সাথে ইউ.এস. আর্মির একটি সামরিক মহড়া/এক্সারসাইজ ক'দিন পরেই দেখতে পাবেন। এটিকে আপনি সামরিক সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি সামরিক পণ্য প্রদর্শন তথা রপ্তানির একটি পন্থা বলেই মনে করি। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশকে তাদের সামরিক সরঞ্জান ক্রয়ের ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই একই পন্থা অবলম্বন করে বিগত ট্রাম্প প্রশাসনের সময়েও আমেরিকা সৌদি আরবের কাছে বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলারের সরঞ্জাম বিক্রি করেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর এটা একটা বড় হাতিয়ার কোন সন্দেহ নেই। হাসিনার সময়ও এ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তবে সেটা শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি মূলত রাশিয়া, চীন ও ভারতের কারনে।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীয় আধুনিকায়নের বিশাল প্রজেক্ট থাকলেও সেটা বিলম্বিত হচ্ছে বহুদিন ধরেই। মাঝে টুকটাক কিছু সরঞ্জাম ক্রয় করা হলেও মোটাদাগে বড় ধরনের কোন কেনাকাটা হয় নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতে এবং বিদ্যমান সঙ্কট মাথায় রেখে ওদিকটায় কিছুটা নজর দিলে আমেরিকায় সাথে সম্পর্কের শীতলতা কিছুটা হলেও প্রশমন সম্ভব, অন্তত ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই জরুরী। তার প্রশাসন যাত্রা শুরু করেছে বেশীদিন হয়নি, আরো চার বছর এই প্রশাসনকে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে।
পাশাপাশি বাংলাদেশী পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি তথা এক্সপ্লোর করার বিকল্প নেই। সেদিক থেকে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য যেমন ওষুধ, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, মোটরসাইকেল ইত্যাদির জন্য আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার বাজার বিশ্লেষণ জরুরী। সেই সাথে দেশে প্রযুক্তি সম্পর্কিত দক্ষ জনবল গড়ার দিকে আরো বেশী মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। রপ্তানি শুধু পণ্য নয়, সেবা দিয়ে করা সম্ভব আর সে দিকটায় দৃষ্টিপাত করলে আমাদের বিশাল যে জনসম্পদ রয়েছে তার সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য তেমন ভীত হওয়ার কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।
নোট: আমি কোন অর্থনীতিবিদ নই। উপরে উল্লেখিত বিষয়বস্তু ও তথ্য নিতান্তই ব্যক্তিগত চিন্তা ও আর্ন্তজালে বিভিন্ন তথ্যের সূত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা। কোন ভুল দৃষ্টিগোচর হলে মন্তব্যের ঘরে সূত্রসহ জানাতে পারেন।
ছবি কপিরাইট: নিউজউইক