- এক্সকিউজ মি। একটু সরবেন?
আনমনে অনেক্ক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিকেল বেলা স্কুটারে করে এসে দীঘির এ পাড়ের কোন একটা বেঞ্চে বসে থাকি। কোথাও পড়েছিলাম। জলের সাথে থাকলে মন নাকি অনেক স্থির হয়। ভালই লাগে। দীঘিটাও অনেক বড়। অনেকেই বসে আমার মতো। ইনিও বসেন। আমি দেখেছি কয়েকদিন। হঠাত আমার বেঞ্চে এসে,,,,বুঝতে সময় লাগলো। চমকেও উঠলাম। দেখলাম অন্য বেঞ্চগুলোও ফাকা নেই। এখানকার বেঞ্চগুলোও বড়।এদিক ওদিক তাকিয়ে সরে গিয়ে বললাম,
- জ্বী আমি চলে যাচ্ছি। বসতে পারেন।
- না অমন সমস্যা হলে আমিই অন্য কোথাও যাচ্ছি। আপনি বসুন।
- আচ্ছা বসুন। আসলে মাত্র এলাম। রোদটা ভাল লাগছে।
- আপনাকে প্রায়ই দেখি।
- আপনাকেও কয়েকদিন দেখেছি। এই ছোট্টো জেলার তো আসলে এটাই শ্বাস ফেলার জায়গা।
এরপর আর কথা এগুলো না। আসলে কথোপকথন চালিয়ে নেয়ার মতো সামাজিক ক্ষমতা আমার নেই। বাদাম খেতে লাগলাম। হঠাত বলল,
- আমি ভেলা। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছি। আপনি?
- ও আচ্ছা। আমি পাশের গ্রন্থাগারে চাকরি করি।
আবার নিরবতা। বাসায় গিয়ে ছবি দেখার ইচ্ছে হলো হঠাত। উঠে গিয়ে স্কুটারে বসব বলে হাটতে শুরু করলাম।পেছন থেকে শুনতে পেলাম,
- শুনুন,,,,,,এই যে, আপনার বই টা নিয়ে যান।
- ধন্যবাদ আপনাকে। আরেকটু হলেই ফেলে যাচ্ছিলাম।
কয়েকদিন খুব ব্যস্ত গেলো। দীঘির পাড়ে যাওয়া হয়নি। শীতের শেষে যখন বিভিন্ন পোকামাকড় আমার হেলমেটের ভেতর উড়ে এসে ঢুকে তখন বুঝতে পারি বসন্ত এসে গেছে। ফাল্গুন মাস। নামটা উচ্চারণ করলেই মনে হয় যেন কেমন স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় মন। ছেলেদের নাম ফাল্গুন হয় কিনা মনে করতে করতে পরিচিত দীঘির বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। কি সুন্দর হয়ে আছে চারপাশ। চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা। কদিন বাদে বোধয় আমার এই স্বাধীনতাটা থাকবেনা। হাতে শীর্ষেন্দুর "চক্র" বইটার মলাটের উপর চোখ রাখতেই বুকটা হু হু করে উঠলো। চারদিক আরো মন ভরে দেখতে লাগলাম লোভাতুর চোখে। বিয়েটা বোধয় এড়ানো গেলো না। স্বাধীনতার কি ভয়ংকর অপমৃত্যু। ক্যামেরা,বই,হুটহাট বের হয়ে পড়া বাদ দিয়ে বাজারের ব্যাগ, মশারি টাংগানো, ইউটিলিটি বিলস,,,একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আর একটা দুটা বছর পেলে মন্দ হতো না। এমন সময় একজন কাছে এসে বলল,
- আপনি ভালো আছেন? আমাকে চিনতে পারছেন?
কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে সত্যিই চিনতে পারিনি। তারপর বললাম,
- ইয়ে মানে,,,,, খুব দুঃখিত। আমি মানুষের চেহারা আর রাস্তা ভুলে যাই।
- ঐ যে একদিন জায়গা ছিলোনা বলে এসে বসলাম এই বেঞ্চে।
- ওহ! আপনি ভালো আছেন?
- ভালো। আপনি কেমন আছেন?
- আমিও ভালো আছি।
- অনেকদিন পর এলেন, না!
- আসা হয়নি। আপনি কি আসেন প্রায়ই?
- প্রতিদিন।
কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আমি বইটা দেখতে শুরু করলাম। কিছুক্ষন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
- আচ্ছা যাই। ভালো থাকবেন। দেখা হচ্ছে।
আমি হাসি ফিরিয়ে দিলাম। বই পড়তে পড়তে হঠাত খেয়াল হলো। মানুষের জীবন এক অদ্ভুত চক্রে বাধা। মিসিং পিস জোড়া দেয়া ছাড়া আর কিছুই নেই। স্বাধীনতাই নেই। এর কয়েকদিন পর বহুত আয়োজনের মাধ্যমে এবং ভয়ংকর শব্দদূষণের মাধ্যমে আমার সারাজীবনের শান্তিময় নিরবতা ভেংগে বিয়ে হয়ে গেলো। কোথা থেকে কি হচ্ছিলো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবে একসময় এসব শেষ হলো। আমি শুধু ঘরে একা হতে চাচ্ছিলাম। বিছানাটা খুব মিস করছিলাম। নিজের মতো করে একা হতে গিয়ে টের পেলাম ঘরে আরো একজন আছেন। গ্রন্থাগারে যারা চাকরি করেন তারা নিরবতায় এত বেশি অভ্যস্থ হয়ে পড়েন যে তাদের জন্য এই হৈ হুল্লোড় অনেক বেশি ক্লান্তিকর হয়ে পড়ে। আমারো ব্যাতিক্রম হয়নি। তাই নতুন বিবাহিত বধুর চেয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। এই সামাজিক কথোপকথনের রোগটা সারাতেই বোধয় আমাকে বিবাহিত হতে হলো। এসব ভেবে খানিকটা অস্বস্তি লাগছিলো। বললাম,
- আপনি খুব ক্লান্ত হয়ে থাকবেন এতসবের পর। রেস্ট নিয়ে নিলে ভালো লাগবে। ইয়ে মানে,,,আমি খুব ক্লান্ত। কিছু মনে করবেন না। আমি ঘুমাতে চাই। আমার শব্দ সহ্য হয় না। মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
ঘোমটার ভেতর থেকে শব্দ এলো।
- হু।
বই খোঁজ করার দরকার হলো না। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠেই চোখ বোঝা অবস্থায় চুলের ঘ্রাণ টের পেলাম। চোখ মেলতেই আমার সময় থেমে গেলো। কোন এক অদ্ভুত মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো আমার সর্বস্ব। একটু পর তিনি চোখ খুললেন। কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। তিনিও কপট রাগ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। প্রশ্ন করলাম,
- আমার না মানুষের মুখ আর রাস্তা মনে থাকেনা। আপনি কি?
- হ্যাঁ। মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলবেন। তাহলে ভুলবেন না।
- তু,,, তুমি কি প্রতিদিন,,,
- বিয়ের কথা চলছিলো। তাই আপনার সম্পর্কে জানতে প্রথম কয়েকদিন মিতি কে নিয়ে যেতাম। আমার বান্ধবী। পরে একাই যেতাম। আপনি ওখানে বসেন প্রায়ই কোনভাবে জেনেছি।
- আমার নাম,,,,
- তোমার নাম শরৎ । তুমি কি জানো,,,,, আমি কতদিন তোমার জন্য ঐ বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করেছি?
বলেই হাসতে লাগলো। এতো সুন্দর করে কখনো কেউ আমার নাম উচ্চারণ করেনি।