আমার বাঁশি শেখার গল্প -১
দুই মাস পর ।
এমবিএ পড়ার সুবাদে ইউনিভার্সিটির হোষ্টেলে একটি এক্সিকিউটিভ রুম পেয়ে গেলাম। কয়েকজন ফ্রেন্ডও পেয়ে গেলাম, যারা আমারই সাথে এমবিএ করছে। তাদের মধ্যে একজন এনাম ভাই। দেশের বাড়ী চাঁদপুর। বাঁশি বাজাতে পারতেন। খুব একটা এক্সপার্ট না, নিজে নিজেই শিখেছেন, দুএকটা গানের সুর তুলতে পারেন। তাঁর সাথে আমার বিশেষ ভাব হয়ে গেলো। উনি ছিলেন ফুল টাইম ষ্টুডেন্ট, আমি পার্টটাইম। প্রথমে আমি ফুল টাইম ষ্টুডেন্ট হিসেবেই ভর্তি হয়েছিলাম। তখন থেকেই পরিচয়। এক সেমিষ্টার পর আমি পার্টটাইমে চলে এসেছি। হোষ্টেলে এসে সখ্যতা বেড়ে গেল। একদিন আমার রুমে বাঁশি পেয়ে উনার ভেতরের বহু পুরাতন শিল্পীসত্ত্বাটি জেগে উঠল। সুর তোললেন বাঁশিতে। পল্লীগীতির সুর। অবলীলায় বাজিয়ে গেলেন কিছুক্ষন। ধরলাম - আমাকে শেখাতে হবে। বললেন মুখ বাশি যোগাড় করতে। মুখবাশিতে ফুঁ দিলে এম্নিতেই সুর বের হয়। আঙ্গুল দিয়ে ছিদ্র খোলাবন্ধ করে যেকোন সুর তোলা যায়। কিন্তু আঁড় বাশির মতো এত শ্রুতিমধুর হয়না। আমার সব কয়টি বাঁশিই আঁড় বাশি। হাত একপাশে রেখে বাঁশিকে বামদিকে বা ডানদিকে শরীরের সাথে সমান্তরাল রেখে বাজাতে হয়। আর মুখ বাঁশি শরীরের সাথে লম্বালম্বি করে ধরে দুই হাত সামনে এনে বাজাতে হয়। সানাই কিংবা সাপুরেরা যেভাবে বীণ বাজায় সেভাবে। ছোট বেলায় মেলায় গিয়ে এরকম বাঁশি কিনেছিলাম দুএকবার। ইউনিভার্সিটির সামনে লাবু ভাইয়ের কাছ থেকে একটি মুখ বাঁশি কিনলাম। এনাম ভাই কোন আঙুলের পর কোন আঙুল তুলতে হবে দেখিয়ে দিলেন। দেখলাম পারছি। সেই মুখবাঁশিতে সুর বাজিয়ে আমার সেকি আনন্দ। মনে হচ্ছে বড় শিল্পী হওয়া আর কয়েকমাসের দেরী মাত্র। আমিও বাজাব গাজী আব্দুল হাকিমের মত। এভাবে কয়েকদিন বাজানোর পর একদিন দেখলাম আঁড় বাশিতে ফুঁ দিয়ে সবকয়টি ছিদ্র দিয়ে মোটামুটি শব্দ বের করতে পারছি।
প্রতিদিন রাতে হোষ্টেলে ফিরে এনাম ভাই আর আমার আনলিমিটেড আড্ডা চলত। আড্ডার বেশীরভাগ জুড়েই থাকতো বাঁশি। বাঁশির কয়েকটি সিডি কিনলাম। আব্দুল কাদের, আব্দুল বারী (পরে জানলাম উনি হচ্ছেন বারী সিদ্দিকী – এতদিন উনাকে গায়ক হিসেবেই চিনতাম, উনি যে মুলত একজন বাঁশিশিল্পী তা জানলাম পরে)। বাঁশিতে সবকয়টি ছিদ্র দিয়ে শব্দ বের করতে পারলেও হাজারো কসরত করে সিডির মতো কিংবা সেগুলোর সুরের ধারে কাছেও যেতে পারতাম না। এনাম ভাই ও পারতেননা। কিন্তু একটু একটু ইম্প্রুভ করতে লাগল। লাবু ভাইয়ের সাথে আস্তে আস্তে সখ্যতা বাড়াতে লাগলাম। উনার বাজনা স্বর্গীয় মনে হত। অনেক বাঁশি কিনলাম উনার কাছ থেকে। সেইসব বাঁশিতে উনি অনেক সুন্দর সুন্দর টিউন বাজাতেন। কিন্তু রুমে এসে এনাম ভাই কিংবা আমি কেউই সেরকম বাজাতে পারতাম না। নিজেরা চেষ্টা করে টুকটাক যা বাজাতাম তাই ভাল্লাগতো। এভাবে বছরখানেক চলল। এনাম ভাইয়েরও এমবিএ শেষ হতে চলল। আমার মাত্র অর্ধেক কোর্স শেষ হল। একই সময়ে একদিন এমবিএর কোর্স ড্রপ করে আমাকে অফিসের কাজে সিংগাপুর চলে যেতে হল। এনাম ভাই তখন ইন্টার্ণশিপ শুরু করছেন। ইতোমধ্যে আমি বাঁশির আরো অনেক সিডি কিনেছিলাম। যখনই সুযোগ পেতাম তখনি চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনতাম – সারাদিনই মনে মনে ধ্যান করতাম।
সিংগাপুরে একটি বাঁশি নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতের বেলা বাসায় ফিরলে বাজাতাম আর ছুটির দিনগুলোতে একটু বেশী বাজানোর চেষ্টা করতাম। মেইলে এনাম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হত। উনি একটি ব্যাংকে ইন্টার্ণশীপ করছেন। বাজানোর সময় পাননা। একদিন শুনলাম বিশ্বের প্রথম সারির একটি ব্যাংকে উনার চাকুরী হয়ে গেছে । হোষ্টেল ছেড়ে চিটাগং চলে গেছেন। পাঁচমাস পর হোষ্টেলে ব্যাক করলাম। হোষ্টেলের চেহারা কেমন যেন বদলে গেছে। আমার ক্যাবল টিভির কানেকশন কেটে দিয়েছে, ইন্টারনেট এর কানেকশন কেটে দিয়েছে। ব্যাচমেটরা বেশীরভাগই বিভিন্ন জায়গায় চাকুরী নিয়ে চলে গেছে। পরিচিত মুখের সংখ্যা কমে গেল। কিছুটা ঘরকুনো হয়ে গেলাম। চাকুরী, পড়াশুনা আর মাঝে মাঝে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সময় কাটাই।
এভাবেই কেটে গেল আরও বছরখানেক। ধীরে ধীরে উৎসাহ স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল। সংসারজীবনে জড়িয়ে পড়লাম। এমবিএ কোর্স শেষ হল। হোষ্টেল ছেড়ে আলাদা বাসা নিলাম। চাকুরী বদল করলাম দুইবার। প্রথমটিতে কিছুটা ব্যস্ততা বাড়লেও পরেরটিতে ওয়ার্কলাইফ ব্যালেন্সএর সুবিধা ছিল। আটটা পাঁচটা অফিস, শুক্র শনি দুইদিন বন্ধ। কিছুটা সময় পাওয়া যেত। এরকম একটা পরিবর্তনে আমি যে একটা সময় বাঁশি বাজাতাম সেটা ভুলেই যাচ্ছিলাম । রাস্তা দিয়ে কাউকে যখন বাঁশি বাজাতে শুনতাম তখন আবার বাঁশিগুলো খুজে বের করে দুএকটা ফুঁ দিতাম। আশেপাশের মানুষজন বিরক্ত হত। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত এনাম ভাইয়ের সাথে। বিয়ে করেছেন। একটি পুত্র সন্ত্বানের বাবাও হয়েছেন। বাঁশি বাজানই না। সময় পান তো সুযোগ পাননা। সুযোগ পানতো সময় হয়না। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ১১:৪০