somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মন্দির দর্শন : ০০১ : শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম

০৫ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
"রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও, আমিই রক্ষা করিব।"


নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী বাজারের পশ্চিম-উত্তর কোণে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম অবস্থিত। ঢাকা থেকে ঢাকা-চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক পথ ধরে গিয়ে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।

শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী ১১৩৭ বাংলা সালের ভাদ্র মাসে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাঠের চৌরাশি চাকলার অন্তর্গত কচুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের ৪র্থ পুত্র। তার বাবা রামনারায়ণ ঘোষাল ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যাক্তি এবং গুপ্তসাধক। তার বাসনা ছিলো একজন সন্তানকে ব্রহ্মচারী করবেন। ১১ বছর বয়সে উপনয়নের জন্য লোকনাথ এবং তার বন্ধু বেণীমাধব চক্রবর্তী আচার্য গাঙ্গুলীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। ১১৪৮ সনে আচার্য গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে আসেন কালীঘাটের শক্তিপীঠে। সাধন-ভজন শিক্ষার জন্য দুজনে দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর নক্ত-ব্রত (দিনে অনাহারী থেকে রাত্রে আহার) ধারণ করেন। এরপর একান্তরা-ব্রত (একদিন উপবাসের পর দিন আহার), ত্রিরাত্রি, পঞ্চহ, নবরাত্রি ব্রত পালন করে করেন। আচার্য গাঙ্গুলী তাদের ধ্যান ও যোগ শিক্ষা দেন। এরপর সিদ্ধলাভের জন্য তারা হিমালয়ের বরফাবৃত এক নির্জন স্থানে ‍উপস্থিত হলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় কঠিন তপস্যা দ্বারা লোকনাথ সমাধির উচ্চতম শিখরে পৌছান এবং পরমতত্ত্ব লাভ করেন। তখন তার বয়স ৯০ বছর।

শিষ্যদের সিদ্ধি লাভের পর ভগবান গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে মক্কা দর্শনে বের হন। মক্কায় কয়েকদিন অবস্থানের পর তাঁরা বারাণসীর কাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখান থেকে পরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তারা ভারতের পশ্চিমে আফগানিস্তান, আরব, ইসরায়েল, পারস্য, ইউরোপ ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন। পরে উলটো পথে তারা হেঁটে হেঁটে সাইবেরিয়াতে চলে আসেন। এরপর পূর্ব দিকে গমন করে চীন দেশে উপস্থিত হন। শেষে লোকনাথ ও বেণীমাধব তিব্বত ও বদ্রীনাথ পাহাড়ে অবস্থান করলেন। তারপর বেণীমাধব কামাখ্যার উদ্দেশ্যে চলে যান এবং লোকনাথ চলেন চন্দ্রনাথ পহাড় সংলগ্ন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।

এরপর লোকনাথ ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে আসেন। বারদী গ্রামের ডেঙ্গু কর্মকার নামে এক ব্যাক্তি সেসময় ফৌজদারী মামলার আসামি হয়ে দাউদকান্দিতে ছিল। উদভ্রান্ত ডেঙ্গু কর্মকার লোকনাথকে দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। তখন লোকনাথ তাকে নির্ভয়ে থাকতে বলেন। পরদিন বিচারপতি ডেঙ্গুকে বেকসুর খালাস রায়ে দেন। লোকনাথকে ডেঙ্গু তার বাড়িতে নিয়ে আসেন।

ডেঙ্গুর মৃত্যুর পর বারদ্রীর জমিদার তাকে নিয়ে আসেন জমিদার বাড়িতে। জমিদার তাকে ‘ছাওয়াল বাঘিনী’ নদীর তীরে একটি নিষ্কর শ্মশানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দেন। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর তিনি সেখানে অবস্থান করেন। সে সময় থেকেই “বারদী’র ব্রহ্মচারী” হিসেবে লোকনাথ পরিচিতি পান।

এরপর ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ বঙ্গাব্দে(১ জুন ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি তার দেহত্যাগের ঘোষণা দেন। ঠিক সেই দিনে ১১টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রমে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এসময় তার বয়স ছিল ১৬০ বছর।

তার এই মহাকাল প্রয়াণের দিনটিকে ভক্তি এবং শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে স্মরণ করার জন্যই প্রতি বছর ১৯ জ্যৈষ্ঠ আশ্রমে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান উৎসব ও মেলার আয়োজন হয়। জৈষ্ঠ্যের ১৯ তারিখ আশ্রমের চৌচালা ছাদের উপর থেকে ভক্তদের ছুঁড়ে দেয়া বাতাসা ও মিষ্টান্ন কুড়ানোর “হরি লুট” উৎসব হয়। দিন ব্যাপী চলে গীতা পাঠ, বাল্যভোগ, লোকনাথের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ, রাজভোগ, প্রসাদ বিতরণ, আরতি কীর্তন ইত্যাদি। আশ্রমের বাইরে বিশাল সবুজ মাঠে বসে মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে হাজারও পণ্য এবং নানান ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে। এই মেলা চলে একটানা এক সপ্তাহ।

এছাড়াও এই আশ্রমের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের নাম “রাখের উপবাস”। প্রতিবছর কার্তিকের ১৫ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এই ব্রত অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।




































আশ্রমে প্রবশের করলেই দক্ষিণের উঠানে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সমাধিস্থল। আশ্রমের ভেতরে আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিশাল তৈলচিত্র। শোনা যায় ভাওয়ালের রাজা রায়বাহাদুর রাজেন্দ্র নারায়ণ লোকনাথের অনুমতি নিয়ে তার একটি ছবি তোলেন। সেটিই লোকনাথের একমাত্র ছবি। সেই ছবিটি থেকেই অন্য ছবি গুলি তৈরি করা হয়েছে। আশ্রমের পেছনে পাঁচতলা ভবনের যাত্রীনিবাস। ভক্ত ও দর্শণার্থীরা বিনা পয়সায় এখানে রাত্রিযাপন করেন। এখানে অতিথি শালা, ধর্মশালা, অফিসকক্ষ, বিক্রয় কেন্দ্র, গোশালা, রন্ধনশালা, পূজামণ্ডপ ইত্যাদি রয়েছে। পাশেই রয়েছে বারদী দৃষ্টি নন্দন মহাশ্মশান । লোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবিত থাকা অবস্থায় আশ্রমের পাশে কামনা সাগর ও জিয়স নামে পুকুর খনন করা হয়। এই পুকুরটিতে আশ্রমে আগত ভক্তরা স্নান করেন। কামনা সাগর পুকুরের মাঝখানে আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত হয়েছে শিব মূর্তি।













ছবি তোলার তারিখ : ২৮/১০/২০১৬ ইং
অবস্থান : বারদী বাজার, সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।
GPS coordinates : 23°47'22.0"N 90°39'35.4"E
গুগল ম্যাপ : https://goo.gl/maps/CrKZpmEhP45aGkir6
তথ্য সূত্র : বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, অন্তর্জাল।
ছবি ও বর্ণনা : নিজ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৫
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×