শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এই লেখাটা কাউকে আঘাত করা, বা ছোট করার জন্য নয়। আমার অন্য সকল লেখার মতই এটা আমার ব্যক্তিগত চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।
বিগত এক বছর যাবৎ আমি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করি। এই এক বছরে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা যেন আমার লোপ পেয়ে গেছে। আমি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে আমার শিক্ষা, আমার মানসিকতা একটা প্রজন্ম গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কিসের কি, নিজের লেখা পড়াও ভুলে যাচ্ছি আমি ছাত্র-ছাত্রীদের খাতা পড়ে।
ধন্য আমাদের শিক্ষামন্ত্রী, যিনি বলেন, পাশের হার বাড়ানো হোক এবং জিপিএ বাড়ানো হোক। এর ফলাফল, আজ জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে না। নিশ্চয়ই ভর্তি পরীক্ষার প্রথাটাই ভালো না, তা না হলে এত ভালো ভালো স্কুলের ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা যেখানে চান্স পাচ্ছেনা, গেঁও ভুতগুলো পাচ্ছে কি করে? ভর্তি পরীক্ষার সিস্টেমটা আসলে সেকেলে, এটা বদলে লটারি সিস্টেম চালু করা উচিৎ।
এমনই কিছু সুশিক্ষিত, সরকারী সুবিধা বঞ্চিত, কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে আমাদের আজকের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে দেশে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪টি, সেখানে ইউজিসি অনুমোদিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭০টি। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে সর্বমোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুন। তার মানে, শ্রম বাজারে এখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্ত। তাছাড়া, সেখানকার শিক্ষার্থীদের ফলাফলও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো। সেখানে জিপিএ ৪ পাওয়া অর্থাৎ ফাস্ট ক্লাশ ফাস্ট হওয়া ছাত্রের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এরাই দেশের ভবিষ্যৎ। আমাদের জাতির মুখ এরা উজ্জ্বল করবে।
আমি বাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যতখানি জানি, হাতে গোনা ৪/৫টা ছাড়া মোটা-মুটি সবগুলোর একই অবস্থা। তাহলে ব্যাঙের ছাতার মত একগুলা বেসরকারী বিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে কি বিদ্যা বিতরণ চলছে? রেজাল্ট দেখলে মনে হবে এক একজন জ্ঞানের জাহাজ। জিপিএ_এর ছড়াছড়ি। কথা বললে হা হয়ে থাকতে হয়, মনে হয় যেন আমি ক্লাশ ২ তেও এর থেকে বেশি জানতাম। আমি বলছি না ভালোরা নেই, আমি বলছি না সব বিশ্ববিদ্যালয় এক রকম, আমি এও বলছি না সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় মানেই সবাই ভালো, কিন্তু আমি দেশের অন্তত ৭০% শিক্ষার্থীর কথা বলছি, যারা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নিয়ে কিছুই না জেনেও সেকেন্ড ক্লাশ পেয়ে যাচ্ছে।
আমি জানিনা এর পেছনে কে বা কারা দায়ী। তবে এই এক বছরে মনে হয়েছে, প্রবাদ পরিবর্তনের যুগ এসেছে। এক সময় প্রবাদ প্রচলিত ছিল, যার নাই কোন গতি, সে করে ওকালতি। এখন তো দেখছি, তার যোগ্য পেশা হচ্ছে শিক্ষকতা। সংগত কারনেই দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের পর শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজীতে। আমি আমার কলিগদের ইংরেজি দেখে এই বাচ্চাগুলোকে আর কিছুই বলতে পারিনা। যারা ওদের পরীক্ষার খাতার বিচার করছে, তাদের ক্ষমতা নিয়ে আমার সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন অবস্থা হবে না_ই বা কেন? এখন কোন রকম মাধ্যমিক পাশ করলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়। বেশির ভাগ স্কুলেই শিক্ষকের দেখা মেলা ভার। মাধ্যমিক পাশ একজন ব্যক্তি নিজেই কতখানি জানে যে আর একজনকে শেখাবে? আমার মতে, জ্ঞান বিতরন করলে কমে। আমি হয়ত ৫টা বই পড়ে আমার ক্লাশ লেকচার দিলাম। ৫টা বই থেকে আমি কতটুকু নিতে পেরেছি, এটা একটা বিষয়, কতটা দিতে পারছি সেটা একটা বিষয়, ছাত্র-ছাত্রীরা কতখানি নিতে পারছে সেটাও একটা বিষয়। এতগুলো হাত বদল করে যে শিক্ষা, তার কতটুকু পাওয়া যায় বই না পড়ে?
স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী অনেক শিক্ষিত মানুষই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে ধারন করে গর্ব করছেন। “এটা রিলাক্স জব। সারাদিন কাজ করব না, ৯টা-৫টা অফিস করবনা বলেই তো শিক্ষকতা করতে আসা”। এমন বক্তব্য আমার অনেক সহকর্মীর। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা কি এত সহজ? অফিস না হোক, রিসার্চের কাজ না করলে, কিসের শিক্ষক? কেউ ক্লাশ করানোর আগে পড়াটা একবার ঝালাই করে নেয়াটাকে রীতিমত গর্হিত কাজ ভাবা হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে ইউনিভার্সিটির জীবনে কি শিখে আসলাম, এমনই মনভাব। শিক্ষকরা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে নম্বরকে। কে কত বেশি নম্বর দিতে পারে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা। আর ছাত্র-ছাত্রীরাও এই সুযোগ নিচ্ছে।
দেশে এখন কমিউনিকেটিভ ইংরেজ়ী শিক্ষা চালু আছে। এটা শুনলেই আমার মনে পরে, মনের ভাব প্রকাশ করার নাম-ই ভাষা। তার অর্থ হচ্ছে, ব্যাকরনের বালাই নাই, কোন রকম মনের ভাব প্রকাশ করা গেলেই হল। কে কার সাথে কমিউনিকেট করছে সেটা হচ্ছে মুখ্য। শিক্ষক হবে বাবা-মায়ের মত। যারা সন্তানের মনের কথা সে মুখে না বললেও বুঝে নিতে জানে। এবং সেটা বুঝে নিয়েই খাতায় নম্বর দিতে হবে। শিক্ষকের ঠেকা। তা না হলে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে। ছাত্র-ছাত্রী কমার ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দেবে, স্রোতে গা ভাসাতে না পারলে চাকুরি ছেড়ে দিতে।
এই দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে, তাই আপনাদের বিরক্ত করলাম। কোন শিক্ষক এই লেখা পরে ব্যক্তিগত ভাবে নেবেন না, কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এই লেখায় সংখুব্ধ হবে না, এই আশা করি।