ঢাকা-আঙ্কারা কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে গতকাল আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে তুর্কি সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে একটি তুর্কি প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর এবং তাদের তত্পরতাকে কেন্দ্র করে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে তুর্কি সরকারকে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য আঙ্কারাকে সতর্ক করেছে ঢাকা। বাংলাদেশের এ প্রতিক্রিয়াকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি তুরস্ক। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আঙ্কারায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমানকে তলব করে। তুর্কি সরকারের অসন্তোষের কথা রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যাদের বিচার করা হচ্ছে তারা এতটাই বয়স্ক যে, তাদের এ ধরনের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত নয়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট চিঠিতে আরও বলেন, এ বিচার প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের ওই চিঠি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। তাদের ধারণা, ওই চিঠি যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের প্রচেষ্টার শামিল এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের চিঠির পর ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ নিয়ে তুরস্কের এনজিও ক্যানসুয়ু এইড অ্যান্ড সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশনের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা সফর করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। এদের মধ্যে ছিলেন তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এ কে পার্টি ও সাদেত পার্টির প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ সফরের সময় তুরস্কের প্রতিনিধি দলটি যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নুল আবেদীন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু, আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই সফরের সময় সরকারের পক্ষ থেকে কিছু না বলা হলেও প্রতিনিধি দলটি চলে যাওয়ার পর ২৬ তারিখ ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সরকারের অসন্তোষের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মুস্তাফা কামাল তার কাছে সরকারের অসন্তোষের বিষয়টি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান উল্লেখ করে মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে একটি কূটনৈতিক পত্র (এইড মেমোয়ার) দেয়া হয়। পত্রে কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আশা করে, তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো বন্ধুদেশ হস্তক্ষেপ করবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব কথা বলেন। এ সময় তিনি তার কাছে এটিও জানতে চান, তুরস্কের এনজিও ক্যানসুয়ু এইড অ্যান্ড সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশনের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার দিন অর্থাত্ গত ২০ ডিসেম্বরই বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কেন জানানো হয়। তাদের আসার আগে বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হলে সরকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারত। এ সময় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত জানান, তিনি ওই দিন অর্থাত্ ২০ ডিসেম্বর আঙ্কারা থেকে তাদের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানানোর নির্দেশনা পান।
এদিকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত এটা বোঝাতে চেয়েছেন, তুরস্কের প্রতিনিধি দলটি গত ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা সফরের সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে কোনো রকমের দূতিয়ালি করতে আসেনি; বরং বিষয়টি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফর করেছে।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই জানানো হয়, প্রতিনিধি দলটি যেভাবে বাংলাদেশে এসেছে এবং এ সফরের সময় দলটি যেসব কর্মকাণ্ড করেছে, তাতে সরকার উদ্বিগ্ন। কারণ ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’র অপব্যবহার করে তুরস্কের প্রতিনিধি দলটি সঠিক কাজ করেনি। তাছাড়া কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি কিংবা সমস্যা তৈরি করা কোনো বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের কাজ নয় বলে বাংলাদেশ মনে করে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আশা করে, আগামীতে এ ধরনের কিছু ঘটবে না। বাংলাদেশের এ অবস্থান তার সরকারের কাছে জানাতে তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের এ পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে গতকাল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার চায় ঘটনার এখানেই সমাপ্তি হোক; তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন ঘটনার এখানেই শেষ হবে বলে মনে হয় না।
Click This Link