ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে। এইযে এখানে যে মেয়ে হোস্টেলটা দেখছেন ঠিক এই জায়গাটায়।
সোলেমান চাচা কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেল। সোলেমান চাচার সাথে আমার পরিচয় সপ্তাহ খানেকের। লোকটার ভুতের গল্প বলার বাতিক আছে। এই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমাকে তিন তিনটে ভূতের গল্প শুনিয়েছে। আরো একটা ভূতের গল্প শোনার আভাস পেয়ে আমি নড়ে চড়ে বসলাম।
সোলেমান চাচা চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে গল্প শুরু করলেন।
তখন এই এলাকায় দাপট ছিল খাঁ বংশ আর মল্লিক বংশের। খাঁ বংশ মুসলমান আর মল্লিকরা ছিল হিন্দু। হিন্দু মুসলমান একসাথে থাকলে যা হয় আর কি। সামান্য ইস্যুতেই লেগে যেত ঝগড়া মারামারি।
খাঁ সাহেবের নাতনি ছিল সালমা বানু। তখন আমার যুবক বয়স। মাঠে ঘাটে কাজ করি আর খাঁ সাহেবের নাতনির গল্প শুনি। মেয়ে ছিল যাকে বলে রূপে গুনে অনন্যা।
সোলেমান চাচা আমার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে আবার কথা শুরু করলেন।
একদিন সন্ধ্যায় মাঠে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি। এইযে এই হোস্টেলটা দেখছেন। তখন এই জায়গাটা ছিল জলা। জলার পাশ দিয়ে ছিল একটা পায়ে হাটার পথ। গ্রামে যাওয়ার সর্টকাট রাস্তা।
সেই জলার পাশে এক গাছের কাছে আমি সালমা বানুকে দেখলাম।
সোলেমান চাচা কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেলেন। রাতের হলুদ বাতির আলোয় তার চোখ চকচক করতে লাগল। লোকটার চোখ দুটো হলুদ। কোটরে বসা। দারিদ্রতার ছাপ সারা মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সোলেমান চাচা খচখচ করে ময়লা দাড়ি চুলকালো। তার পর কোঁচকানো কপালে জমে যাওয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বলল,
মেয়েটাকে কারা যেন মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। গায়ে একটা সুতাও ছিল না। অথচ দেখে মনে হচ্ছিল কে যেন তার লম্বা দীঘল কাল চুল দিয়ে আব্রু ঢেকে দিয়েছিল। সালমা বানুর চোখ দুটো খোলা। গলায় ফাঁস দেওয়া। হাতে পায়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। মেয়েটা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। আমি মেয়েটার চোখে করুন আর্তি দেখেছিলাম। যেন ডেকে ডেকে বলছিল আমায় বাঁচতে দাও।
সেই সন্ধ্যার আলোয় একটা রূপবতী মেয়ের লাশের সামনে দাড়িয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দৌড়ে বাসায় পালিয়ে আসলাম।
আমি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, 'পালিয়ে আসলেন!? লাশটার কি হল?'
সোলেমান চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ' সাত দিন পর লাশটার খোজ পেল গ্রামের মানুষজন। পচা গলা লাশ। চোখ দুটো খুলে পড়ে গিয়েছিল। গাছে ঝুলানো ছিল বলে শুধু পা দুটো হাটু থেকে ছিড়ে খেয়েছিল শেয়ালে। '
-'আপনি কাওকে জানালেন না কেন?'
'ভয় পেয়েছিলাম। সুন্দরী মেয়ের লাশ। আমি একলা ছিলাম। যদি পুলিশ আমাকেই ধরত। '
আমি সোলেমান চাচার দিকে খালি চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, ' সেতো বুঝলাম। কিন্তু ভূত আসলো কখন?'
সোলেমান চাচার চোখদুটো জ্বলে উঠল। চায়ের কাপ ধুতে ধুতে আপন মনেই বলে যেতে লাগল।
প্রথম সালমা বানুকে দেখে আমাদের গ্রামের কিশলুর ছেলে রনি। দুপুর বেলা ঐ জলার পথ দিয়ে বাড় ফিরছিল। হঠাৎ করেই শুনতে পায় একটা মেয়ে বিলাপ করে কাঁদছে। কান্নার শব্দ শুনে কাছে গিয়ে দেখে সালমা বানু। চোখের কোটরে চোখ নেই। হাটুর নিচে পা নেই।
ছেলেটা সাতদিন জ্বরে বিছানায় পড়েছিল। তারপর বহু মানুষ ঐ রাস্তায় সালমা বানুর ভূত দেখেছে। অবশেষে এখানে ভার্সিটি বানানো হল। জঙ্গল সাফ হল। বড় বড় দালান উঠল। আমরা ভাবলাম সালমা বানুর আত্মা বুঝি মুক্তি পেল।
আমি বললাম, 'তো শেষ মেষ সালমা বানুর ভূত কোথায় গেল?'
'কোথাও যায়নি। এখানেই আছে।' এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল সোলেমান চাচা।
জৈষ্ঠের গরমের রাতে হঠাৎ করেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। চালায় ঝোলানো ষাট ওয়াটের হলুদ আলোটা সেই বাতাসে কেঁপে উঠল। আলো ছায়ার নাচানাচি তে অন্ধকার রাস্তায় মনে হল একটা অশরীরী বাতাস ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি কোন রকম ঢোক গিলে বললাম, 'এখানে আছে মানে?'
'মানে এই হোস্টেলেই থাকে সালমা বানু। '
-'আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাই না?' আমি চোখে মুখে হাসির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম।
না। হোস্টেলটা হওয়ার পর আমি এখানে চায়ের দোকান দিলাম। সঙ্গে টুকিটাকি খুচরা জিনিস বিক্রি করি। ভালই চলতে লাগল। সাতটা বছর কোন রকম উপদ্রপ ছাড়াই কেটে গেল। সালমা বানুর কথা ভুলতে বসেছিলাম। তারপর এমনি এক জৈষ্ঠের রাতে দেখলাম তাকে। দোকান বন্ধ করে বাসায় যাব। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম। চিৎকারটা হোস্টেলের দিক থেকে আসছিল।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। হোস্টেলের ই একটা মেয়ে ছাদের রেলিং এর উপর দিয়ে দোড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম। সেই সালমা বানু। সেই চোখ। এতদূর থেকেও আমার চিনতে একটুও আসুবিধা হল না। মেয়েটাকে ধাওয়া করে ছাদ থেকে ফেলে দিল।
আমি শুকনো গলায় বললাম, 'তারপর কি হল?'
- 'তারপর আর কি স্পট ডেড। কতৃপক্ষ অবশ্য সুইসাইড বলে চালিয়ে দিয়েছিল। '
পরে আরো একটা মেয়ে মারা গিয়েছিল। সেই ঘটনার ঠিক সাত বছর পর। মেয়েটা গলায় ফাঁস নিয়েছিল। চোখদুটো ঠিকরে বাইরে বের হয়েছিল। দেখে মনে হয়েছিল কে যেন খেজুরের কাঁটা দিয়ে খুচিয়ে বের করে এনেছে।
আমি ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিয়ে বললাম, ' সাত বছর পর ব্যাপারটা বুঝলাম না। সাত বছর পর পর কেন সালমা বানু খুন করবে?'
সোলেমান চাচা কেতলির পানি গরম করতে করতে নির্বিকার ভাবে বলল, ' তা আমি জানিনা। তবে আজ সাত বছর পেরোচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আজ একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। '
'কচু হবে।' বলে আমি চায়ের দাম দিয়ে উঠে পড়লাম।
আমি রাস্তায় হাটছি। চারিকিদিকে আমাবস্যার অন্ধকার। জৈষ্ঠের গরমে ঘামে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। সুনশান রাস্তা। হঠাৎ আমার মনে হল আমার আশেপাশে কেউ আছে। ফিসফিস করে আমাকে ডাকছে। 'এস অর্ক, আমার কাছে এস।'
দূরে দেখা যাচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে দানবের মত একটা ট্রাক ছুটে আসছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ডাকটা ঠিক ঐ দুই হেডলাইটের মাঝখান থেকে আসছে।
আমি হাটছি সম্মোহনের মত। মাঝ রাস্তা দিয়ে। চারিদিকে আমাবস্যার অন্ধকার। জৈষ্ঠের গরমে ঘামে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। আমার ডাক এসে গিয়েছে। আমি চলেছি এক স্বপ্নের মায়ায় স্বপ্নলোকে।