somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নন্দিনী তুমি কোথায়?

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিন (sin) শব্দটার বাংলা পাপ। তা হলে সিন সিটি হচ্ছে পাপের শহর। একটা শহর কি পাপের হতে পারে? সেটা কি করে সম্ভব? তবে এমেরিকায় একটা শহরের এই উপাধি: sin city। সারা পৃথিবীর জুয়াড়িদের তীর্থ স্থান। অনেক ধরণের জুয়ার আসর বসে চোখ ধাঁধান ক্যাসিনোগুলোতে। কিছু মানুষ মিলিওন ডলার পর্যন্ত জিতে নেয়। তবে তার থেকে হাজার বেশীগুণ জুয়াড়িরা পকেট থেকে খোয়ায়। এই শহরটার নাম লাস ভেগাস। এখানে হারতে আনন্দ, জেতাতেও আনন্দ। এত আনন্দ চারিদিকে, তার পরেও কেন এটা পাপের শহর? আনন্দের সাথে কি পাপের একটা যোগাযোগ আছে, নাকি আনন্দের পেছনে পাপ?
লাস ভেগাস শুধু জুয়ার জন্যেই বিখ্যাত না। এখানে রকমারি খেলার আসর বসে। সার্কাস, গানের কনসার্ট, বক্সিং, কুস্তি আর কত কি। মানুষের চাহিদা মেটাতে স্থানীয়রা সব সময়ে ব্যস্ত। কত রকমেরই না কাজ: কেউ রাঁধে, কেউ পরিষ্কার করে। আবার পর্যটকদের বিনোদনের আরও শত ধরণের ব্যবস্থা। কিছু মানুষ আবার পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসায় নিয়োজিত। বাড়তি ডলার খরচ করতে যারা রাজী আর হয়ত যাদের কিছু পাপে আপত্তি নেই; এরা এমন মানুষদের শরীর আর চোখের খোরাক মেটানোর কাজ করে।
খরচ করতে যেমন সব বর্ণের মানুষ এখানে আসে, তেমনি উপার্জনের করতেও আসে অনেক জায়গা থেকে। পৃথিবীর কোন দেশের উপস্থিতি এখানে নাই, তা খুঁজে বের করা বেশ একটা কঠিন কাজ। যদি বলি, বাংলাদেশের বাঙ্গালীও এখানে পাবেন। তা হলে হয়ত ভাববেন, হতেই তো পারে। বাঙ্গালীরা এখন পৃথিবীর কোন প্রান্তেই বা নাই। কিন্তু যদি বলি, এক বাঙ্গালী মেয়ে লাস ভেগাসের রাস্তা দিয়ে এই মুহূর্তে হেঁটে যাচ্ছে। তা হলে নিশ্চয়ই মনোযোগ বাড়িয়ে দিয়ে পড়তে থাকবেন। আর যদি বলি, বাঙ্গালী মেয়ে সেই আদিমতম ব্যবসায়............

সুরমার বাসা খালের ধারে। বাড়ির নাম খাঁ মঞ্জিল। পাকা দু তালা বাসা। আশে পাশের অনেকটা জায়গা ফাঁকা। সেখানে ফুল বাগান। বেশ দূর থেকেই দেখা যায়। ইচ্ছে করেই বাগানে কোন বড় গাছ হতে দেওয়া হয় না। চোখ যত টুকু যায় শুধু ফুল আর ফুল। সারা বছরই ফুল থাকে। দু জন মালী মিলে বাগানের সব কাজ করে। বাড়ির মালিকের নাম করিম খাঁ উকিল, সুরমার বাবা।
সুরমার কলেজ থেকে নাটক হচ্ছে পরিমল থিয়েটারে, রবীন্দ্রনাথের “রক্ত করবী”। নন্দিনীর ভূমিকায় সুরমা। জেলা ডিসি এসেছেন প্রধান অতিথি হয়ে। মনে হচ্ছে সারা কুষ্টিয়ার মানুষ চলে এসেছে নাটক দেখতে, একেবারে শহর ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। চারিদিকে শুধু মানুষ, আর মানুষ। পর পর দুদিন, শুক্রবার, শনিবার দুটো শো। রবীন্দ্রনাথ বলতে কুষ্টিয়ার মানুষের একটা অন্য রকম দরদ। এত বড় কবি সব বাঙালির হলেও, কুষ্টিয়া শহরে রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন, কত না সাহিত্য রচনা করেছেন। তার ব্যবসার অফিস আর জমিদারী এখানেই ছিল। তার পরে “পরিমল থিয়েটারে” অভিনয় করবে খাঁ উকিলের মেয়ে সুরমা। বাবা আর মেয়েকে চেনে না, এমন মানুষ শহরে নাই। তার পরে পরিমল থিয়েটারের আছে বিশাল বড় একটা ঐতিহ্য।
বাংলাদেশের একটা মফঃস্বল জেলা কুষ্টিয়া। এখন মানুষ জন, ব্যবসা বাণিজ্য, সরকারী কাজ কর্ম বাড়লেও, কয়েক দিন আগেও মনে হত হাতে গোনা কিছু লোকের বাস। বর্তমানে পুরো জেলা হলেও, কুষ্টিয়া সাব ডিভিশন কখন ছিল যশোরের অন্তর্ভুক্ত, কখনও বা পাবনার। সেখানকার এক নামজাদা জায়গা “পরিমল থিয়েটার”। এখানেই ১৯১২ সালে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে জনতার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। কলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়া, দুর্গা দাস, শিশির ভাদুড়ী, আঙ্গুর বালা, ইন্দুবালা অভিনয় করে গেছেন। এত গৌরবের এক জায়গায় সুরমা অভিনয় করছে, লোকজন সব এসেছে বিরাট গর্ব নিয়ে। তাদেরই মেয়ে সবার মুখ উজ্জ্বল করবে।

লাস ভেগাসের সব চেয়ে নাম করা ক্যাসিনো কোনটা? একেক জনের হয়ত একেকটা মত হতে পারে। কারণ একটা ক্যাসিনো থেকে অন্যটা সুন্দর। বিশাল বড় বড় বিল্ডিং, রঙ আর আলোর কত না কারসাজি। হলফ করে যায়, এগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকাবে না, এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই। শুধু কথা দিয়ে মানুষের বানানো সৌন্দর্য বর্ণনা দেয়া অনেকটা অসম্ভব একটা কাজ। তার পরেও ক্যাসিনোগুলোর এক ধরণের র‍্যঙ্কিং হয়। সেই তালিকায় সবার উপরে আছে বেলেগিও লাস ভেগাস (Bellagio Las Vegas)। একেবারে পাঁচ তারকা।
রোমান্টিক মনকে একেবারে তুঙ্গে তোলার জন্যে এখানে একেবারে অন্য রকম একটা প্রদর্শনী হয়। লাস ভেগাসের নীল আকাশকে পেছনে রেখে, অসংখ্য ফোয়ারার পানি, বাজনা আর আলো নিয়ে চোখ ধাঁধান শো হয়। পুরো বিকেলটা ধরেই হয়। যুগল যারা আসে তারা একে অন্যের হাত ধরে, কেও ভালবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরে, কেউবা হয়ত আরও বেশী গভীর ভালবাসার সাগরে ডুব দেবার চেষ্টা করে।
সুমন এ পর্যন্ত বেশ অনেকবার লাস ভেগাসে এসেছে। নাম জাদা এক সফটওয়ের কোম্পানির বড় পদে আছে। বছরে একবার এখানে তার কোম্পানির কনভেনশন হয়। তা ছাড়া সফটওয়ের বিষয়ক আরও বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসতে হয়; বছরে চার পাঁচ বার তো হয়েই যায়।। সুমন যতবার লাস ভেগাসে আসে, তার প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেলেগিওর এই প্রদর্শনী দেখা চাই। । এক কোণায় দাঁড়িয়ে আকাশ, আলো, পানি, বাজনা আর রঙের খেলা উপভোগ করে। মনটা উদাস হয়ে যায়। কত ঘটনা আর স্মৃতি মাথায় চলে আসে। বুকের কোণাটা চিন চিন করে উঠে। তার পরেও ভাল লাগে। মনে পড়ে নোরার সাথে তার পাঁচ বছরের সংসার জীবনের কথা। কি সহজে এক দিন সকালে উঠে বলল, তোমার সাথে আমার হচ্ছে না। আমাকে তুমি ডিভোর্স করে দাও, না হলে আমি কোর্টে যাব।

“রক্ত করবী” র নন্দিনীর ভূমিকায় সুরমার অভিনয় আর গানের সুরে হল ভর্তি দর্শক একেবারে বিমোহিত হয়ে গেল। দর্শকরা ফিসফিস করে এক জন আরেকজনকে বলল, এই মেয়ে শুধু ছোট কুষ্টিয়ার গণ্ডির জন্যে না। সারা দেশে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বেই। ঢাকার থেকে খুব তাড়াতাড়ি কোন অফার না আসলে, একটা অবাক ব্যাপার হবে।
অনুষ্ঠান শেষে ডিসি সাহেব নিজেই ছুটে আসলেন এক তোড়া ফুল নিয়ে। বললেন, মা দোয়া করি অনেক বড় হও। তোমার অভিনয়ের কোন তুলনাই হয় না। রিকশাওয়ালারা মজার একটা কাজ করল। তারা আনন্দে একসাথে রিকশার ঘণ্টি বাজাল। কুষ্টিয়া যশোর অঞ্চলের আবার রিকশার ঘণ্টি অন্য রকম। চাকার সাথে লাগান থাকে, তাই শব্দও হয় অনেক জোরে। ঢাকার এক পত্রিকার সাংবাদিক সে সময়ে কুষ্টিয়া বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি নাটকের প্রশংসা করে বড় একটা লেখা লিখলেন। ছোট শহরে হৈ চৈ পড়ে গেল।

সুমন থাকে হল ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালীতে। পৃথিবীর বড় বড় সফটওয়ার কোম্পানির মুল কাজগুলো এখানেই হয়। আইডিয়া, গবেষণা, থেকে আরম্ভ করে বিনিয়োগ, কোম্পানির সূত্রপাত। খাবার- দাবার, পোশাক-আশাক, ঘর-বাড়ি সব কিছুর এখানেই মেলা দাম।
সুমনের সাথে নোরার পরিচয় হয়েছিল, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া পড়ার সময়। কথা বলতে বলতেই অন্তরঙ্গতা। কিছু দিনের মধ্যেই এক সাথে থাকা, বিয়ে আর ছোট রায়েনের জন্ম। যত দ্রুতগতিতে ভালবাসায় রঙ্গিন হয়েছিল, তার থেকে হয়ত কিছুটা ধীর গতিতে রঙ হারাতে লাগল। কিন্তু রঙ পুরোটাই হারাল, একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেল। আধুনিক বিশ্বের শ্বেতাঙ্গ রমণীর, এক বাঙ্গালী ছেলেকে হয়ত বেশী দিন ভাল না লাগাটাই স্বাভাবিক। এখন সব জায়গাতেই প্রতি বছর নতুন মডেল আর ডিজাইনের জিনিষ পত্র আসে। তখন পুরোনটাকে ভাল লাগে না, নতুনটাকে পাবার জন্যে মন অস্থির হয়ে উঠে।
রায়েনকে পাবার জন্যে সুমন অনেক চেষ্টাই করল। উকিল ধরল, কোর্টে গেল, অনেক খরচ পত্র করল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। রায়েনের কাস্টডি পেল নোরা, আর ভিসিটেশান রাইট পেল সুমন। তার মানে হল, বাচ্চা থাকবে নোরার কাছে আর সুমন শুধু শনি, রবিবারে বাচ্চাকে যেয়ে দেখে আসতে পারবে। তার পরেও সুমনকে তার সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিতে হল। সাথে সাথে কোর্ট ডিক্রি দিল, ছেলের বয়স আঠার হওয়া পর্যন্ত তাকে প্রতি মাসে বড় ধরণের সন্তান মাসোহারা (child support) দিতে হবে। যে নোরা তাকে না দেখে এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, সেই নোরা কোর্টের রায়ের পরে সুমনের দিকে তাকিয়ে এক বিজয়ের হাসি দিয়ে, বাই বলে চলে গেল।

কলেজের এক লেকচারার হারুন হোসেনের সাথে সুরমার বিয়ে কথা বার্তা কিছু হয়েছিল। খুব বেশী যে এগিয়ে ছিল, তা কিন্তু না। হারুনের বাবা করিম খাঁর কাছে প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন। ছোট বেলার বন্ধুকে, করিম খাঁ বলেছিলেন, তোর ছেলের সাথে আমার সুরমার বিয়ে নিয়ে পরে ভাবব। মেয়ে বিএ পরীক্ষা পাশ না করলে আমি বিয়ে দিব না। মেয়ে আমার স্বনির্ভর হবে, তার পরে সে আমার বাসা থেকে বের হবে।
কিন্তু খবরটা শহরময় রটতে দু মাস কি, দু দিনও লাগল না। এমনিতেই সবাই সুরমাকে চিনত; তার পরে কলেজের টিচারের সাথে বিয়ে হবে সেটা রটে গেল। এমনকি সুরমা তার বিয়ের খবর খবর শুনল, কলেজে এক বান্ধবীর কাছ থেকে। সুরমা তো শুনে হেসে অস্থির; আমার বিয়ে আর আমি জানি না। বাবা করিম খাঁ কথাটা শুনে রেগে গেলেন; কই আমি তো এ রকম কোন ওয়াদা কারোর সাথে করি নি।
নাটক মঞ্চায়নের সপ্তাহ খানেক পরে আরেক ঘটনা হল। ঢাকার এক সাপ্তাহিকে সুরমার ছবি সহ সাক্ষাৎকার বের হল। ছবি একেবারে কভার পেজে। পত্রিকার যতগুলো সংখ্যা কুষ্টিয়া এসেছিল। তার সবগুলো এক দিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল। “আলম পুস্তকাগারের” মালিক বাড়ে বাড়ে ঢাকায় ফোন করতে লাগলেন, তাকে জরুরী ভিত্তিতে আরও কিছু পত্রিকা পাঠান যায় কি-না।

এ বার পাঁচ দিনের জন্যে সুমন লাস ভাগা ভেগাসে এসেছে। বিকাল-সন্ধ্যার মধ্যে সুমনের অফিসের কাজ শেষ হয়ে যায়। তার পরে ভীষণ একাকীত্ব পেয়ে বসে। তখন সে বেলেগিওর সামনে পানির প্রদর্শনী দেখে, আশে পাশের রাস্তায় ইতস্তত হেঁটে বেড়ায়, এটা সেটা ভাবে। এই বার অবশ্য তার মনে একটা অন্য রকমের প্ল্যান আছে।
শেষ বার এসেছিল মাস তিনেক আগে; দু দিনের জন্যে। হোটেলের লবিতে এক লোক অনেকটা গায়ে পড়ে এসে পরিচিত হল। মিষ্টি হেসে বলল, তুমি কি ইন্ডিয়ান? সুমনের তেমন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তার পরেও সরাসরি তো আর মানুষকে এড়িয়ে চলা যায় না। সুমন বলল, না আমি এমেরিকান, তবে জন্ম বাংলাদেশে।
লোকটা মহা উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগল, Bangladesh, I know Bangladesh......আমি জানি বাংলাদেশ কোথায়? সুমন ভাবল, গার্মেন্টস আর ডঃ ইউনুসের কারণে বাংলাদেশকে মানুষ চিনতে আরম্ভ করেছে। কয়েক দিন আগেও মানুষ মুখ বাকিয়ে বলত, ব্যাংলা ডেস, সেটা আবার কোথায়? লোকটা এ বার সুমনের আরেকটু কাছে এসে, ফিস ফিস করে বলল, মনে হচ্ছে তুমি এখানে একাই এসেছ। যদি যাও, তোমাকে আমি একটা very pretty Bangldeshi girl’ র পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। Her name is Nondini.
এর পরে লোকটা আর অপেক্ষা করল না। সুমনের হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম টম আর আমার ফোন নাম্বার এখানে আছে। কখন সঙ্গীর দরকার হলে ফোন কর। সুমন বুঝল লোকটা আসলে Pimp মানে দালাল, আর মনে মনে হাসতে লাগল ওদেরকে এখন বাংলাদেশের খবর পর্যন্ত রাখতে হচ্ছে। বাংলাদেশের বড় লোকরাও তা হলে এখানে এসে ডলার খরচ করছে। সাব্বাস বাংলাদেশ!

লেকচারার হারুন হোসেনের বাবা সুরমার ছবি ওয়ালা পত্রিকা নিয়ে খাঁ বাড়িতে হাজির হলেন। করিম খাঁকে চিৎকার করে জানতে চাইলেন, তোমার মেয়ের ছবি পত্রিকায় কেন? করিম খাঁ প্রথমে বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলেন না। বললেন, কেন কি হয়েছে? ওর নাটকের খবর বের হয়েছে।
হারুনের বাবা বেশ জোরে সোরেই বললেন, যেই মেয়ের ছবি পত্রিকায় উঠে, সেই মেয়েকে আমার ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে পারব না। করিম খাঁ গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি এর মধ্যে কোন সমস্যা দেখছি না। তোমার যদি না পোষায়, তা হলে আমার করার কিছু নাই। আমার মেয়ের জন্যে ছেলের কোন অভাব হবে না।
এই ভাবেই সুরমার সম্ভাবনা অকালে মারা গেল। তার পরে সারা শহরে নানা মুখ রোচক কাহিনী ছড়িয়ে পড়ল। কেও বলল সুরমা ঢাকায় যেয়ে সিনেমায় একটিং করবে, তাই মফঃস্বলের এক জনের সাথে বিয়ে হওয়ার প্রশ্ন উঠে না। অন্যরা আবার বলল, হারুনের পরিবার একটু উদারতা দেখালে পারত। এত সুন্দর মেয়ে, এক সুন্দর অভিনয় করতে পারে। বিয়ের জন্যে তো একটা প্রতিভা নষ্ট করে ফেলা যায় না।

সুমন সিলিকন ভ্যালীতে ফিরে যাওয়ার পরে টমের দেওয়া ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। প্রথমে মনে হল ব্যাটা নিশ্চয়ই তাকে একটা চমক দিতে চেয়েছে। এইটা সেইটা বলে তাকে খদ্দের বানাতে চেয়েছে। অবশ্য সে ঠিক করল, পরের সফরে ভেগাস গেলে, পুরো ব্যাপারটা জানতে হবে: আসলেও কোন বাংলাদেশী মেয়ে আছে কি না, যে খদ্দেরদের শরীরের আর মনের চাহিদা মেটাচ্ছে। তবে নন্দিনী নামটা যে খাঁটি বাঙ্গালীর সেটা তার ভাল করে জানা। রবীন্দ্রনাথের “ রক্ত করবী” সে আগে পড়েছে। নন্দিনীকে চরিত্রকে সে ভাল করে চেনে। তার পরেও Google যেয়ে সার্চ করলঃ “রক্ত করবী”। সেখান থেকে You Tube যেয়ে “রক্ত করবী” নাটকটা কম করে হলেও বিশ বার দেখল। বাম ঠোটের কোণায় তিলের নন্দিনীকে বারে বারে দেখল। মেয়েটা কথা বললে কেমন সুন্দর গালে টোল পড়ে। নাটকের সব ডায়লগতো মুখস্থ হলই, সাথে সাথে মেয়েটাকে কেমন যেন ভাল লেগে গেল। মনে হল, বাস্তবেও যদি এই নন্দিনীর সাথে দেখা হত !
অফিসের কাজ শেষ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সুমন ফোন করল টমকে। ঐ দিক থেকে টম বলল, আমি জানতাম তুমি ফোন করবে। তবে শোন তুমি বাংলাদেশী গার্লটাকে যদি চাও, তোমাকে দু দিন ওয়েট করতে হবে। সে এখন মহা ব্যস্ত। তার জন্যে মানুষেরা এডভান্স দিয়ে রেখেছে।
সুমন বলল, আমাকে এই সব গল্প দিও না। I want to see Nondini today—ওকে আজকেই আমার কাছে নিয়ে আস। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে টম বলল, কিন্তু তা হলে দাম বেশী হবে। আমাকেও ২০% কমিশনও দিতে হবে। সুমন দেরী না করে উত্তর দিল, দাম নিয়ে ভেবো না। যা দাম, তাই দিব। আমি রাতের নয়টার সময় বেলেগিওর ফোয়ারার ধারে থাকব।
১০
করিম খা’র কোর্ট আর অফিস করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকালের চারটা বেজে যায়। কিন্তু ওইদিন দুপুর ১২ টার দিকে ফিরে আসলেন। বাড়ির গেট থেকেই জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন, আমার সুর,আমার মা---কোথায় গেলি রে? তাড়াতাড়ি শুনে যা। ভাল একটা খবর আছে রে!
সুরমা বাবাকে এত খুশী, উত্তেজিত হতে দেখে নি। পাঁচ বছর আগে মা মারা যাবার পর, বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন। আগে কত হৈ চৈ করতেন, হাসা হাসি করতেন, প্রায় দিনই এটা সেটা খেতে তার ইচ্ছে করত। এখন বাবা আর সেগুলো আর কিছু করেন না। সেই বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলেন, তাকে কি একটা খবর দিতে!
করিম খাঁ বলতে লাগলেন, শুন ঢাকার থেকে ফোন এসেছিল। বাংলাদেশ আর ভারতের জয়েন্ট ভেঞ্চারে একটা সিনেমা তৈরি হচ্ছে। কয়েকটা দেশে একটিং হবে। তোকে সেখানে নিতে চায়। ওরা বলল, পত্রিকায় তোর ছবি আর খবর দেখে তোকে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার গর্বে মন ভরে যাচ্ছে। তোর মা যদি থাকত, তা হলে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতাম।
১১
দু দিন পরে ঢাকা থেকে দু জন লোক আসল। সাথে এক গাদা কাগজ আর কয়েক ধরণের ক্যামেরা। প্রথমে চলল সুরমার বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলা। তার পরে তারা অনেকগুলো কাগজে সিগনেচার নিলো। সুরমা এক বার ভাবল, বাবাকে কাগজগুলো দেখিয়ে নিলে ভাল হত। পরের মুহূর্তে ভাবল, বাবার সাথে কথা বলেই ওরা এসেছে। এখানে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।
লোক দু জন সুরমার পাসপোর্ট সাথে করে নিয়ে গেল। তারা জানাল, বিদেশে যাবার ভিসা করতে হবে, টিকেট করতে হবে। সাথে সাথে অন্য যারা বিদেশে যাবে, তাদের জন্যও একই কাজ, মেলা ঝক্কি-ঝামেলা। আশা করছে, মাস খানেকের মধ্যে বিদেশে রওয়ানা দিতে হবে।
বাবা এসে অবাক। কই ওদের সাথে তো আমার দেখা হয় নি। শুধু এক বার ফোনে কথা হয়েছিল। এর মধ্যে এত দূর এগিয়েছে। আল্লাহ যা করে ভাল জনেই করে। তবে যাই করিস, পড়ালেখার যাতে কোন ক্ষতি না হয়।
১২
মেয়েকে উঠিয়ে দিতে বাবা করিম খাঁ নিজে আসলেন ঢাকা এয়ারপোর্টে। ভাবছিলেন সিনেমার পরিচালক আর অন্যদের সাথে পরিচিত হয়ে যাবেন। যাই হোক মেয়ে বলে কথা। তার পরে সেই দূর দেশ দুবাই যাবে অভিনয় করতে। মনটা কেমন খচ খচ করছিল। এয়ারপোর্টের তাড়াহুড়াতে তেমন একটা কথা হল না। দু জন পুরুষ আর পাঁচ জন মহিলা যাচ্ছে।
পুরুষদের একজন করিম খাঁর কাছে এসে বলে গেল, চাচা কোন চিন্তা করেন না। তিন সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবে। তার পরে দেখবেন , আপনার মেয়ে কত বিখ্যাত হয়ে যায়,সারা দেশে হুলুস্থুল পড়ে যাবে। করিম খাঁ জানতে চাইলেন, এই কয় জনই কি সিনেমায় কাজ করবে। লোকটা হেসে উত্তর দিল, কি যে বলেন চাচা—ছবি বানাতে কত মানুষের দরকার। দলের অন্যরা আগেই চলে গেছে।
কোর্ট কাঁপান করিম খাঁ উকিলের, লোকটার নাম পর্যন্ত জানা হল না। কে পরিচালক, কি সিনেমার নাম – কোন কিছুই জানা হল না। নিজের এক মাত্র সন্তানকে অজানা মানুষদের সাথে অচেনা জায়গায় পাঠালেন। কাজটা কি ঠিক হল? পত্রিকায় কত রকম খবর আসে। তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন, তার মেয়ে পড়ালেখা জানা। যে কোন বিপদে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। তার পরেও, মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। চাইলে তো তিনি নিজেও মেয়ের সাথে যেতে পারতেন। খরচতটা কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বিষয়টা যে কেন সময়মত মাথায় আসল না।
১৩
সুরমা এর আগে আরেক বার প্লেনে উঠেছিল, যশোর থেকে ঢাকা। ছোট একটা প্লেন ছিল আর সময় তো মনে হয় এক ঘণ্টাও লাগে নি। আর এই প্লেন কত্ত বড় আর কত না মানুষ উঠেছে। খুব ভাল লাগছিল, সাথে তুমুল উত্তেজনা। তার প্রথম ছবি হতে যাচ্ছে। তার পরে অভিনয় হবে বিদেশে। শুনেছে সেখানকার পথ ঘাট, বিল্ডিং সব এমেরিকা-ইউরোপের মত। সব কিছুই বিশাল। সেই জন্যেই সম্ভবত দুবাইকে শুটিং স্পট হিসেবে বেঁছে নেয়া হয়েছে।
প্লেনে পাশের সিটে বসেছিল করিমা। একই বয়সের। সে আবার এসেছে পাবনা থেকে। তাকেও একই কথা বলা হয়েছে। সিনেমা করার বড় সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বলা হয়েছে কাজ শেষ হয়ে যাবার পরে তাকে দু লক্ষ্য টাকা দেয়া হবে। সুরমা হিসেব করল, তিন সপ্তাহে এত টাকা, খারাপ না।
তবে একটা জিনিষ বুঝতে অসুবিধা হল, ঢাকার বাইরের সব নতুন মুখ দিয়ে ছবি বানালে চলবে তো? অন্য তিন জনকে আগে কখন দেখেছে বলে মনে হল না। সুরমার সিনেমার নামকরা নায়ক-নায়িকাদের চেহারা জানা আছে। তাদের ছবি তো সব সময় পত্র পত্রিকায় উঠে, টেলিভিশনে দেখায়। তা হলে কি সব নতুন মুখ দিয়ে ছবি বানাচ্ছে? প্রযোজক, পরিচালকদের ভ্যালা সাহস।
১৪
দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে ওদের পাঁচ জনকে একটা মিনি বাসে উঠান হল। এর মধ্যে সাথে আসা সিনেমা কোম্পানির বাঙ্গালী মানুষরা উধাও হয়ে গেছে। ওরা কিছু বলেও যায় নি। অজানা আশংকায় বুক দুলতে লাগল। গাড়ি ছুটতে লাগল শো শো করে। রাস্তার দু দিকে বড় বড় বিল্ডিং। রাস্তার গাড়িগুলোও ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে। ঐ সব গাড়িতেও কি সব ওদের মত মানুষ; তারাও কি জানে না, তারা কোথায় যাচ্ছে।
বাবা অনেক করে বলে দিয়েছিলেন, দুবাইতে পৌঁছান মাত্র সুরমা যেন তাকে ফোন করে। সুরমা সেই সুযোগ পেল না। চোখে বাড়ে বাড়ে ভাসতে লাগল, বাবা ঘন ঘন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় হিসেব করছে আর মোবাইল ফোনের দিকে চোখ চোখ বড় করে দেখছে। সাথে বিড় বিড় করছে, সুরমা প্লেন দুবাইতে ল্যান্ড করেছে তিন ঘণ্টা হয়ে গেল। এখনও ফোন করছে না কেন?
মিনিবাসের ড্রাইভার ইয়া বড় কুচকুচে কালো একটা মানুষ। মেয়েরা ওকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল। কিন্তু তার সব প্রশ্নের একই উত্তর, নো। সুরমা বুঝল, হয় লোকটা ইংরেজি জানে না কিংবা ইচ্ছে করেই কোন উত্তর দিচ্ছে না।
১৫
মিনিবাস বিশাল এক অট্টালিকার গেট দিয়ে ঢুকল। চারিদিকে উঁচু দেয়াল। দেয়াল ঘিরে ফুলের বাগান। ছোট একটা আঁকা বাঁকা খালের মত দেখা গেল। টলটলে নীল পরিষ্কার পানি। মুহূর্তে মনটা কুষ্টিয়ায় খাঁ বাড়ির বাগান থেকে ঘুরে আসল। ঐ বাগানের দিকে তাকালে মন যত ভারী হয়ে থাকুক না কেন, সেটা প্রশান্তিতে ভড়ে যেতে বাধ্য। সুরমা বাগানের দিকে আবার তাকাল। চোখের মধ্যে আবার বাবার অস্থির, মায়া ভরা চেহারাটা ভেসে আসল।
পাঁচ জনকে নামিয়ে অট্টালিকার ভিতরে একটা বড় কামরায় নিয়ে বসাল। এর মধ্যে ওদের আর বুঝতে বাকী থাকল না, তাদেরকে এখানে সিনেমায় অভিনয় করার জন্যে আনা হয় নি। অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। বাংলা সিনেমা অভিনয় যদি হত, তা হলে বাঙ্গালী লোক জন থাকত। কিন্তু সে রকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। এখানকার ব্যাপার স্যাপার কেমন রহস্য।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে গোটা দশেক আরব পোশাকধারী মানুষ এসে ঢুকল। একেকটা মেয়েকে ঘিরে ধরে দেখতে লাগল। তার পরে আরবি ভাষায় কথা আরম্ভ হল। পাঁচ জনার কারোর বুঝতে বাকী রইল না, নিলাম হচ্ছে। বাঙ্গালী মেয়ে বিক্রি হচ্ছে। আরবরা কিনেছে বাঙ্গালীদের থেকে। এখন আরব ব্যবসায়ীরা আরব ক্রেতাদের কাছে বাঙ্গালী মেয়ে বিক্রি করছে নিলামে; নিশ্চয়ই মেলা টাকা লাভে। মেয়েগুলো দেখতে শুনতে ভাল, কলেজ পড়ুয়া, কম বেশী ইংরেজি জানে। আরবরা এদের অনেক দাম দিয়ে কিনল। তার আগে ছবি দেখে চুল চেরা বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অনেকটা হাট থেকে গরু কেনার উন্নত সংস্করণ বলা যেতে পারে।
১৬
সুরমাকে ছাড়া বাকী চার জন এক এক করে বিক্রি হয়ে গেল। আরবরা তাদের কেনা নতুন সামগ্রী নিয়ে খুশী মনেই বের হয়ে গেল। সুরমাকে ঘিরে আরবরা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু যেই লোক নিলাম চালাচ্ছিল, সে যেন কি একটা উচ্চস্বরে বলল। অন্য লোকরা কথা শুনে হাসতে লাগল। তার পরে সবাই সুরমাকে ছেড়ে পরের মেয়েটাকে ঘিরে ধরল। সেখানে নতুন করে নিলাম চালু হল।
সুরমা এক কোণায় যেয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পরে লোকটা ফিরে আসল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলা আরম্ভ করল। মাই নেম ইস শেখ ইদ্রিস। আমি তোমাকে বিক্রি করব না। তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমি তোমাকে বিয়ে করব। বাট আমার এখন চার জন বিবি আছে। একটা বিবির জায়গা খালি হলেই তোমাকে সেই জায়গায় বসাব। এখন তুমি আমার এসিস্ট্যান্ট বিবি। তোমাকে আমি ফরেন নিয়ে যাব। ইউরোপ নিয়ে যাব, এমেরিকা নিয়ে যাব।
সুরমা বুঝল না, এখন সে কি করতে পারে আর তার কি করা উচিৎ। অনেক কষ্টে সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আমার বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইল। উত্তরে ইদ্রিস বলল, অসম্ভব। তোমার জন্যে আমি ফিফটি থাউসেন্ড ডলার খরচ করেছি।
১৭
সুরমাকে বেশ বড় একটা কামরায় থাকতে দেয়া হল। সেখান থেকে বাড়ির বাগানটা বেশ সুন্দর দেখা যায়। সুন্দর ছিম ছাম বিছানা। সময় মত খাবার চলে আসে। চীনাদের মত দেখতে এক ছেলে খাবার নিয়ে আসে। সেই আবার বিছানার চাদর বদলে দেয়, বাথরুম পরিষ্কার করে। কোন কিছু জানতে চাইলে, মুচকি করে হাসে। যার অর্থ তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না।
জানালার পাশে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়। সুরমা উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকে, বাগানের দিকে তাকিয়, আকাশের দিকে প্রায়ই চোখ চলে যায়। বাবার কথা খুব মনে হয়। তার সাথে কোন যোগাযোগ যদি করা যেত। পুরো পৃথিবীর তো একই আকাশ। তার কথা যদি আকাশ বাবার কাছে জানিয়ে দিত। আরেকবার ইচ্ছে করল, জানালা থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাবে। পরের মুহূর্তে মনে হল সেটা একেবারে সম্ভব না। চারিদিকে এত উঁচু দেয়াল। গেটে আবার বন্দুক নিয়ে প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকে।
তিন দিনের মাথায় ইদ্রিস এসে হাজির হল। বেলা তখন দুপুর একটার মত হবে। সুরমা মাত্র গোসল করে বের হয়ে মাথার চুল শুকচ্ছিল। আয়নায় দেখল ইদ্রিসকে। তাড়াতাড়ি একটা তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে নিলো। কিন্তু এর মধ্যেই ইদ্রিস সুরমাকে পেছন থেকে জাপটিয়ে ধরেছে। কোন কথার সুযোগ না দিয়ে মুহূর্তেই সুরমাকে বিবস্ত্র করল। তার পরে শুরু হল পাশবিক আক্রমণ। সুরমা দেখল ওদের খাঁ বাড়ির বাগানে কোন ফুল নেই। সব শুকিয়ে মারা গেছে। চারিদিকে শুধু বড় বড় আগাছা। সুরমা ওখানে দৌড়াতে লাগল। ডান পায়ে বড় একটা কাঁটা ফুটে গেল। সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। একেবারে লাল টক টকে রক্ত।
১৮
শেখ ইদ্রিস তার কথা রাখল। তিন মাসের মাথায় সুরমা সহ আর সাত জনকে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে বের হল। তার নিজের প্লেন আছে। তার ভিতরে আমোদ প্রমোদের সব রকমের ব্যবস্থা আছে। প্রথমে লন্ডন, তার পরে প্যারিস। শেষে যেয়ে হাজির হল লাস ভেগাসে।
দলের মেয়ে ছিল তিন জন। ওরা একেক জন একেক দেশের। বিদেশ সফরে শেখ সাহেব প্রতি রাতে একেক জনকে নিয়ে বের হয় জুয়া খেলতে। অন্য দু জনকে পালা করে পাহারা দেয় দলের পুরুষ সদস্যরা। লাস ভেগাসে দ্বিতীয় দিনেই ডাক পড়ল সুরমার। সেই দিন শেখ ইদ্রিস বেশ কিছু টাকা জিতল জুয়ার টেবিলে। এতেই সে মহা খুশী। একটার পর একটা মদের গ্লাস খালি করতে লাগল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই নেশার চোটে ইদ্রিস কিছু আবোল তাবোল বকল। তার পরে ঢুলতে ঢুলতে হেঁটে একাই রওয়ানা দিল।
সুরমা এ রকম একটা সুযোগ যে আসবে, তা ঠিক ভাবতে পারে নি। প্রথমে পা টিপে টিপে ইদ্রিস যে দিকে গেছে, তার উল্টা দিক দিয়ে ক্যাসিনো থেকে বের হয়ে গেল। তার পরে রাস্তায় নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। লাস ভেগাসের রাস্তা দিয়ে সুরমা ছুটতে লাগল।
১৯
সুমন এক বিশাল ফুলের তোড়া নিয়ে সামনের টেবিলে রাখল। প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও, সুমন ঠিক করল নন্দিনী নামের বাঙ্গালী মেয়েটাকে সে চমক দিবে; অনেক আশার কথা বলবে। নিজের হাতে ফুল দিয়ে অবাক করে দিবে। যে মেয়ে বিদেশ বিভুয়ে এই কাজ করছে, তার নিশ্চয়ই অন্য রকম কোন কাহিনী আছে; তাতে কত না কান্না, কত না অশ্রু মিশে আছে! ফ্রাঙ্ক সিনেত্রার বাজনার তালে তালে তখন বেলেগিও’র ফোয়ারা পানির প্রদর্শনী চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেছন থেকে শুনল, আপনি কি সেই বাঙ্গালী বাবু, না কি?
সুমন খুব অবাক চোখে দেখল। একটা মেয়ে এত সুন্দরী, এত সুন্দর গলার আওয়াজ। কিন্তু কেমন যেন চেনা চেনা লাগল।
লাস ভেগাসের সাজেও তাকে বাঙ্গালী বলে চিনে নিতে কোন অসুবিধা হল। সুমন ভাল করে তাকিয়ে দেখে, আরে এই মেয়ের বাম ঠোটের উপরেও যে তিল। যখন কথা বলছে, ঠিক You Tube এ দেখা মেয়েটার মত টোল পড়ছে। তা হলে ছবির নন্দিনী আর সামনের নন্দিনী কি একই? এই মেয়েকেই কি তার বাস্তবে পেতে ইচ্ছে করেছিল।
এক কথা দু কথা করে, দু জনের অনেক কথা হল।
সুমন বলল, তুমি তোমার বাবার সাথে যোগাযোগ কর না কেন? নন্দিনী বলল, আমি যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, বাবা তা কোন ভাবেই সহ্য করতে পারত না। তা ছাড়া আজ তিন বছর হয়ে গেছে; বাবা বেঁচে আছে না মারা গেছে, তাই জানি না।
নন্দিনী হাসতে হাসতে বলল, পত্রিকায় আমার ছবি উঠেছিল বলে কলেজের লেকচারার আমাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আর এখন আমাকে বাঙ্গালীরা বিক্রি করেছে, আরবরা কিনেছে। নিজেকে নিজেই বিক্রি করছি প্রায় প্রতি রাতে। বাংলাদেশে ফিরলে কেও ফিরেও তাকাবে না, মুখের উপর থু থু দেবে!
এই বার সুমন বলল, বেশ তো তোমার গুণ। পরিমল থিয়েটার থেকে লাস ভেগাস। সুরমা থেকে নন্দিনী।
সুমন ফুলের তোড়াটা এগিয়ে নাটকীয় স্বরে, সব গুলো আবেগ এক জায়গায় জড় করে বলল, “নন্দিনী, তোমার জন্যে ফুল এনেছি নন্দিনী”। সুমন বলতে লাগল, নন্দিনী। তোমাকে সিলিকন ভ্যালীতে নিয়ে যেতে চাই। আর তোমাকে বলতে চাই, আমি তোমাকে............
নন্দিনী হাসতে হাসতে বলল, জীবনটাইএক বিশাল অভিনয়, এক বিরামহীন নাটক। কুষ্টিয়ার মেয়ে অভিনয় করেছি পরিমল থিয়েটারে আর এখন লাস ভেগাসে। অভিনয় হচ্ছে, নাটক হচ্ছে। হায়রে জীবন! এর থেকে বের হওয়ার আর কোন উপায় নাই।
নন্দিনী থেমে বড় একটা শ্বাস নিয়ে অনেকটা স্বগক্তি করার মত করে বলল, What Happens Here in Sin City, Stays Here*

* (পাপের শহরে যা হয়, তা এখানেই থাকে –লাস ভেগাসের স্লোগান) ।

কাজী হাসান
ডিসেম্বর ৮, ২০১৩
http://www.lekhalekhi.net
১৬টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×