সকালে ঘুম থেকে উঠলেই লুৎফর বাবুর ইদানীং কী যেন হয়। কাজে যেতে ইচ্ছে করেনা একদমই। আজ প্রায় বহুবছর যাবৎ তিনি প্রায় একইধরণের রুটিনই মেনে চলছেন। এত আলস্য আগে খুব একটা টের পাননি। ইদানীং পাচ্ছেন একটু একটু। বয়স বাড়ছে টের পাওয়া যায়। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে একটু জোড়ের সাথেই রেখে দিলেন কাপটা। শব্দের আধিক্যে নিজেই একটু চমকালেন। চশমা ভালভাবে গুঁজিয়ে বাসা থেকে যখন বেরোচ্ছেন তখন সকাল ১০টা পার হয়ে গিয়েছে। দোকান খুলে নাতি তারাজুল বসে আছে এক ঘণ্টা আগেই। তারাজুল ছোটমানুষ। ক্যাশের হিসেবই বোঝেনা ঠিকমত। গতবছর মারা যা বাপটা হারানোর পর থেকে ছেলেটা ভীষন চুপ মেরে গেছে। রফিকের মৃত্যুর সাথে সাথে অবশ্য লুৎফরবাবুর জীবনের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে।
আকাশের অবস্হা ভালই মনে হচ্ছে। পরিস্কার একদম। সেপ্টেম্বরের শেষ। হেমন্তেরও শেষ।
দু'বছর রিটায়ার করেছেন। বগুড়া জিলা স্কুলের ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রায় তিরিশ বছর। শহরের অধিকাংশ পরিবারই তার কোন না কোন ভাবে চেনা। রিটায়ারের আগে তেমন কিছু জমাতে পারেননি। যা পেয়েছেন যতটুকু সব ঢেলেছেন সংসারের জন্য ছেলেমেয়ের জন্য। প্রভিডেন্ট ফান্ডের পাওয়া থোক কিছু টাকা পেয়েই একটা ওষুধের ফার্মেসী খুলে বসেছেন পাড়ার মোড়ে। পেনসনের টাকায় দুমানুষের পুরো চলেনা। গহরের ওষুধ একটা বাড়তি চাপ। চাপ! হ্যাঁ চাপই তো। কিন্তু গহর ছাড়া ওর জীবনে কে আছে আর? তারাজুল? সত্যিই তো ওতো আছে।
চাকরির আগে আগেই বিয়ে ক'রেছিলেন। তখন গহরবানু ছিল অনেক আলাদা। আজকের মত অথর্ব নয়। ৪টা সন্তানের জননী। আজ থেকে কয়েকবছর আগেও তো ওর বয়সটা আলাদা রকমের বেশী মনে হতো না।
রফিকের মৃত্যুর পর থেকে একেবারে বিছানায়ই প'ড়ে গেছেন গহরবানু। আগে সকালে ঘুম থেকে উঠতে লুৎফরের একটু দেরী হলেই অস্হির হয়ে উঠত গহর। এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কী যেন শুধু ভাবে। ভাবা ছাড়া কিছু আর তেমন করারও নেই বোধ হয়। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল।
'চাচা, এই ওষুধগুলো আছে?'- সোহেলি একটা প্রেসক্রিপশান তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে দিলো লুৎফরের দিকে। সোহেলি খুব দুখী একটা মেয়ে। দুইটা বাচ্চা রেখে স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে। আহারে!
'চাচা, ওষুধগুলা এট্টু তাড়াতাড়ি দ্যান। বাচ্চার অসুখ!' সোহেলির জোড়ালো দৃষ্টিতে লুৎফর একবার তাকায়। দ্রুতহাতে প্রেসক্রিপশানটা হাতে নিয়ে ওষুধগুলো বের ক'রে যন্ত্রের মত হিসেব কষতে থাকেন।
'একশো চার টাকা আটআনা।' বলে একটা বড় হাই তুললেন।
দামটা দিয়েই দ্রুতপায়ে চলে গেল মেয়েটা।
সোহেলির চলে যাওয়া দেখতে দেখতে গহরবানুর মুখটা ভেসে আসলো আবার। রফিকের জন্মের একমাসের মাথায় ঘটনাটা। শিশু 'বাবু' (তখনও ওর নাম রফিক হয়নি)টার গায়ে ভীষণ জ্বর। অমাবস্যার কঠিন কালোরাত। হাতে কোন টাকাই নেই। তারপর দৌড় দৌড় দৌড়। ধার দেনা। সন্তানের পর সন্তান। আবারও দৌড়। সেই ভীষণ সময়টার কথা ভাবলে সময়টাকে ক্যামন অসহায় মনে হয়। খোকা চলে যাবার পর থেকে কী যেন ওলটপালট হয়ে গেছে সব! চশমাটা চোখের জলে ভরে যায় কেন এত! দশ বছরের তারাটাই কি বুঝতে পারছে কিছু!
লুৎফরবাবু আর একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। কী এসব বস্তাপচা সেন্টিমেন্টে ভরা এঁদো-প্যাঁচালী ভেবে লাভ কিছু হয় নাকি! বুকের সামনে আড়াআড়িভাবে হাত রাখলেন। ভাবলেন তারার বাপ মরার পর থেকে একবছর পুরো স্কুল ছাড়াই থাকলো। এই সিদ্ধান্তটা তারার মা-ই নিয়েছিল। আর না নিয়ে উপায়ও ছিল না তো তেমন। ছেলেটা কিভাবে যে এত লোন করেছিল! তার মধ্যে তিনিও তো পেনসনের টাকা নিয়ে কম ঝামেলার মধ্যে ছিলেন না। এবার তিনি আর কারো কথা শুনবেন না। ক্লাস থ্রী'তে ওকে আবার ভর্তি করিয়েই ছাড়বে সে। ...................(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৪:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




