১৯শে অক্টোবর ২০১৪ইং তারিখে সিলেটে একটা ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড ভ্রমণের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের গাড়ি ছাড়া হল ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে। পথে তখনও কর্মব্যস্ততা শুরু হয়নি। পথের ধারের চিরচেনা গ্রামবাংলার আবহমান দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলি। “শ্রীমঙ্গলের পথে” চলতে চলতে আমরা যখন লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে পৌছাই তখন ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। “লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ” শেষে আমরা পৌছাই মাধবপুর লেকে। কিছুটা সময় “মাধবপুর লেক ভ্রমণ” শেষে আমারা যাই মাধবকুণ্ড ঝর্ণা দেখতে। “মাধবকুণ্ড ঝর্ণা ভ্রমণ” শেষ করতে গিয়ে দেখি তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে, তাই এবার আমাদের গন্তব্য সিলেট।
ঝর্ণা দেখে রওনা হওয়ার পরে সব কিছু ভালই চলছিল, তবে গ্যাস শেষ হয়ে আসছে। চারদিকে সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে গেছে আরও আগেই। আশা করছি সমনেই গ্যাস পেয়ে যাব, আর না পেলেও সমস্যা নাই ১০ লিটার অকটেন নেয়া আছে রিজার্ভ হিসাবে। সামনেই একটা CNG স্টেশন পেলাম কিন্তু সেখানে প্রেশার কম বলে আবার চলতে শুরু করলাম। একটু পরেই আরেকটি পেয়ে গেলাম, সেখানে গ্যাস নেয়া হল ফুল করে, সেই ফাকে আমরাও কিছু হালকা নাস্তা করে নিলাম ফুচকা আর চটপটি দিয়ে। আবার শুরু হল চলা, চার ধার ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ করে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলো।
অবশ্য সাথে সাথেই আবার চালু হয়ে গেলো। কিছুদূর গিয়ে আবার একই অবস্থা। গতকাল গাড়ি গ্যারেজ থেকে ফুল চেকাপ করানো হয়েছে কোন সমস্যা নেই। আজকে সারা দিন গাড়ি ঠিকই চলল এখন রাতের আঁধারে এটা কি শুরু হল! এরপর গাড়ি এমন এক যায়গায় গিয়ে থামল যে আশপাশে কিছু নেই, চার ধার অন্ধকার। গাড়ি থেকে নেমে বুঝতে পরলাম বাইরে বেশ একটু ঠাণ্ডাও পরেছে। ইঞ্জিনে কিছু গুঁতাগুঁতি করে আবার চলা শুরু করলাম, কিছুদূর গিয়ে আবার থেমে গেল। সমনেই একটা পেট্রোল পাম্প দেখে বললাম এটার ভেতরে আলোর নিচে গিয়ে ভাল করে চেক করতে। চেক করে কোন সমস্যাই পাওয়া গেল না। এভাবে থামতে-থামতে চলতে-চলতে একটা গ্যারেজ পেলাম। সব শুনে মেকানিক বলল গ্যাস-কিট ঠাণ্ডা হয়ে গেছে গরম পানি ঢালতে হবে। কিছু দুরে গিয়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামালাম। দোকানি চাচা মিয়াকে বললাম আমাদের গরম পানি লাগবে, চাচা মিয়ার কাছে গরম পানি নাই, চায়ের গরম লিকার আছে। সেই গরম লিকার দুই মগ ঢাললাম গ্যাস কিটের উপরে। টাকা দিতে গেলে পরে চাচা মিয়া বলল লাগবে না। শহরের কোন দোকান হলে এটা আশা করা যেত না। বারবার সাধার পরেও চাচা মিয়া টাকা নিতে রাজি হল না। কিছু বিস্কিট-চিপস কিনে আবার শুরু হল আমাদের পথ চলা। এরপরে একবার মাত্র সমস্যা হয়ে ছিল সিলেট পর্যন্ত পৌছতে।
এর মধ্যে সালেহ ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম কোথায় থাকলে ভালো হবে জানান জন্য, সালেহ ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী হোটেল ডালাসে উঠেছিলাম। প্রতি রুম ১০০০ টাকা ভাড়ায় চারটা রুম নিয়েছিলাম। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের জন্য নিচে নেমে একজনকে জিজ্ঞাস করে জেনে নিলাম সামনেই আছে পালকি রেস্টুরেন্ট হাঁটা দূরত্বে। রাতের খাবার শেষে ফিরে এলাম হোটেলে। বসিরের হঠাৎ করেই জ্বর এসে পড়ায় ও খেতে যায়নি। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ওকে ছাড়া আমি আর ইস্রাফিল রাত্রিকালীন আড্ডায় বসি স্বপনের রুমে। অনেকটা রাত পর্যন্ত আড্ডা শেষে ঘুমতে যাই।
পরদিন ২০/১০/২০১৪ ইং তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বসির সুস্থ হয়ে গেছে, তবে গোসল করার পরে আবার কিছুটা শরীর গরম হয়েছে। যাইহোক এই সমস্ত কারণে কিছুটা দেড়িতে সকালের নাস্তা করতে গেলাম আবারও পালকিতে। দাম কিছুটা চড়া হলেও এখানকার খাবার বেশ ভালো। ঢাকার বাবুর্চি নাকি এখানে রান্না করে! গতকাল রাতেই খেয়েছি এখানে। কিছুটা ওপেন কিচেন টাইপ। একই সাথে এদের আছে আর কয়েকটি সার্ভিস।
(পালকিতে সকালের নাস্তার শেষাংশ)
(পালকিতে নাস্তা শেষে হযরত শাহ জালালের দরগায় যাওয়ার প্রস্তুতি)
সকালের নাস্তা সেরে পরবর্তী গন্তব্যে হাজির হলাম হযরত শাহ জালালের দরগায়। তখন সময় প্রায় ১২টা বাজে। সিলেট বেরাতে এলে মামা ভাগিনার দুটি মাজারে সকলেই হাজিরা দিয়ে যায়, আমরাও ব্যতিক্রম নই। মামা ভাগিনার কাহিনী সকলেরই জানা, আর জানা এখানকার গজার ও সোনা রূপার কৈ মাছের কথাও। আর আছে বিখ্যাত সেই জালালি কবুতর। দরগা রোডের দুপাশে আছে সারি সারি দোকান, বিক্রি হচ্ছে নানান ধরনের জিনিস। তসবি থেকে হালুয়া, মিনারেল ওয়াটার থেকে কোরআন, সবই পাওয়া যায় এই দোকান গুলিতে।
(হোটেল ডালাস > পালকি রেস্তরা > হযরত শাহ জালালের দরগায় গুগল ম্যাপে)
(বাইরে থেকে হযরত শাহ জালালের দরগায় গেইট)
(ভিতর থেকে হযরত শাহ জালালের দরগায় গেইট)
মাজারে কোন মানত-মানতি বা অন্য কিছু না, শুধুই সিলেট এসেছি তাই মাজারে জিয়ারত করে যাচ্ছি। বড় তোড়ন পেরিয়ে ঢুকতে হয় মাজার চত্বরে।
দরগায় প্রবেশ তোড়নের ডান দিকে ছোট্ট একটা চৌক স্থান বেড়া দিয়ে আলাদা করা আছে কবুতরের খাবার দেয়ার জন্য, ধান কিনে খেতে দিচ্ছে অনেকেই।
এরাই হচ্ছে সেই বিখ্যাত জালালী কবুতর। হযরত শাহ জালাল যখন ইসলাম প্রচার করতে সুদূর ইয়েমেন থেকে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দিল্লীতে পৌঁছান, তখন দিল্লীর বিখ্যাত ওলী-আল্লাহ হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়ার সাথে দেখা হয়। সেখান থেকে বিদায়ের সময় হযরত শাহ জালাল (রঃ) উপহার হিসেবে নীল এবং কালো রংয়ের এক জোড়া কবুতর পান। তিনি কবুতর দুটোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন সিলেটে। আর সিলেট জয় করে জয়ের প্রতীকস্বরূপ কবুতর দুটোকে উড়িয়ে দেন। সেই কবুতরের বংশই আজকের জালালী কবুতর হিসেবে পরিচিত।
এর ডানদিকে আছে তিনটি বড় সাইজের পিতলের পাতিল, অনেকেই টাকা ফেলে এখানে। তাই দেখে সাইয়ারাও এগিয়ে যায় টাকা ফেলতে। পাতিল গুলির মুখ লোহার খাঁচা দিয়ে ঢাকা। এই পাতিলগুলিতে কখনোই কিছু রান্না করা হয় নি। এগুলি ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছিলেন। কথিত আছে প্রতিটি পাতিলে সাতটি গরু ও সাত মন চাল এক সাথে রান্না করা যায়। অথচ পালিত গুলি দেখে কিন্তু তা মনে হয় না। কোন ভাবেই সেটা সম্ভব না।
এর ডান দিকে অর্থাৎ মাজারের গেট দিয়ে ঢুকে সামনের অজু খানার ডান দিকে আছে পুরনো একটি পুকুর। এই পুকুরে আছে বিশাল সাইজের শত শত গজার মাছ। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ দিয়ে পুকুরের প্রায় ৭০০ গজার মাছ হত্যা করা হয়। ফল পুকুরটি গজার মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছ গুলিকে মসজিদের পশ্চিম দিকের কবরস্থানে মাটি চাপা দেয়া হয়। পরে আবার পুকুরটি নতুন করে পরিষ্কার করে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি হযরত শাহজালাল(রঃ) এর অপর সফর সঙ্গী মৗলভীবাজারের মোস্তফার মাজার থেকে ২৪ টি গজার মাছ এনে ছাড়া হয়। সেগুলি এখন সংখ্যায় অনেক হয়ে গেছে। এখানে ১০ টাকায় এক বাটি ছোটমাছ পাওয়া যায় গজারকে খাওয়ানোর জন্য।
গজার মাছ গুলি সম্পর্কে তিনটি মিথ আমি শুনেছি। একটি হচ্ছে হযরত শাহ জালাল কিছু দুষ্ট জীনদের অবাধ্যতার শাস্তি স্বরূপ গজার মাছ করে রাখা হয়েছে। অপরটি হচ্ছে একদিন হযরত শাহ জালাল পথ চলতে গিয়ে কিছু গজারের পোনা পান। সেগুলিকে এনে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে বলেন হত্যা না করতে। শেষটি হচ্ছে হযরত শাহ জালাল এর সেনাপতি বড়শি দিয়ে সুরমা নদী থেকে গজার মাছ ধরছিল বলে গজার মাছগুলি এসে হযরত শাহ জালালের কাছে নালিশ করলে তিনি গজার গুলিকে পুকুরে এসে থাকতে বলেন।
পুকুরের সামনে বামদিকে দিয়ে একটি রাস্তা গেছে। এই রাস্তা দিয়ে কবরস্থানের পশ্চিম পাশে আছে সোনা রূপার কৈ মাছের কুপ। আগে এটি খোলা অবস্থায় থাকলেও এখন আরেকটি মাজারের মত করে কুপটিকে বাধিয়ে ফেলা হয়েছে, কুপের উপরে কাচ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও কোন মাছের দেখা পেলাম না সেখানে।
দরগায় প্রবেশ তোড়নে ভিতরে খোলা চত্বরে বাম দিকে আছে সুন্দর করে ছেঁটে রাখা কয়েকটা খেজুর গাছ, তার সামনেই মসজিদ। মসজিদের ডান দিক দিয়ে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই ডান দিকে টিলার উপরে মাজার। মাজার আর মসজিদের পরেই এখানে আছে বেশ বড় একটা কবরস্থান।
(মসজিদের ডানপাশের এই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় মাজারে)
(হযরত শাহ জালালের মাজার)
আগামী পর্বে দেখা হবে বিছানাকান্দিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১:১৮