somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

|| ইসলামি সভ্যতায় রকেট আবিস্কারের ইতিহাস ||

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ মায়ারেফুল কোরআনে উল্লখ করেছেন,"অধুনা সোভিয়েত মার্কিন বিজ্ঞানীরা প্রাচীন মুসলিম দার্শনিক
আবু রায়হান আল-বিরুনির গবেষণার সাহায্যে রকেট আবিস্কার করেন ।"
তবে শুধু আল-বিরুনিই নন, তিনি ছাড়াও আরো কতিপয় মুসলিম বিজ্ঞানী রকেট আবিস্কার করেন এবং স্বীয় কিতাব সমূহে তা নির্মাণের পদ্ধতি বর্ণনা করেন।
মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মৌলিক আবিস্কারসমূহের
প্রায় সকল কিছুই ইসলামি সভ্যতার বিজ্ঞানীগণ
উদ্ভাবন করেছিলেন । এসব আবিষ্কার ও গবেষণার কাজে তারা প্রচুর পরিমাণ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও
সহযোগিতা পেয়েছিলেন ।
মিশরীয় বিজ্ঞানী হাসান আল-রাম্মাহ তাঁর লিখিত "আল-ফুরুসিয়া ওয়াল মানাসিব উল হারাবিয়া" গ্রন্থে ১২৭০ সালে ২২ টি স্তরে রকেট নির্মাণের পদ্ধতি বর্ণনা করেন । এছাড়াও তিনি তাঁর এই গ্রন্থে ১০৭ প্রকারের বারুদের বর্ণনা দেন । আধুনিক কালে বারুদ তৈরির জন্য ৭৫ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেড, ১০ শতাংশ সালফার এবং ১৫ শতাংশ কার্বন ব্যবহার করা হয় । আল-রাম্মাহ ৭৫% পটাশিয়াম নাইট্রেড, ৯.০৬% সালফার এবং ১৫.৯৪% কার্বন ব্যবহার করে বারুদ দৈরি করেন যা আধুনিক বারুদ তৈরির অনুপাতের সঙ্গে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ । পঞ্চদশ শতকে আরবরা রকেট ও টর্পেডো দুটোই আবিস্কার করেন।
শুধু মিশরীয় মুসলিমরাই নয়, উসমানি খিলাফতের বিজ্ঞানীরাও রকেট নির্মাণে কাজ করেছিলেন।
লাগারি হাসান চেলেবি ছিলেন একজন উসমানীয় বৈমানিক । পর্যটক এভলিয়া চেলেবির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সফলভাবে একটি রকেট উৎক্ষেপণ করেছিলেন।
এভলিয়া চেলেবি বর্ণনা করেছেন যে ১৬৩৩ সালে লাগারি হাসান চেলেবি ১৪০ পাউন্ড বারুদ ব্যবহার করে একটি ৭ পাখাবিশিষ্ট রকেট উৎক্ষেপণ করেছিলেন । বলা হয় যে সুলতান চতুর্থ মুরাদের কন্যার জন্মের সময় এই উৎক্ষেপণটি সংঘটিত হয়েছিলো ।
উসমানীয়দের পরে ভারতীয় মুসলিমদের রকেট
নির্মাণের রেকর্ড রয়েছে ইতিহাসের পাতায় । মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতান যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য শক্তিশালী রকেট আবিস্কার করেছিলেন। হায়দার আলীর সময় থেকেই মহিশুরের সেনাবাহিনীতে রকেট প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছিলো । তারপর সেটির উত্তরাধিকারী হন হায়দার আলীর পুত্র টিপু সুলতান ।
টিপু সুলতানের হাত ধরে রকেট প্রযুক্তি এক অন্য মাত্রা পেয়েছিলো । হায়দার আলীর সময় থেকেই মহীশুরের সেনাবাহিনীতে প্রায় ১২০০ রকেট-সৈনিক থাকতো। ১৭৮০ সালের পল্লীলুরের যুদ্ধে হায়দার আলীর সেনাবাহিনীর কাছে ব্রিটিশদের শোচনীয় পরাজয়ের পেছনেও ছিলো রকেটের অবদান। এ যুদ্ধে রকেট হামলার ফলে ইংরেজদের অস্ত্রাগারে আগুন ধরে যায়। আর এটিই ডেকে আনে তাদের পরাজয়।
টিপু সুলতানের আমলে মহীশুরকে মুখোমুখি হতে হয় আরো শক্তিশালী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে। প্রজ্ঞাবান টিপু বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের সাথে টিকে থাকতে নতুন কিছু উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। এ তাড়না থেকেই রকেট উন্নয়ন নিয়ে তাদের গবেষণায় জোর দেন তিনি। মহীশুরে রকেট প্রযুক্তিতে সবচেয়ে বড়ো যেই পরিবর্তনটি আনা হয় তা হলো রকেটের জ্বালানী কক্ষ হিসেবে লোহার তৈরি বাক্স ব্যবহার। আগে এর জন্য বাঁশ বা অন্যান্য দুর্বল পদার্থের কাঠামো ব্যবহার হতো।
ধাতব কাঠামোর জন্য রকেটের জ্বালানী অর্থাৎ ব্ল্যাক পাউডারের বিস্ফোরণ অধিকতর প্রকট হতো। এর ফলে সৃষ্টি হতো অধিক গতিবেগ, রকেট পাড়ি দিতে পারতো আরো বেশি পাল্লার দূরত্ব ।
এছাড়াও টিপু সুলতান রকেটের সাথে তরবারি সংযুক্ত করে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের ধারণা দেন। রকেট এটি নির্দিষ্ট দূরত্ব উড়ে শত্রুর কাছাকাছি যাওয়ার পর যেন ঠিকভাবে ঘুরে গিয়ে তরবারির অগ্রভাগ দিয়েই আঘাত হানতে পারে। তবে মহীশুরের রকেটে আঘাতের জন্যে সাধারণত চার ফুট লম্বা বাঁশের ফলা ব্যবহার করা হতো। এটি খাঁজের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতো লোহার তৈরি জ্বালানি প্রকোষ্ঠের সাথে।
এ জ্বালানি কক্ষ হিসেবে সাধারণত আট ইঞ্চি লম্বা এবং দেড় থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের লোহার টিউব ব্যবহার করা হতো। এ টিউবের ব্যাস ও লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব হিসেব করে একটি নির্দিষ্ট কৌণিক দিকে রকেট নিক্ষেপ করতে হতো। এজন্য রকেট সৈনিকরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতেন। এছাড়াও ছিল বিশেষভাবে নির্মিত রকেট লঞ্চার, যার থেকে একসাথে পাঁচ থেকে দশটি রকেট নিক্ষেপ করা যেতো ।
ব্রিটিশ-মহীশুর যুদ্ধে টিপু সুলতানের রকেট বাহিনী ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড়ো ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিলো। আকাশে নীলাভ আলোকচ্ছটা দেখলেই ব্রিটিশরা বুঝতে পারতো আসছে রকেটের ঝাঁক। আচমকা এগুলো আঘাত হানত ব্রিটিশদের ডেরায়, কখনো সামনে থেকে কখনো পেছন থেকে । রকেট এর সাথে সংযুক্ত বাঁশের ফলা ক্ষত বিক্ষত করে যেতো ব্রিটিশ সৈন্যদের। রকেটের আঘাতে মৃত্যুও ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীতে রকেট সৈনিকদের সংখ্যা ছিলো ৫,০০০ জন। সেসময় দুধরনের রকেট ছিলো, কিছু রকেট শূন্যেই বিস্ফোরিত হতো। আর কিছু ছিলো গ্রাউন্ড রকেট, যেগুলো একবার মাটিতে আঘাত করে আবার উপরে উঠে যেতো এভাবে সর্পিলাকার গতিতে এগোতে থাকতো যতক্ষণ না এর শক্তি নিঃশেষ হয়।
তবে চতুর্থ অ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে এ সকল রকেট চূড়ান্তরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ১৭৯৯ সালের ৫ই এপ্রিল রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনী নিয়ে টিলার দিকে এগোতে শুরু করেন কর্নেল ওয়েলসলি। আচমকা রাতের আঁধারের বুক চিরে আকাশে দেখা দেয় নীলাভ আলো, চারদিক থেকে গর্জে ওঠে মহীশুর বাহিনীর রকেট লাঞ্চার ও বন্দুক। শক্ত প্রতিরোধের সামনে টিকতে পারে নি ব্রিটিশ সৈন্যদল। বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় তারা, অনেক সৈন্য হতাহত হয় এবং গ্রেফতারও হয় অনেকে। কর্নেল ওয়েলসলি বাধ্য হন পিছু হটতে। এ ঘটনা ওয়েলসলির ওপর অনেক ভীতি সঞ্চার করেছিলো ।
কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্যের অসহযোগিতায় হারতে হয় সুলতানকে। ১৭৯৯ সালে তুরুখানাল্লির যুদ্ধে নিহত হন টিপু সুলতান।
এ যুদ্ধে মহীশুরের পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা হাতে পেয়ে যায় প্রায় ৭০০ রকেট এবং ৯০০ রকেটের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ। টিপুর এ রকেট নিয়ে ইংরেজদের কৌতূহলের অন্ত ছিলো না। এ রকেটগুলোকে উইলিয়াম কনগ্রেভ ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাধ্যমে এর কৌশল আয়ত্ত করে তারা। পরবর্তীতে আরো গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করেন কনগ্রেভ রকেট। যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের আধুনিকতম রকেট এবং কৃত্রিম উপগ্রহ নিক্ষেপণ ব্যবস্থা।
২০১৮ সালে টিপু সুলতানের সময়কার ১০০০ যুদ্ধ রকেট কর্নাটক থেকে উদ্ধার হয়। কর্নাটকের শিবামগ্গা জেলার বিদানুরু দুর্গ থেকে রকেটসমূহ উদ্ধার হয়।
পুরাতত্ত্ববিদেদের বর্ণনা অনুযায়ী, কর্নাটকের দুর্গে ২০০২ সালে ১৬০টি অব্যবহৃত রকেট উদ্ধার হয়েছিলো । ৫ বছর পর ২০০৭ সালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, সেগুলো টিপু সুলতানের রাজত্বকালের। তার পরই তাঁরা অনুমান করেন, ওই দুর্গে আরও রকেট থাকতে পারে। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করারর পর পুরাতত্ত্ববিদদের ১৫ জনের একটি দল খনন কার্য শুরু করেন এবং দুর্গের ভেতর একটি পরিত্যাক্ত কুয়ো থেকে তাঁরা ১০০০টি রকেট উদ্ধার করেন।
কর্নাটকের আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর শেজেসওয়ারা নায়কার বর্ণনা মতে,"পরিত্যাক্ত কুয়োর মাটি থেকে বারুদের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিলো । তারপরই সেখানে খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা । সেখান থেকে প্রচুর রকেট এবং শেল উদ্ধার হয় । প্রতিটার ভিতরে পটাশিয়াম নাইট্রেট, চারকোল এবং ম্যাগনেশিয়াম পাউডার ভর্তি ছিলো।"
যে রকেটগুলো উদ্ধার হয়েছে সেগুলো প্রত্যেকটাই ১২ থেকে ২৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের। ইতিহাসবিদরা জানান, ১৭৫০-৯৯ সাল এই সময়ে শিবমগ্গা জেলার ওই দুর্গ টিপু সুলতানের মাইসুরু রাজ্যের অধীনে ছিলো । তাই ইতিহাসবিদদের অনুমান, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধের সময় টিপু সুলতানই ওই রকেট ব্যবহার করতেন।
কপি @ জি.মোস্তফা
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৫
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:০৭




মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…
১. প্রথমে বলেছেন মৃতদের পেটে কাটাছেড়ার ডাহা মিথ্যা। পরে স্বীকার করেছেন দাগ থাকে।
২. আশ্রমে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×