জ্বরের ঘোরে
যখন শরীরে জ্বর, তখন পৃথিবীটা রেলগাড়ি। ঘোরের মধ্যে এক একটি স্টেশন। এক একটি শীতার্ত সকাল। কতোগুলো পুরনো মুখ। বেগবান তেজি ঘোড়ায় জোড়া টমটম গাড়ি। সন্দেশ আর পানিওয়ালা হকারের চিৎকার।
জ্বর মানেই চোখের সামনে ভেড়ামারা, খোকসা। ভাঙা মন্দিরে পাঁঠাবলির উৎসব থেকে পালিয়ে আসা। কালুখালি স্টেশনে হাঁসের ডিমের ওমলেট দিয়ে বনরুটি আর রামদিয়ার মটকা। আলাউদ্দিনের চুলের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মসলা পানের গোপন রেসিপি।
জ্বর মানে ফটিকের বাড়ি ফেরা। খালাসির পানিমাপা গান। আমার মায়ের মলিন মুখ। অভিমানী বাবার শ্যাঁওলা পড়া চোখে বোকা চাহনি। পোষা কুকুরের লঞ্চের পেছনে ছোটা। নদীর পারে আচমকা জন্মানো কাঁটাওয়ালা বেগুনি ফুল।
জ্বর মানে অভিমানী বোন, স্কুলের ভালো লাগা শ্রীমতি স্মৃতিকণা শিকদার। প্রথম প্রেমের চিঠি লোপা আর বিদগ্ধ বসন্তের ধুলো ওড়া দিন- লেবুফুলের মাতাল গন্ধ, সাপের একেবেঁকে চলা ধুলি ধূসর পথ। প্রাণহীন কবির কবিতায় প্রাণের স্পন্দন।
জ্বর মানে মীরাবাঈ আর সন্তোষদের ভারত চলে যাওয়া। জ্বর মানে পূর্ব পুরুষের শেষকৃত্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখা। জ্বর মানে অভিমানী বন্ধুর শোক, বিদেশে আত্মগোপন। মাটলা, তেঁতুলিয়া আর মধুমতি নদী, ভাদ্রে রাত্রি যাপন-
আসলে জ্বর মানে কিছুটা সময় সব কিছু ভুলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া...
ফাঁদ
শব্দের মাধুর্য আর আবেগের ফাঁদ পেতে মানুষ-
আসলে লুকোতে চায় নিজের চাতুর্যতা, নন্দনের
অপর পিঠ কখোনোই বোঝেনা, কেমন কদর্য লুকিয়ে
সেজে আছে নতুন বধু।
মুদ্রা উল্টাতে হলে উল্টাতে হয় নিজেকেও
তারপর, আলো আঁধারের হিসেব নেওয়া যায়
সময়ের কাছ থেকে; বুঝে নেওয়া যায়-
কে পাবে বাঘের মাথা অথবা শাপলা ফুল।
কে কাকে কতোটা বেসেছে ভালো- তার উত্তরে
উত্তরের গোলার্ধ কখনো ওঠেনা কেঁপে,
অথচ গাছ বুঝে যায় প্রেমিকের নিগূঢ় অনুভূতি-
ফলে, পাতা ঝরায় সেও।
হতে পারে এ সেই গাছ; একান্ত আনমনে, সকলের
অবহেলায়- জন্মেছে পথের ধারে। তারপর না চাইতেই
রাশি রাশি গন্ধহীন, সৌন্ধর্যহীন সাদা সাদা ফুল-
অবশেষে ফুলগুলো কালো হয়, ঝরে যায়, অবহেলায়।
দেবতার পুষ্পার্ঘে যে ফুল খেলা করে- গঙ্গাজলে
ঝরে যাওয়া ফুল, তারই স্বগোত্রীয় কিনা-
জানা হয়না উত্তর তার, না পূজারির-না দেবতার...
দহন
হাত দিয়েছি বুকে খুঁজে নিতে কয়লা খনির
হিরে আবিষ্কারের সূত্র। পেলাম
শূন্যতা। একটি মাত্র ‘জোস্’ অথবা ‘জটিল’
জটিলতার দ্রবীভূত বুদবুদ ছাড়া হাতে ওঠেনি কিছুই!
এ নিঃসীমতা; অপূর্ব দহন-
হেমন্তের মতো হলুদ ক্যানভাসে গান গায়।
আমার প্রিয়তা পছন্দের গণ্ডি পেরিয়ে হাঁটে-
ঘাটে গিয়ে খোঁজে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন
শিকারির পায়ের চিহ্ন, কাদার কলঙ্কিত আবেশী
বুকের ভাঁজ- শিকারির পরাজয়ের গল্প লেখে।
এরপর আর মাছদের বলতে হয়না, বাবারা-
কেন জল ছেড়ে বারবার পাহাড়ের চূড়ায় ওঠো!
এবারের শীতে নাকি অনেক পাখি এসেছিল দেশে
ভিনদেশী এসব ডানার আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ নয় বঙ্গীয় কাককুল
অথচ মানুষ জানে, অতিথি মাংসের স্বাদ- কল্পনার চাইতেও বেশি!
ঝুলে আছি
পাইনা;
স্রোতে গড়ানো নিবিড় পরিচর্যায়
খোয়া যাওয়া মন! কেবল-
অস্তিত্ব বিলীন শামুকের বুক থেকে
ভেসে আসে করুণ কান্না ভেজা ঢেউ
সঙ্গীত; এই সমগ্র প্রার্থনা কর্মের
কি কোন মানে থাকে, ভূ-গোলের তট রেখায়?
একদিন চৈত্র সংক্রান্তির দিনে
মেলায় যাওয়ার পথে-
উড়ুক্কু কালবৈশাখী উড়িয়েছিল আমায় দিগ্বিদিক
‘ধুলোর আঁচলে’। সেই থেকে ঝুলে আছি
জটা পাগলার উদ্বাহু বগলের ঘামে।
কোকিল
যে কোকিল ডেকে যাচ্ছে রাতের নীরবতা ভেঙে
তার মিষ্টি স্বর জানে- ভোর আসছে।
ধুলোর শহরের মলিনতা মুছে দিয়ে আসছে
ফাগুনের সতেজ সকাল। তাই, নির্ঘুম কুকুরেরও
আবদার নাইটগার্ডের বেসুরো বাঁশির কাছে।
এই বসন্ত আক্রান্ত কোকিল; নিঃচ্ছিদ্র বিনিদ্র রাত-
ক্ষুদার্ত বিশ্বস্ত কুকুর, এরা কি জানে- এক
মায়ামাখা বুক- কি এক অজানা ব্যথায়, চিনচিনে
অভিঘাতে, কত কত রাত; কেটে যায়-
বিদায়ী কুয়াশায়!
কে কাকে জাগিয়েছে এতো; এতো কাল!
প্রশ্নের ইশারায় ভরাট হয় এস্ট্রের বুক, খালি হয় পানির বোতল।
আমি নির্ঘুম থাকি। না ঘুমানোর অপরাধে অভিশাপ দেয় বিগত রাত।
তবু জেগে থাকি, ভোরের শব্দ শুনি, শুনি সতেজ বাতাসের শব্দ...
মেঘ
দিনরাত জেগে থাকা অদ্ভুতুড়ে সবুজ মেঘ-
ঢেকে রাখে রক্ত হৃদয়, তাই কদমফোটা মুগ্ধতা
লোভী ইঁদুরের মতো গোগ্রাসে গিলতে থাকে
সোনালি চারপাশ-পৃথিবীর।
ফলে এতোদিন যারা কেবল হাহুতাশ (বাতাস) নিয়ে কথা বলতেন, তারাও প্রজাপতির ডানায় জমাতে শুরু করলেন রঙের হিসেব। আর এইসব হাবিজাবিতে অনভ্যস্ত কাঁঠবিড়ালি ছানা হঠাৎ বুদ্ধিজীবী কণ্ঠে বলে বসল, ‘আমার মা গতকাল পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। শুনেছি মানুষ নাকি এখন বিষটোপ ব্যবহার শুরু করেছে।’
ছানা বিড়ালির এ (হঠাৎ) উচ্চারণ শোক সংবাদ নাকি সতর্ক সংকেত! উপস্থিত কেউই তার কূল কিনারা করতে না পেরে দাঁত কেলিয়ে সভা অনির্দিষ্ট কালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করল!
পাতা
পাতার জীবনী লিখতে গিয়ে মেঘ; প্রায়ই লিখে ফেলে
ব্যক্তিগত ওড়াউড়ি আর ঝরে পড়ার গল্প!
উষ্ণ বেলাভূমির সিলিকনে আটকে পড়া
লবন পোকাদের গায়ের গন্ধ সে চিনতে পারে
চিনে নিতে পারে ঝরার আগে ডানায় খেলে যাওয়া
সূর্যের রং- কিভাবে, কতোটা তাকে করেছিল স্বাপ্নিক-মোহিত
বাতাসের পাঁজর ভেঙে ভেঙে অসম্ভব দাম্ভিকতায়
যতো সাদা-কালো, লাল মেঘ সিংহের গর্জন শোনায়
পাতাদের, তার কতোটাইবা ধারণ করে সমুদ্র
তার সন্তানের সম্ভাবনার কথা ভেবে-
‘কোনো পাতা ঝরলেই নাকি জবাবদিহিতা আছে
ঈশ্বরের! অথচ জীবন ঝরালেও নিরুত্তর থাকা যায়
মনুষ্য সমাজে’- পাতার জীবনী লিখতে গিয়ে মেঘ
লিখে ফেলে এমন বাক্য তাই ঝরে পড়া তারও
নিশ্চিত হয়ে যায়!