মেয়েটির চোখ্ দুটি বড় মায়াবী।মানুষের চোখ এত সুন্দর হতে পারে এটা জানা ছিলনা অনিত এর।চোখের ভেতর পানি টলটল করছে।মনে হচ্ছে এক্ষুণি কাঁদবে।এমন চোখের কথা এতদিন গল্পও উপন্যাস এ পড়েছে অনিত।কিন্তু বাস্তবে এমন চোখের অধিকারিণী আছে সেটা এই মেয়েটিকে না দেখলে বুঝতে পারতো না।
মেয়েটির চেহারা বোধয় সুন্দর।কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবতে চাইলও না ও। তবে মেয়েটির চোখ ওকে টানছে।এটা মানতেই হবে।
একপলক তাকিয়েই মুখ সরিয়ে নিলো অনিত।চেহারায় বিরক্তির ভাব।কপাল কুঁচ্কে বলল
-মদ এর বোতল যেহেতু হাতে আছে তাহলে নিশ্চয় সেটা দিয়ে আমি ফুটবল খেলিনা।
খিল খিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি।মেয়েটির হাসি সুন্দর।হাসলে তার চোখেও সেটা ছড়িয়ে পরে..হেসেই চলেছে ও।
-আহ!বিরক্ত করোনা।খাওয়ার সময় কারো কথা বলা আমি পছন্দ করিনা।
মেয়েটি মনে হয় হতাস হল.
-আচ্ছা ঠিক আছে।আপনি খান,আমি আর কথা বলবো না।আমি চুপচাপ আপনার মদ খাওয়া দেখি।
-মদ খাওয়া দেখার ভেতর আবার কি আছে?
নিরবতা। .
মেয়েটি এবার হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাসছে।এভাবে পাশে একজন চুপচাপ হাসতে থাকলে আর যাই হোক মদ খাওয়া যায়না..অনিত বিরক্তিতে আরেকবার কপাল কুঁচকালো।
-যাও,আমার জন্যে এক গ্লাস পানি আনো।
-ইশ!আমি পারবো না।আপনি নিজে এনে নিন।
কট্মট্ করে মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে অনিত পানির গ্লাস আনতে বাইরে গেলো।গ্লাস এ পানি ঢেলে ঘরে ঢুকলো না ।ছাদ এ চলে গেলো।আজ জোছনা।পুরো পৃথিবী যেন আলোয় আলোয় ভরে আছে।ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে অনিত।এখন চা খেতে পারলে ভালো হত।কিন্তু নিচে সব ঘুম।কাউকে ডেকে চা এর কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা।মদ এর বোতল টা এখানে আনলেও হত..আজ কি যে হল ওর।উলট পালট লাগছে সব.মার কথা মনে করার চেষ্টা করলো।মার স্মৃতি খুব সামান্যই মনে আছে ওর।মার প্রতি তেমন টান অনুভব করেনা অনিত।আগে করতো।অনেক করতো।ইদানিং টান গুলো ভোতা হয়ে গেছে।
-চা খাবেন?
শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালো অনিত।মেয়েটি এসে দাড়িয়েছে।হাতে দুই কাপ চা।ঠান্ডায় অল্প অল্প কাঁপছে মনে হল।
-তুমি এখানে কেন?
-একা ঘরে বসে বসে ভয় লাগছিল।চা খেতে ইচ্ছে করছিলো।আমি আবার চা খাই খুব।চা বানাতে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় দেখলাম আপনি ছাদ এ আসলেন।মনে হল এই মূহুর্তে আপনারও চা খেতে ইচ্ছে হতে পারে। তাই নিয়ে এলাম।খাবেন?
-না। . তুমি যাও এখান থেকে।একা থাকতে দাও আমাকে।
-আমি ছাদ এ আপনার সাথে থাকার জন্যে আসিনি।চা দিতে এসেছি।আপনার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনি চা খেতে চাইছেন।এই নিন,কাপ টা ধরুন।
-এত বেশি কথা বলবেনা। তুমি যাও।আর শোনো,কখন আমার বৌ হবার চেষ্টা করবেনা।আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি।বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছে।সুতরাং তোমার দায়ভার বাবাই নেবেন.
আবার খিল খিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি। .মেয়েটির বোধয় হাসি রোগ আছে।একবার শুরু হলে আর থামতেই চায়না।জোছনা রাতে রিনরিনে গলার হাসি কেমন জানি গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে অনিত এর।মনে হচ্ছে মেয়েটি এই জগতের না।এই হাসিটাও এই জগতের না।মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে এই হাসি।অন্য জগৎ থেকে আসছে এই হাসি..হঠাৎ করে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো অনিত এর।এরকম হওয়ায় ও নিজেই অবাক।
-আপনি কি ভাবছেন আমি আপনার বৌ হওয়ার জন্যে আপনাকে বিয়ে করেছি?এরকম ভাবলে ভুল করবেন।আমি মোটেও আপনার বৌ হয়ে থাকতে চাইনা।আমাকেও একপ্রকার জোর করেই আপনার সাথে বিয়ে দেয়া হচ্ছিলো।আমি চিন্তা করছিলাম পালিয়ে যাব।কিন্তু সেই মূহুর্তে শুনতে পাই বর নাকি পালিয়ে গেছে বিয়ের আসর থেকে।ব্যাপারটা আমার কাছে এতটাই অবাক লাগলো যে কে এই মানুষ,আমি যেটা করব ভাবলাম সে সেটা আগেই করলো।.তখন তো আর আমার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। তাই আর কি,বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ের আসরে বসে থাকতেই হয়েছে। তখন দেখলাম আপনাকে ঘাড় ধরে বিয়ে দেয়া হচ্ছে।হি হি হি। .
অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো অনিত..চাঁদের আলো সরাসরি মেয়েটির মুখের উপর পড়েছে!তাছাড়া আরো মনে হচ্ছে মেয়েটির শরীর থেকেও আলো বের হচ্ছে।অনিত বুঝতে পারে,এটা ওর দৃষ্টিভ্রম। .
-তুমি মেয়েটা সুন্দর।কিন্তু আমার সাথেই তোমাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছিলো কেন?
-আসলে আমার মামা মামী এই বিয়েটা দিয়েছে।আমার সেখানে নিজস্ব কোনো মতামতের বালাই নেই। তবে আপনি মানুষটা অদ্ভুত।এতখনে একটাবার আমার নাম জানতে চাননি।আপনার নাম কিন্তু ঠিক ই আমি জানি।
-কি নাম তোমার?
-উপন্যাস।
-কি?
-আমার নাম উপন্যাস। নাম টা আমার বাবা রেখেছিল।সুন্দর না?
আরেকপলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিলো অনিত।বিষন্ন লাগছে ওর।একা থাকতে ইচ্ছা করছে।চাদ মনে হয় ডুবে যাচ্ছে আকাশে।মনে মনে ঠিক করলো কাল বাসা থেকে আবার বের হয়ে যাবে।এখানের এই বন্দি জীবন ওর না। তার উপর এখন আরেক মেয়ে এসে জুটেছে.. নাহ,পারবেনা ও এভাবে থাকতে.
-আপনিই মনে হয় কাল বাসা থেকে আবার বের হয়ে যাবেন।আমারও ইচ্ছে করছে।
অবাক হয়ে উপন্যাস এর দিক তাকাল অনিত।মেয়েটি ও কি চিন্তা করছে কিভাবে জানলো!হয়ত আন্দাজে বলেছে।মিলে যেতেই পারে।
-তুমি কই যাবে?
-আমি যাবনা।আমি তো শুধু ইচ্ছের কথা বললাম।আমার যাওয়া হবেনা।
-কেন হবেনা?
-বাহ রে!আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছেনা?
অনিত আর কিছু না বলে হাটা শুরু করলো।ঘুম পাচ্ছে,নিচে যেতে যেতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে উপন্যাস রেলিং ধরে পিছন ফিরে দাড়িয়ে আছে মুখ উচু করে।ওর ঠিক মাথা বরাবর চাঁদ।পুরো দৃশ্যটায় কেমন জানি একটা মায়াবি মায়াবি ভাব আছে।মেয়েটা বোধয় কাঁদছে।কাঁদুক,আমার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে সারাজীবন কাঁদার জন্যেই। .
ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল অনিত।
.......
মুনির সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে।মাত্র ঘুম ভাঙলো তার,প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে সে।এখনও কেউ জাগেনি।ঘুমাক সব।ক্লান্ত আর অস্থির লাগছে তার।ছেলেটাকে জোর করে বিয়ে দিলেন।এবার যদি ছেলেটা একটু ঘরমুখী হয়।
-বাবা,চা এনেছি।
এত সকালে উপন্যাস কে দেখে অবাক হলেন মুনির সাহেব।এই সময় সাধারণত চাকর বাকররাও ঘুম থেকে ওঠেনি। তিনিও কাউকে ডাকেন না এখন।আরও ঘন্টা খানেক পরে সব উঠবে।
-এত সকালে যে মা!ঘুম ভালো হয়নি?
জবাব না দিয়ে শুধু মুচকি একটু হাসল উপন্যাস..
-এই সময়ে আপনার চা খেতে ইচ্ছে হয় প্রতিদিন,কিন্তু তবুও এখন কাউকে ডাকেন না। তাই মনে হল আমি চা নিয়ে যেতে পারি।
অবাক হয়ে তার ছেলের বৌ এর দিক তাকাল মুনির সাহেব।মেয়েটা তার মনের কথা জানল কি করে!
(চলবে)