somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধুর খোঁজে সুন্দরবনে একদিন...

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুদিন আগে হঠাৎ করে একটা ফোন পেলাম এক বড় ভাই ফোনটা করেছে । ঘোরাঘুরির টুকটাক অভ্যেস থাকার সুত্র ধরেই উনার সাথে পরিচয়। খুবই সংক্ষিপ্তাকারে জিজ্ঞেস করলেন ”সুন্দরবন যাবে - মধু সংগ্রহে ?” এমনিতেই মধু জিনিসটা আমার অত্যন্ত প্রিয়, তার উপর সুন্দরবন !!! এ যে দেখি মেঘ না চাইতেই এক্কেবারে বৃষ্টির বাড়িধারা !!! আমি সানন্দে অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই এই মধুর আয়োজনে শরিক হবার মনোবাসনা জ্ঞাপন করলাম। ঠিক হল ১৯ তারিখে বাসে করে রওনা করব। প্রাথমিক গন্তব্য হবে শ্যামনগর, সাতক্ষীরা হতে আরও ৬৫ কিলোমিটার দূড়ের পথ। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী ১৯ তারিখ রাতে আমরা দশজনের দল উপস্থিত হলাম শ্যামলী বাসকাউন্টারে। এই দশজনের মাঝে দু-তিনজন আমার পূর্ব পরিচিত, বাকিরা সবাই অচেনা, অজানা। বাসস্ট্যান্ডেই সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলাম। পরিচয় পর্ব শেষে সবাই নিজ নিজ আসনে বসে পড়লাম। ঢাকার বিখ্যাত জ্যামের কথা মাথায় রেখেই একটু আগেভাগে রওনা দেয়া উত্তম বিবেচনা করে আমরা রাত আট-টার বাসে চেপে রওনা দিলাম। আমাদের কপালটা এতোটাই ভাল ছিল যে আমি নিশ্চিৎ, পাটুরিয়া ফেরীঘাটে কোন রকম অপেক্ষা ছাড়াই প্রথম সুযোগেই ফেরী ধরা সম্ভবপর হবে, সেটা আমার মতই কেউই ভাবতেও পারেননি। আমাদের বহনকারী বাস সেটাই করে দেখালে আমরা যারপর নাই বিস্মিত হয়ে উঠি। এজন্য বাসের চালক ছোটখাট এতটা ধন্যবাদের দাবী রাখেন যে উনি যাত্রাপথে অযাচিত কোন বিরতি দেবার চেষ্টা করেননি।

ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা হয়ে যখন আমরা শ্যামনগর পৌঁছাই, ঘড়ির কাঁটা তখন ৪টার ঘর অতিক্রান্ত হয়েছে। শ্যামনগর থেকে আমাদের পরবর্তি গন্তব্য মুন্সিগঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী। আমাদের জন্য একটা মাইক্রোবাস প্রস্তুত রাখা হলেও এতো ভোরে ড্রাইভারকে ঘুম থেকে উঠানো বেশ মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। ভাগ্য কিছুটা সহায়ক ছিল এই জন্য যে সেই ভোর রাতেও একটি চায়ের দোকান আমরা খোলা পেয়ে যাই। চা খেয়ে শরীরের আরষ্টতা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি শেষ রাতের নিরবতা উপভোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। ধীরে ধীরে রাতের আঁধার কাটিয়ে ভোরের আলোর উপস্থিতি অনেক দিন পর অবোলকন করার সুযোগটা বেশ ভালভাবেই কাজে লাগালাম। নাগরিক জীবনে শেষ কবে যে সূর্যোদয় দেখেছি অনেক কষ্টেও সেটা মনে করতে পারলাম না। ধীরে ধীরে একটা জনপদ জেগে উঠতে দেখে কার কেমন লেগেছিল জানি না, তবে আমার কাছে বিষয়টা একটু ব্যতিক্রমই লেগেছিল সেটা বলতে কোন দ্বিধা নেই!!!

অবশেষে সকল প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাইক্রোবাসের চালক এসে উপস্থিত হলেন ভোর ছয়টার দিকে। আমরা সবাই মাইক্রোবাসে উঠলাম। এবারের গন্তব্য বুড়িগোয়ালিনী। মুন্সীগঞ্জ থানায় অবস্থিত বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা আমাদের জন্য অপেক্ষায়মান ট্রলারে উঠলাম আনুমানিক সাতটা ত্রিশ মিনিটে। কিন্তু সেই সময় ভাটার উপস্থিতির কারণে আমাদের জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। জোয়ার আসা মাত্রই আমাদের ট্রলার নদীর বুকে ভাসিয়ে দেয়া হল, গন্তব্য কলাগাছিয়া বন বিভাগের রেঞ্জ অফিস। অবশ্য যাত্রার শুরুতে নীলডুমুর (বুড়িগোয়ালিনীর আরেক নাম) বাজার থেকে প্রয়োজনীয় পানিয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে ভুল করলাম না।

এবার শুরু হল আমাদের নৌ-পথের যাত্রা। প্রায় ঘন্টা খানেকের যাত্রা পথে সুন্দরবনের বিভিন্ন মনোরম দৃশ্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হল। দেখতে পেলাম নদীর বুকে নৌকা ভাসিয়ে কিভাবে স্থানীয় লোকজন তাদের জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেরাচ্ছে। কেওড়া, গড়ান, সুন্দরী আরো নাম না জানা নানাবিধ গাছগাছালীর মিলনমেলা এই সুন্দরবনের সৌন্দর্য সকল ভ্রমণপিয়াসীদের মনের তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মিটিয়ে দেবে। এছাড়াও নীল আকাশের বুকে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের ডানা মেলে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য পর্যটকদের মানসপটে গেথে থাকবে বহুকাল।

কলাগাছিয়া ফরেষ্ট অফিসে ভ্রমণ পিপাসুদের মনের খোরাক মেটানোর জন্য বনের ভিতর দিয়ে বেশ কিছুটা এলাকায় পায়ে হাটার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। বনের ভিতর দিয়ে উঁচু মাচা তৈরী করা হয়েছে যার মাঝ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সুন্দরবনে অবস্থিত বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালির সাথে পরিচিত হওয়া যায়। এই সময় বনের ভিতর দিয়ে জোয়ারের পানি কিভাবে প্রসারিত হয় সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যও সকলের নজরে পরবে। পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে বড়জোর এক ঘন্টার মত সময় লাগতে পারে। এই এক ঘন্টা হাঁটাহাঁটির কারণে কেউ যদি পরিশ্রান্ত হয়ে যান তবে তাদের জন্য সেখানে রয়েছে বিশ্রামাগার। আর কেউ যদি সেই সুযোগে গোসলের ঝামেলাটা সেরে ফেলতে চান, তাদের জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থা !!! খোলা আকাশের নিচে পুকুরের নিটল পানিতে শরীর এলিয়ে দিয়ে যাবতীয় ক্লান্তভাব দূর করতে আশা করি কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আর চারপাশের নোনা পানির মাঝে একটু মিঠা পানির স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ কেইবা হাতছাড়া করতে চায় বলুন ??? আমরাও বন পরিভ্রমণ শেষ করে এসে আমাদের ক্লান্ত শরীরটা পুকুরে ডুবিয়ে দিয়ে বিশ্রাম নিয়ে ফেললাম। এখানে বলে রাখা ভাল যে, এই মিঠা পানির সুব্যবস্থা শুধু মাত্র মানবজাতির কথা বিবেচনা করেই করা হয়নি, বরং সুন্দরবনের রাজাধিরাজ রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের স্বার্থও বিবেচনা করা হয়েছে। উনারা হরহামেশাই নিজ নিজ মন মর্জির উপর ভর করে নিজেদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এই পুকুর ঘাটে উপস্থিত হন। আর এই জন্য যত্রতত্র ”বাঘ হইতে সাবধান” এমনতর সাবধান বাণীও কারো নজর এড়াবে না।

গোসল বিশ্রাম শেষে আমরা আবার আমাদের ট্রলার নদীর বুকে ভাসিয়ে দিলাম। এবারের গন্তব্য হরিনগর। জোয়ার থাকতে থাকতেই আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌছানোটা জরুরি, কেননা ভাটা শুরু হলে আমাদের ট্রলার মাঝ নদীতে পানি স্বল্পতার জন্য আটকা পড়ে যেতে পারে। কলাগাছি থেকে বনের পাশ দিয়ে আমাদের ট্রলার ছুটে চলে তার আপন গতিতে। আর আমরা উপভোগ করি নদীর কূল ঘিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য। নাম না জানা অসংখ্য গাছগাছালিতে ভরা চিরহরিৎ এই সুন্দরবন নিজেই যেন এক অপার বিস্ময়!!! অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখির এই অভয়াশ্রম তার অপার সৌন্দর্য দুহাত উজার করে দিচ্ছে নিস্বার্থভাবে। নানা রঙ বেরঙের মাছরাঙা, বক, সোনালী ডানার চিল থেকে শুরু করে অনেক নাম না জানা পাখিদের সাক্ষাৎ মিলবে এই অভয়ারণ্যে এ ব্যাপারে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। নদীর বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে এই সকল পাখিদের সরব উপস্থিতি আমাদের যেন বিস্মিত করে দেয়। পাখিপ্রেমীরা সবাই নিজ নিজ ক্যমেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন সেই সুন্দর মুহুর্তটাকে সেলুলয়েডের ফিতেয় বন্দী করার জন্য।

আমাদের উদ্দেশ্য যেহেতু বন থেকে মধু সংগ্রহ করা, সেজন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে আমরা হরিনগর গিয়েই আমাদের আস্তানা গড়া হবে। বেলা বারোটা নাগাদ রওনা দিয়ে আমরা যখন হরিনরে উপস্থিত হই, সূর্যমামা তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সকল আয়োজন সেড়ে ফেলেছে। তাই আমরা আর দেরী না করেই দুটো ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম, উদ্দেশ্য বনের মাঝে ছোট ছোট খাল দিয়ে একটু ঘুড়ে বেড়ানো আর এর ফাঁকে ফাঁকে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য দুচোখ ভরে উপভোগ করা। আর ভাগ্যের প্রসন্নতা কামনা করা যেন বাঘ মামার এক নজরে বন্দী করতে পারা যায়। বাঘ দর্শন না হলেও নিদেন পক্ষে হরিণপালের দর্শন মেলে!!! সুন্দরবনের বুক চিড়ে এমন অসংখ্য খাল বয়ে চলে গিয়েছে, আর সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য বোধ করি এখানেই সযতেœ লুকায়িত !!! সুনশান নীরবতাকে সঙ্গী করে আমাদের নৌকা দুটি বয়ে চলে। আমাদের বৈকালিক নৌভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করতে হল ভাটা থাকায় খালের পানি কমে এসেছে। ঘন্টা খানেক পর আমরা আমাদের আস্তানায় ফিরে এলাম।

হরিনগড়ে অবস্থিত জনগণের মূল জীবিকা হল বনে বনে ঘুড়ে মধু সংগ্রহ করা, মাছ ধরা অথবা বনের ভিতর থেকে লাকরি যোগার করা। আমরা জনপদে নেমে এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে ধারণা নেবার চেষ্টা করলাম কিভাবে পরবর্তী দিনের মধু সংগ্রহের অনুষ্ঠানটাতে সফল করা যায়। সেখানে কয়েকজন মোয়ালীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিৎ হওয়া গেল যে আমরা যেখানে আস্তানা গেড়েছি তার নিকটবর্তী এলাকাতেই মৌচাক রয়েছে; বলাই বাহুল্য এই মৌচাক গহীন বনের মাঝে অবস্থিত!!! আমাদের জানিয়ে দেয়া হল পরদিন সকালে জোয়ার শুরু হলেই আমরা মধু সংগ্রহের জন্য বেড়িয়ে পড়ব।

মোয়ালীদের সাথে কথাবার্তা পাকা করে আমরা এদিক ওদিক ঘুড়ে বেড়ালাম। চোখে এল দিগন্ত বিস্তৃত মাছের ঘের। ফসলি জমির চেয়ে মাছের ঘেরের আধিক্য অনেক বেশি। স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলেও এই ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। জানা গেল আজকাল ফসলি জমিগুলোও মাছের ঘের হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারী করার ফাঁকে লক্ষ করলাম পশ্চিম আকাশকে রাঙ্গিয়ে দিয়ে সূর্যমামা ঘুমের রাজ্যে চলে যাবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। অনেক দিন পরে আমাদেরও গোধূলী লগ্ন উপভোগ করার সুযোগ হল। দিগন্ত বিস্তৃত মাছের ঘেরের স্বল্প পানির উপর গোধূলীর সোনালী আভার সঙ্গে সাগরে সূর্যাস্তের তুলনা বাহুল্য মনে হলেও এর সৌন্দর্যের মাত্রাও কোন অংশে কম নয়। গোধূলীর এই নতুন স্বাদ আস্বাদন করে আমরা সবাই আমাদের ডেরায় ফিরলাম। ওহ বলাই হয়নি, আমাদের ডেরা কিন্তু অন্য কোন কিছু নয়, আমাদেরই বহনকারী ট্রলার। সন্ধ্যার হালকা আলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই মাথার উপর খোলা আকাশ তার বুকে তারার ডালি মেলে ধরল। চারিদিকে সুনশান নিরবতা, উপরে খোলা আকাশে তারার মেলা আর নীচে কুলকুল শব্দে পানির নিরলসভাবে বয়ে চলা--সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হল বাঘের গল্প। আমরা যে এলাকাতে অবস্থান করছিলাম, সেই হরিণগরে প্রায়শই নাকি বাঘের আনাগোনা দেখা যায়। প্রতিবারেই কোন না কোন পরিবারের পোষ্য হাঁস, মুরগি, ছাগল ধরে নিয়ে চলে যায়। আবার অনেক সময় লোকালয়ে ঢুকে মানুষের উপরেও চড়াও হয়। বাঘের গল্পের সাথে হাত ধরাধরি করে মধু সংগ্রহের গল্পও চলে আসে। কিছু দিন আগেই মধু সংগ্রহে গিয়ে তামজিদ ভাই কেমন করে মৌমাছিদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন সেই গল্প শুনে আমাদের সবার মনে একটু হলেও ভীতির সঞ্চয় করে। এই সব ভীতিকর গল্পের ফাঁকেই রাতের খাবার প্রস্তুত হলে আমরা সবাই এক সাথে খাবার খেয়ে নেই। সারা রাতবাস জার্নি করার ফলে সবাই বেশ ক্লান্ত থাকায়, রাতের খাবার শেষ হওয়া মাত্রই সবাই বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। ঘুমের রাজ্যে চলে যেতে কারোরই আর দেরী হয় না।

পরের দিন সকাল বেলাতেই সবার মধ্যে সাজ সাজ রব পরে যায়। মধু সংগ্রহ তো নয় যেন সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে!!! আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে মধু সংগ্রহে যাবার সময় নিরাপত্তার জন্য কি কি পোষাক পরিধান করতে হবে। সেই নির্দেশনা মোতাবেক আমরা সবাই ফুলহাতা শার্ট, জিন্স প্যান্ট, রেইন কোট, টুপি, গামছা, মশারির কাপড়, হ্যান্ড গ্লোভস প্রভৃতি দিয়ে বর্ম তৈরী করে নেই। মূলত মৌমাছির আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই বর্ম তৈরী করা। সকাল আটটার দিকে আমরা ট্রলার নিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করি। জায়গাটা আমদের ডেরা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

ট্রলার থেকে নেমে বনের ভেতর একটা খোলামেলা জায়গায় আমরা সবাই একত্রিত হই। বনের ভিতর এমন জায়গায় হঠাৎ করেই বাঘ আক্রমন করে বসতে পারে সেজন্য আমাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। মৌয়ালীরা বিভিন্ন গাছের পাতা কেটে মশাল বানিয়ে নেন যাতে করে সময় মত ধোঁয়া তৈরী করে মৌমাছি তাড়ানো যায়। মধু সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই কৃত্রিম ধোঁয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধোঁয়া না ছড়ালে মৌচাক থেকে মৌমাছি সহজে তাড়ানো সম্ভব হবে না, এবং আমরা সহজেই ওদের আক্রমণের শিকারে পরিনত হব। মশাল বানানো শেষ হলে আমরা সবাই মৌয়ালীদের পেছন পেছন সারি বদ্ধভাবে বনের ভিতরে অগ্রসর হতে শুরু করি। মৌয়ালীরা সামনে থেকে গাছের ডালপালা ছেঁটে ছেঁটে আমাদের জন্য পথ তৈরী করে দেন, কর্দমাক্ত বনের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে চলি আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যের দিকে। সুন্দরবনের আঠাযুক্ত পিচ্ছিল কাদামাটির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলতে চলতে অনেকেরই হাত পা ছড়ে যায়, কিন্তু কারোরই সেদিকে কোন ভ্র“ক্ষেপ নেই যেন !!! চারদিকে বাঘের অনাকাক্সিক্ষত আক্রমণ, মৌমাছির বিষাক্ত হুলের কামড় এড়িয়ে মধু সংগ্রহ সব মিলিয়ে দারুণ এক উত্তেজনা কাজ করে সবার মাঝে। মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা সবাই মিলে উপস্থিত হই একটা মৌচাকের নিচে। মৌচাক ঘিড়ে রয়েছে সুন্দরবনের হিংস্র কালো কলো অস্ংখ্য মৌমাছি। বাঘের আত্রমন থেকে তাদের আক্রমনও ভয়াবহতার দিক থেকে কোন অংশে কম যায় না।

মৌয়ালীরা মৌচাক ঘিড়ে তাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নেন। দুজন উঁচু ডালের সাথে মশাল বেঁধে সেটায় আগুন লাগিয়ে মৌচাকের চারিদিকে ধোঁয়া দৈরী করে মৌমাছি তাড়ানোর ব্যবস্থা করেন, এর ফাঁকে একজন মৌয়ালী কৌশলে গাছে উঠে চোখের পলকে দক্ষ হাতে মৌচাক কেটে নিয়ে আসেন। পুরো ব্যপারটা এতোটাই নিপুনহাতে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয় যে যারা একটু পেছনে ছিলেন তাদের পক্ষে পুরো বিষয়টা দেখতে পারাটাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একই ভাবে দুটো মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে আনতে দক্ষ মৌয়ালীদের মোট সময় লাগে মাত্র তিরিশ মিনিট !!! মধু সংগ্রহ শেষ হতেই আমরা সবাই মৌচাক থেকেই মধু খেতে ঝাপিয়ে পড়ি। মৌচাক থেকে ভাঙ্গা গরম গরম মধু আমরা সবাই মোম সহ মুখে চালান তরে দেই। গরম মধুতে মুখটা যেন ভরে ওঠে!!!

দু’ঘন্টার সফল অভিযান শেষে আমরা মিনিট দশেকের ভিতরেই আমাদের ডেরায় ফিরে আসি। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে উত্তেজনাপূর্ণ এই অভিযানে আমাদের কোন সহযাত্রী ন্যুনতম ক্ষতিগ্রস্থ হননি। এমনকি আমরা কেউই মৌমাছি দ্বারা আক্রান্ত পর্যন্ত হইনি। মধু সংগ্রহের পর আমরা ঠিক করি নদীতে জোয়ারের পানিতে নেমে শরীর ভেজাব। ভাবা মাত্রই আমরা কয়েকজন পানিতে নেমে পড়ি। নদীতে তখন পূর্ণ জোয়ার বইছে। দেখতে দেখতে আমরা যে জায়গাতে নৌকার নোঙ্গর ফেলেছিলাম সেই জায়গাটাও পানিতে ভরে যায়। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম জোয়ারের সাথে যেন বনের সৌন্দর্যের অদৃশ্য এক সম্পর্ক বিদ্যমান। জোয়ারের সময় যত বৃদ্ধি পেতে লাগল, সুন্দরবরনের বুনো সৌন্দর্য যেন তত খোলতাই হতে লাগল। পুরো বনটাই যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে জোয়ারের সময়। আবার ভাটার সময়ও পানিতে যে টান পড়ে, সেটাও দেখার মত। নদীর পানি যেন অদৃশ্য কারো এক আহবানে সাড়া দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে অজানা কোন এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

সারাদিন অন্য কোন কাজ না থাকায় কখনও নদীতে সাতার কেটে কখনও বা ছড়া জালে নদীতে মাছ ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে দিনের পুরোটা সময় অলস ভাবেই কাটিয়ে দেই। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল যে রাতে বার-বি-কিউ আর ফায়ার ক্যাম্পের আয়োজন করা হবে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কয়েকজন বিকেল নাগাদ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আর আর আমার মত যাদের তেমন একটা কর্মব্যস্ততা ছিল না, তারা এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে পায়চারী করে সময়টা কাটিয়ে দেই। সন্ধ্যার পরে আমাদের কর্ম তৎপরতা গেল বেড়ে। সবাই মিলে বনের পাশে উচু বালির ঢিবিতে উঠে পড়ি। রাতের গভীরতা বারার সাথে সাথে আমরা ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করি। চাঁদের হালকা রূপালী আলো আর আমাদের চারপাশের ঘিরে থাকা নির্জনতা মিলে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ তৈরী করে তোলে। আমরা যেন ধীরে ধীরে সেই মায়াবী জগতে প্রবেশ করি। রাতের গভীরতা যত বাড়তে থাকে, সুন্দরবনের এই অনন্য রূপ যেন ধীরে ধীরে ততোটাই প্রষ্ফুটিত হয়ে আমাদের সামনে ধরা দেয়। খোলা জায়গা খুব বেশি নিরাপদ না হবার জন্য আমরা বেশি দেরী না করে খারার শেষ করে ট্রলারে উঠে পড়ি।

পরদিন সকালে জোয়ার এলেই আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করি। এবারের গন্তব্য চকবাড়া। গাবুরা ইউনিয়নের এই গ্রামটি বুড়িগোয়ালিনী ঘাটের বিপরীতেই অবস্থিত যেখানে ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রচন্ড ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় আইলা মারাত্মক আঘাত হেনেছিল। আজ তিন বছর পরেও এই গ্রামটি যেন তার প্রতিটি স্থানে সেই প্রলয়ঙ্কারী আইলার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। একদা শষ্য সফলা এই গ্রাম আজ জরা জীর্ণ অবস্থায় যেন ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। পুরো গ্রামে হাতে গোনা দু’একটা টিউবওয়েল ছাড়া অন্য কোথাও মিষ্টি পানির কোন অস্তিত্ব নেই। ১৫০ থেকে ২০০ পরিবারের সব সদস্য ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়েছে শুধু দুমুঠো খাবারের আশায়। ছেলে বুড়ো মহিলা কেউ বাদ যায়নি, সবাই কায়িক শ্রমে ব্যস্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই এলাকায় অধিকাংশ ঘরেই দু এক জনের দেখা মিলবে যারা কোন না কোন ভাবে বাঘের আক্রমণে আহত হয়েছেন। এখানে কিছুটা সময় ব্যয় করলে জানা যাবে বাঘের আক্রমণের নানা রকমের জীবন্ত গল্প। কিভাবে তারা বাঘের আক্রমনের শিকার হয়েছেন, কিভাবে সেই আক্রমন থেকে তারা জীবিত ফেরত এসেছেন, কিভাবে তাদের পূণর্বাসন হয়েছে এমনি নানা রকম অজানা কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে তাদের মুখে মুখে।

চকবাড়া থেকে ফিরে এসে আমরা বেলা একটা নাগাদ বুড়িগোয়ালিনী ঘাটে এসে উপস্থিত হই। ঢাকা ফেরার বাস সেই সন্ধ্যা সাতটায়, হাতে এখন তাই অখন্ড অবসর। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কাছেই পুকুর আছে, সুযোগটা আর হাত ছাড়া করলাম না। গোসল শেষে এলোমেলো ভাবে স্থানীয় বাজারটা ঘুরে দেখলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে মাইক্রোবাস এসে পৌঁছলে আমরা উঠে পড়ি। এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্যটা যেন আরো লাল আভা ছড়াতে মত্ত, আর সেই লালাভ আভায় সবার চোখে মুখে মলিনতা ভর করে। অসাধারণ দুটো প্রাণোচ্ছল দিন কাটানোর পর আবারও সেই কর্মময় জীবনে নিজেকে সপে দেবার প্রস্তুতি যেন সবার অলক্ষ্যে সেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে যান।




সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:২৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×