somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“ও মন সুয়া রে একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি”

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুফি সাধক আরকুম শাহ্‌’র অসাধারণ একটা গান “সোনার পিঞ্জিরা”র একটা লাইন উপরের কথা গুলো। খুব সাধারণ সাবলীল কিছু কথা। না বুঝতে পারার মতন কিছু নেই। তারপরেও কেন জানি কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

গানটার পিছনে একটা ছোট গল্প আছে। একবার বলেছিলাম, প্রতিটা গান শুধু বাউল গান নয় সকল গানের পিছেই কিছু সুন্দর গল্প থাকে। সেইরকমই এইটার পিছনেও ছোট একটা গল্প আছে। বাউল তত্ত্ব অনুযায়ী সকল বাউলেরই মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক থাকেন। সেইরকমই আরকুম শাহ্‌’র মুর্শিদ ছিলেন শাহ্‌ আব্দুল লতিফ (রহঃ)। তার মৃত্যুর পর আত্মোপলব্ধি থেকে লেখা এই গান। নশ্বর দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য না তাই বুঝানোর চেষ্টা ছিল পুরো গান জুড়েই।




কিছু লেখার আগে মনেহয় আরকুম শাহ্‌ সম্পর্কে কিছু বলে নেয়া উচিৎ। অন্যান্য বাউলদের তুলনায় তার নাম খুব কমই শোনা যায় আসলে। এর কারণ অনেকেই তার কিছু গানকে বাউল সম্রাট শাহ্‌ আব্দুল করিম এর গান বলে ভুল করেন। অস্বাভাবিকতার কিছুই নেই। কারণ আমাদের নিজেদের সম্পদ এই বাউল গান গুলোর সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি জ্ঞান নেই। প্রখ্যাত এই বাউল কবি ও শিল্পী ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট জেলার দক্ষিণ ধার খিত্তা পরগণার ধরাধরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকে তিনি বাউল দর্শনে অনুপ্রাণিত হন। তিনি শাহ আবদুল লতিফ নামক একজন পীরের কাছে দীক্ষা নেন। কথিত আছে এই পীরের কাছে তিনি বাতেনি-মারাফতের জ্ঞান লাভ করেছিলেন।তবে বাউল গানের পাশাপাশি অন্যান্য নানা ধরনের গান রচনা করে সিলেট অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর একমাত্র গানের সংকলন 'হকিকতে সিতারা' প্রকাশিত হয়।১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রতি বছর হযরত আরকুম আলী'র ভক্তেরা দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামে তাঁর মাজারে সমবেত হয়। প্রতি বছরই ওরশ পালিত হয়। তার সবচেয়ে পরিচিত গান বোধহয় “কৃষ্ণ আইলা রাঁধার কুঞ্জে ফুলে বাইলা ভ্রমরা” নির্মল প্রেমের গান ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও অনেকেরই ধারণা এই গান বাউল সম্রাট শাহ্‌ আব্দুল করিমের লেখা। আমার নিজেরও এই ধারণা ছিল যখনহাবীব ওয়াহিদের প্রথম এলবাম “কৃষ্ণ” শুনি। তারও অনেক পরে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে ধারণা বদলায় আমার।

“সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলা খালি রে
হায়রে আমার যতনের পাখি
ও মন সুয়া রে একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি

আজ্ঞা মতে এই দেহাতে করলায় পরবাস
এহন মোরে ছাইড়া গেলায় করিয়া নৈরাশ রে
হায়রে আমার যতনের পাখি

যেই কৌটায় থাকিয়া পাখি সদায় কর খেলা
সেই কৌটারই মাঝে এখন লাইগা গেছে তালা রে
হায়রে আমার যতনের পাখি

ফকির আরকুম শাহ্‌ কইন মিছা ঘর আর বাড়ি
সুয়া পাখি উইড়া গেলে পিঞ্জিরা রয় পরি রে
হায়রে আমার যতনের পাখি”

- ফকির সুফি সাধক আরকুম শাহ্‌




এই গানটা দেহতত্ত্ব কেন্দ্রিক গান গুলোর একটি। খুব সাধার সাবলীল ভাবে কিছু সত্য কথা বলার প্রচেষ্টা যাতে সম্পূর্ণরূপে সফল বাউল আরকুম শাহ্‌। “সুয়া” বলতে আসলে মানবাত্মা কে বুঝানো হয়েছে। আত্মা দেহত্যাগ করলে তার ফেরত আসার রাস্তা আসলে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপারটা কিছুটা “ওয়ান ওয়ে” রাস্তার মতন। এক দিক দিয়ে বের হয়ে গেলে কখনোই ওই রাস্তায় অন্য দিক দিয়ে প্রবেশ সম্ভব নয়(যদিও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নয়)। তাই আত্মার সাথে দেহের নিগুড় সম্পর্ক আসলে অবিচ্ছেদ্য নয়। সৃষ্টি কর্তার আজ্ঞায় অর্থাৎ নির্দেশেই এই আত্মার পরবাসী জীবন যাপন দেহ নামক খাঁচা বা পিঞ্জিরায়।
“আজ্ঞা মতে এই দেহাতে করলায় পরবাস
এহন মোরে ছাইড়া গেলায় করিয়া নৈরাশ রে”
তাই তো যতই আশায় দেহটা আত্মাকে আটকে রাখতে চাক না কেন তাকে শেষকালে নিরাশই হতে হয়, কারণ আত্মা পরিশেষে তাকে নিরাশই করবে অন্য কেউ যে কলকাঠি নাড়ছেন।

পরের অংশে,
“যেই কৌটায় থাকিয়া পাখি সদায় কর খেলা
সেই কৌটারই মাঝে এখন লাইগা গেছে তালা রে”


সেই একই কথা আবারো ভিন্নরূপে। কৌটা, খাঁচা সব কিছু এই মানব দেহের রূপক। দেহের ভিতরে থেকেই আত্মার পরবাসী জীবনযাপন। যাকে খেলা হসেবে দেখানো। কিন্তু একবার যখন আত্মা দেহ ত্যাগ করে তার জন্যে সেই দেহে ফেরত আসার সকল রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এইখানে আরকুম শাহ্‌’র ও আগের প্রজন্মের আরেক বাউল শিতালং শাহ্‌’র একটা খুব পরিচিত গানের কথা বলার ইচ্ছা দমন করতে পারতেছিনা।
“তুমি নিজ দেশে যাইবায় পাখি ফুরিলে মেয়াদ
তোমার পিঞ্জিরা যে রইবে খালি হইয়া বর্বাদ” – শীতালং শাহ্‌

একই রকমের কথা প্রায়, যার মাধ্যমে একই কথা বুঝানোর চেষ্টা।


শেষাংশে-
“ফকির আরকুম শাহ্‌ কইন মিছা ঘর আর বাড়ি
সুয়া পাখি উইড়া গেলে পিঞ্জিরা রয় পরি রে”


অর্থাৎ ঘর বাড়ি সকল কিছুরই কোন মূল্য থাকে না যদি দেহের ভিতরের আত্মা দেহকে ত্যাগ করে। দেহের কোন মূল্য অবশিষ্ট্য থাকেনা আসলে তখন। দেহের মূল্যবান ঠিক ততক্ষনই যতক্ষণ তাতে আত্মার বাস। তার পরে সে নিথর।

শিতালং শাহ্‌’র “সুয়া উড়িল” গানটার সাথে বার বার মিলিয়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছে এই গানটাকে। প্রতিটা কথা আর বিশ্লেষণে অসাধারণ মিল এই দুই গানের।
“পিঞ্জিয়ার বসিয়া করলা প্রেমেরও সাধন
পিঞ্জিরিয়া ছাড়িয়া যাইতে না লাগে বেদন”


দুইজনেরই জিজ্ঞাসা একটিই মানবাত্মার কাছে। এই দেহের সাথে বসবাস করার পরেও কি দেহের সাথে আত্মার কোন প্রেমের সম্পর্কই সৃষ্টি হয়না? অন্তত যেই সম্পর্কের হাত ধরে হলেও দেহকে ছেড়ে না যাওয়ার চেষ্ঠা করতে পারে সে? শেষ পর্যন্ত এই খানে এসেই থমকে গেলাম আমি নিজেই। আসলেই কি আত্মার এই দেহের সাথে কোন সম্পর্কই হয় না যে দেহকে ছেড়ে চলে যায় যখন তখন তার ইচ্ছায়? এর পরে আসলে আর কোন কিছুই মাথায় আসতেছেও না মাথা থেকে বেরও হচ্ছে না আপাতত।

কিছুক্ষন এই ঘোরের ভিতরে কাটবে হয়তো।




সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:১৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×