somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশবের স্কুল-কলেজ

০৮ ই জুন, ২০২২ সকাল ৯:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(লেখাটি শ্রদ্ধেয় ব্লগার খায়রুল আহসানকে নিবেদিত, সম্প্রতি যার কাছ থেকে স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখবার বিষয়ে অনেক উৎসাহ পেয়েছি।)

ছাত্রাবস্থায় নিতান্ত গাধা ছিলাম। তবে বুদ্ধিবৃত্তি গাধাতুল্য হলেও, নিরীহ এই প্রাণীটির মত সুবোধ ছিলাম না মোটেও। এত চঞ্চল ছিলাম যে এই অস্থিরতাকে কেবল ছাগশিশুর সাথে তুলনা করা চলে। ছাগশাবকের মতই সদ্য গজিয়ে ওঠা শিং দিয়ে যত্রতত্র গুতোগুতি করে অনিষ্টের চুড়ান্ত করতাম। আমাদের শিক্ষকদের বিচারে স্নেহ নিরঙ্কুশ জয়ী হতো বলে, বহু দৌরাত্ম্য করেও শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতাম। আজ ভাবি, কি অপরিসীম ধৈর্য নিয়েই না আমাদের শিক্ষকেরা জন্মেছিলেন!

বর্ণপরিচয়ে যখন পড়তাম "অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে", তখন মনে হতো অজগর চলে আসার আগেই গাছ থেকে আম পেড়ে খেতে হবে। এত অল্প সময়ে আম পেড়ে খাওয়া হবে কিনা এই নিয়ে খুব উৎকন্ঠায় থাকতাম। আমাদের পাড়াগায়ের স্কুলে প্রথম দিকের ক্লাসগুলোতে ইংরেজী শেখার বালাই ছিলনা। তাই ভাষা শিক্ষার সাথে সাথে কল্পনা আর ভাবের রূপান্তর হতো। তখন ভাবতাম, বাড়ির কাছে ঘাঘট নদীর ওপারেই ডালিমকুমারের রাজপ্রাসাদ আর রাত গভীর হলেই বড় বড় গাছের মগডালে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরা কথা বলতে শুরু করে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যামিনী স্যার পড়াতেন বিজ্ঞান, নজিব স্যার গণিত, আর অপু স্যার শেখাতেন ড্রইং। অপু স্যার ক্লাসে ঢুকেই ব্লাকবোর্ডে এমন চমৎকার ছবি আঁকতেন যে, ক্লাস শেষে ছবিগুলো মুছে ফেললে আমার খারাপ লাগতো। আর ছিলেন গানের ম্যাডাম। ম্যাডামের নাম ছিল "খুকু", আমরা ডাকতাম "খুকু আপা"। কোন এক আশ্চর্য কারনে স্কুলের শিক্ষিকাদের ম্যাডাম না ডেকে আমরা "আপা" সম্বোধন করতাম! খুকু ম্যাডাম তার তিন বা চার বছরের বেনী দোলানো সুন্দর মেয়েকে নিয়ে ক্লাসে আসতেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি যখন গাইতেন, "আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়/ লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে/ সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা", তখন সেই গান শ্রাবণের বৃষ্টি শেষে স্নিগ্ধ বাতাসের মত প্রশান্তি জাগাতো। সারাটা সপ্তাহ জুড়ে গানের রেশ থেকে যেত মনে। স্কুলের খোলা মাঠে রঙ্গীন কাপড় আর বাঁশের তৈরি প্যান্ডেলে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হতো। সেখানে স্কুলের ছেলেমেয়েরা নীল-সাদা ইউনিফর্ম পড়ে, সাদা জুতোয় তাল দিতে দিতে গাইতো "প্রজাপতি প্রজাপতি/ কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা/ টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা'। মাইকের গমগমে শব্দে, হারমোনিয়ামের সুরে "টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা" শুনলেই মনে হতো, প্রজাপতিগুলো বুঝি অসংখ্য লাল-নীল ঝালর হয়ে চারপাশে পাখির মতো উড়ছে।

স্কুলের অনুষ্ঠানে আমার মা যেতেন সাথে। গানের সুর আমার মাকেও স্পর্শ করে থাকবে। মা চাইতেন আমিও জুতোয় তাল দিতে দিতে মঞ্চে দাড়িয়ে গান গাই। কিন্তু খুকু ম্যাডাম আমার বেসুরো গলার গান শুনিয়ে অন্যদের আতঙ্কিত করার ঝুকি নিতে চাইতেন না বলে আমার মায়ের এই ইচ্ছাটি অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল। স্কুলে গানের দলে সুযোগ না পেলেও ২৬ শে মার্চ বা ১৬ ই ডিসেম্বরে বিকট ড্রামের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে কুচকাওয়াজে অংশ নিতাম। শহরের স্টেডিয়ামে অন্য অনেক স্কুল কলেজের সাথে আমাদের স্কুল প্যারেডে যোগ দিতো। স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক লালু স্যার ছিলেন সফল ক্রীড়া সংগঠক। শহরের যে কোন এথলেটিক্স প্রতিযোগিতা, প্যারেড বা খেলার আসরে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। এই ধরনের অনুষ্ঠানে শহরের প্রধান দলনেতার ভুমিকা ছিল তার। শৈশবের দিনগুলোতে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রাথমিক ধারণাটা একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরী, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল।

স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে চয়নিকা নামে আমরা আরেকটি বাংলা বই পড়তাম। অনেকগুলো ছড়া আর গল্পের সংকলন এই বইটি। চয়নিকার ছড়াগুলো ছিল মজার, যেমন:
মামুদ মিয়া বেকার
তাই বলে কি সাধ নেই তার
বিশ্ব ঘুরে দেখার?
আসল যখন চেকার
মামুদ মিয়া বললো হেসে
ট্রেন কি তোমার একার।

চয়নিকার গল্পগুলো ছিল বেশ সুখপাঠ্য। অবশ্য মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের তোতা-কাহিনীর মতো ভারিক্কি গল্পও সেখানে থাকতো। বনের পাখি ধরে নিয়ে এসে কেন যে রাজার লোকেরা পাখিটাকে ঠেসে ঠেসে পুঁথি মানে কাগজ খাওয়াতো, তার অর্থ ভাল বুঝতাম না। গল্পের শেষে পাখিটি মরে যায় বলে গল্পটি আমার ভালো লাগতো না। এতদিন পরে অন্য সব গল্পের কথা ভুলে গেছি, অথচ এই গল্পটি মনে আছে!

সেই সময়ে আমাদের বাসায় পাঠ্যপুস্তক ছাড়া ছোটদের পড়ার মতো বই বিশেষ ছিলনা। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় কি ভাবে যেন সাজেদুল করিমের হাসির গল্প নামে একটা বই আমার হাতে এল। এই লেখকের "বুদ্ধিমতী মেয়ে" গল্পটি ক্লাস থ্রির বাংলা বইয়ে আমাদের পাঠ্য ছিল। সাজেদুল করিমের হাসির গল্পই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়া আমার প্রথম বই। বইটা পাঠের আনন্দ অনেকদিন আবিষ্ট করে রেখেছিল। আরেকটু বড় হয়ে পড়েছিলাম জুল ভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস "আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ"। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যদি বলি, এই দুটো বই ছিল আমার শৈশবের মেঘদূত।

সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে মনে হয়, যাদের প্রেরণায়, প্রচেষ্টায়, স্নেহে আমাদের হাতেখড়ি হয়েছিল, যারা ছিলেন ভাষা শিক্ষার অগ্রদূত, যাদের প্রতিটি বাক্য শৈশবের কল্পনার ছাঁচগুলোকে অদৃশ্য হাতে গড়ে তুলেছিল, তাদের অনেকেই ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, অবহেলিত মানুষ। এখন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরকারী বেতম কাঠামোয় মোটামুটি জীবন ধারণ করতে পারলেও আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে আমাদের শিক্ষকেরা জীবিকার ভারে দুঃসহ জীবন কাটাতেন। পারিবারিক ব্যাবসা বা অর্থ উপার্জনের অন্য উপায় যাদের ছিল না, তারা মুজতবা আলীর পাদটীকা গল্পের পন্ডিতমশায়ের মতো কায়ক্লেশে জীবন পার করতেন।

মেঘদূতের যক্ষ যেমন রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হয়েছিল, আমরাও তেমন প্রমত্ত পদ্মা-তীরে ক্যাডেট কলেজে নির্বাসিত হয়েছিলাম। বয়স তখন কেবল বারো, বিপুলা পৃথিবী তখনো অজ্ঞাত। অজানা পৃথিবীর সাথে নবীন পরিচয়ের দূত হয়ে এসেছিলেন শিক্ষকেরা। মেঘদূতের কবি বর্ষার মেঘ দেখে উদ্বেলিত হয়ে মেঘের সাথে সাথে নদী, পাহাড়, মাঠ, জনপদের উপর দিয়ে কাল্পনিক যাত্রা করেছিলেন। স্রোতোস্বিনী পদ্মার পাড়ে বন্দী হয়ে আমরাও কাল্পনিক যাত্রায় পৃথিবীর পথে বের হয়েছিলাম। এই যাত্রাপথে সারথি ছিলেন আমাদের শিক্ষকেরা।

ক্যাডেট কলেজে প্রথম দুটি বছর কঠিন ছিল। অল্প বয়সে পরিবার-পরিজন ও চেনা পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অস্ফুট বেদনা, প্রাক-মিলিটারি জীবনের কঠোর শৃঙ্খলা ও অপরিচিত পরিবেশে নিজের সামঞ্জস্যহীনতা দেখে সেই বয়সে জীবনের উপর যতখানি বীতরাগ সম্ভব তা হয়েছিল। মনে হতো মরুভূমির উপর দিয়ে হাটছি, পায়ের নিচে তপ্ত বালু, চারপাশে উষ্ণ বাতাস, কোমল শীতল মায়ের আঁচল কোথাও পাতা নেই।

অবশ্য অল্পদিনের মধ্যে একটা মরুদ্যান খুঁজে পেয়েছিলাম। সেটা ছিল কলেজের আর্ট গ্যালারি। আর্ট গ্যালারি ছিল আমাদের চারু ও কারুকলা শিক্ষকের ডিপার্টমেন্ট, স্টুডিও ও কর্মশালা। মূল একাডেমিক ভবন থেকে কিছুটা আড়ালে এর অবস্থান। নতুন, পুরাতন ছাত্রদের এবং স্যারের আঁকা অনেক ভালো ছবি ঘরময় ছড়ানো থাকতো। অয়েল পেইন্ট, জল রং, স্কেচ সবই ছিল সেখানে। কোন ছবি বাধাই করা, কোনটা বাধাই হয়নি। কোন ছবি অনেকদিন আগে পাশ করে যাওয়া ছাত্রের আঁকা, কোনটা সেই সময়ে কলেজে পড়ুয়ার। সারা ঘরে রংয়ের গন্ধ, ছড়ানো ছিটানো রং-তুলি, ইজেল, ক্যানভাস। ঘরের এক কোণায় টেবিলের সাথে লাগানো খুব বড় একটা পেন্সিল কাটার যন্ত্র, মাঝখানে প্রশস্থ উচু টেবিল, সাথে বসার জন্য টুল। রুমটা ছিলো বেশ বড়। আমদের শাখার ২৫ জন ছাত্র অনায়াসেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছবি আঁকতে পারতাম। স্যারের একজন সহযোগী ছিলেন, তার নাম আজগর ভাই। স্যারের মত আজগর ভাইও অত্যন্ত ভালো আঁকিয়ে। আর্ট গ্যালারীতে গেলে তিনি নানা ভাবে ছবি আঁকায় সাহায্য করতেন। আজগর ভাইয়ের আরেকটি পরিচয় ছিল, সেটা হলো তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদের মেকাপম্যান। যে কোন অভিনয়ে আজগর ভাইয়ের রূপসজ্জা ছাত্রদের মুখে ও পোশাকে নতুন জীবন দান করতো। আর্ট গ্যালারীকে মনে হতো ক্যাডেট কলেজের বাইরের কোন স্থান। সেখানে মিলিটারী নিয়মের কঠোরতা নেই, পড়া মুখস্থের বালাই নেই, তটস্থ হয়ে থাকবার প্রয়োজন নেই। স্যার এবং আজগর ভাইয়ের গলার স্বর শুনলে মনে হতো এ যেন তপোবন।

ক্যাডেট কলেজে লাইব্রেরি ছিল অতি সমৃদ্ধ, নাম "রব পাঠাগার"। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রবের নামে নাম, তবে আমার মনে হতো এই নামের আরো অনেক অর্থ আছে। "রাব্বি জিদনি ইলমা" - পড় তোমার রব বা প্রভুর নামে। আবার রব মানে ধ্বনি বা শব্দ। রবীন্দ্রনাথের লাইব্রেরি প্রবন্ধের "মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল .. এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে"। সপ্তাহে একদিন ক্লাসের দুটি ঘন্টা আমরা কলেজ লাইব্রেরিতে বই পড়তে পারতাম। তবে, প্রথম দুই বছর সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকলীন সময়ে আমরা কোন বই ইস্যু করতে পারতাম না। আমাদের হাউজগুলোতে ছোট পাঠাগার ছিল। দূঃখের বিষয় হাউজ লাইব্রেরির বইও সেই বয়সে আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ঠিক কি কারনে জানি না, তবে বোধহয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "ভালবাসা, প্রেম নয়" এবং এ জাতীয় আরো দুচারটি বইয়ের জন্য আমাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। শুধুমাত্র মসজিদ লাইব্রেরি সে সময় উন্মুক্ত ছিল। সেখানে বইয়ের সংখ্যা বেশি ছিল না। মসজিদের ভিতরে দুটো শেলফে বই থাকতো। ক্যাডেটদের মধ্যে কেউ ভলান্টিয়ার হয়ে শেলফের চাবি রাখতো আর বই আদান-প্রদানে সাহায্য করতো। প্রতিদিন জোহরের নামাজের পরে আমি হয় বই পড়তাম নয়তো নতুন বই ইস্যু করতাম। আমার আগ্রহ দেখে আমাদের ধর্ম স্যার, তিনি কলেজ মসজিদের ঈমামও বটে, আমাকেই মসজিদ লাইব্রেরির ভলান্টিয়ার বানিয়ে দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা অংশ নিয়েছিলেন, অনেকে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য, এমনি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষক রাজশাহীর চারঘাট-বাঘা এলাকায় বন্দুক হাতে সম্মূখ-সমরে অংশ নিয়েছিলেন। রনাঙ্গনে তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রেণিকক্ষে পিতার প্রতিমূর্তি। স্যার ক্লাসে আসলেই আমরা তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাইতাম। তিনি তাঁর পাত্র উজাড় করে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের ময়দানের লোমহর্ষক গল্প বলতেন। স্যারের সেই অমূল্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তার কোন ছাত্র বা অন্য কেউ কোথাও লিপিবদ্ধ করেছিলেন কী না, আমার জানা নেই।

আর ছিলেন আমাদের বাংলার ম্যাডাম। তার গল্প বলার প্রতিভা এত অসামান্য ছিল যে সেই গল্পের প্রভাব আমার জীবনে সূদুরপ্রসারী হয়েছিল। ম্যাডাম যদিও ছিলেন বাংলা ভাষার অধ্যাপিকা, তার গল্পের বিষয়বস্তু শাখা প্রশাখায় বহুবিস্তৃত ছিল। আশাপূর্ণা দেবীর গল্প যেমন তার কাছে শুনেছি, তেমনি শুনেছি সাইন্স ফিকশন, ইংরেজি এডভেঞ্চার, এমনকি সেসময়ে বিটিভিতে প্রচারিত হওয়া নাটকের গল্পও। ক্যাডেট কলেজে সপ্তাহে একটি দিনে বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার সকালে অল্প কিছু সময় আমাদের টিভি দেখার সুযোগ ছিল। মঙ্গলবার রাতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখতে পেতাম না। কলেজ বন্ধকালীন সময়ে বাড়িতে ছুটি কাটাতে এলে ধারাবাহিকের কিছু পর্ব দেখতে পারতাম। হুমায়ুন আহমেদের "কোথাও কেউ নেই" তখন খুব জনপ্রিয়। এ নাটকের কিছু পর্ব বাড়িতে বসে দেখেছিলাম। এর শেষ পর্ব যখন প্রচারিত হলো তখন আমরা ক্যাডেট কলেজে ফিরে গেছি। মঙ্গলবার রাতে প্রচারিত হয়েছিল বলে এই পর্বটি দেখতে পাইনি। পরদিন ম্যাডামের ক্লাস। তিনি ক্লাসে ঢোকা মাত্রই ক্লাসের সবাই আগের রাতে প্রচারিত নাটকের গল্প শুনতে চাইলাম। ক্লাসে পিনপতন নিস্তব্ধতা, ম্যাডাম যাদুকরী দক্ষতায় "কোথাও কেউ নেই" এর গল্প বলে শোনালেন। গল্প শোনার এই অনুভুতিকে মন্ত্রমুগ্ধ বললে কিছু কম বলা হবে। তবে দর্শকদের অনুরোধে, পরের শুক্রবার সকালে বিটিভি এই পর্বটি পূনঃপ্রচার করেছিল। অতএব মঙ্গলবার রাতে না দেখতে পারলেও শুক্রবার সকালে আমরা পর্বটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। টিভিতে নাটকটি ভাল লেগেছিল, কিন্তু দেখার পরে মনে হলো কদিন আগে ম্যাডামের কাছে শোনা গল্পের কিছু অংশ যেন টিভিতে দেখায়নি। আসলে, তুলনায় সেদিন টিভিতে দেখা নাটকের চেয়ে ম্যাডামের কাছ থেকে শোনা নাটকের গল্পই আমার বেশি ভালো লেগেছিল।

বাংলার আরেকজন অধ্যাপক পরম মমতায় আমাদের বিভূতিভূষণের "পথের পাচাঁলী" পড়াতেন। আমরা তখন কিছুটা বড় হয়েছি। ততদিনে জেনে গেছি যে পদ্মা নদীর ওপারে আসলে নীলকমল আর লালকমলের রাজপ্রাসাদ নেই। সেখানে দূর দিগন্তের আবছা গ্রামগুলো আসলে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার কোন গ্রাম। তবে আমার মনে হতো অপু আর দূর্গার নিশ্চিন্দিপুর গ্রামটা হয়তো ওখানেই কোথাও হবে। ইছামতির তীরের নিশ্চিন্দিপুর। আমি কল্পনায় নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের একটা মানচিত্র বানানোর চেষ্টা করতাম। অপুদের বাড়ির পাশেই নীলমণি রায়ের পোড়ো ভিটা, আর অনেকটা হেটে গেলে তাদের ধনী প্রতিবেশী ভুবন মুখুজ্যেদের বাড়ি। অপুদের বাড়ির রান্নাঘরের পিছনে সজনেতলা, লেবুফুলের গন্ধ সেখান থেকে ভেসে আসতো। শাঁখারীপুকুরটা ভুবন মুখুজ্যেদের বাড়ি ছাড়িয়ে আরেকটু দূরে, আর সোনাডাঙ্গার মাঠ বেশ দূরে গ্রামের সীমানায়।

ক্যাডেট কলেজে বাইরের দৃষ্টিসীমা ছিল নির্দিষ্ট, কিন্তু মনের চোখগুলোকে খুলবার অজস্র আয়োজন সেখানে ছিল। একাডেমিক পড়াশুনার পাঠ্ক্রম, খেলাধূলা আর শরীরচর্চার পাশাপাশি আমাদের সাপ্তাহিক রুটিন আবৃত্তি, নাটক, চিত্রকলা, বিতর্ক, বক্তৃতা এবং বিবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ঠাসা থাকতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো ছিল অত্যন্ত মানসম্পন্ন। মনে আছে, যে বছর ক্যাডেট কলেজে ভর্ত্তি হয়েছিলাম, তার কয়েক মাস পরেই রবীন্দ্রনাথের "অচলায়তন" নাটকটি কলেজ অডিটরিয়মে মঞ্চায়িত হয়। শিক্ষকদের তত্বাবধানে কলেজের ছেলেরা চমৎকার অভিনয় করে সে নাটকে এতটাই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে যে, অন্ধ গোঁড়ামি আর প্রাণহীন প্রথার বিরুদ্ধে মনের ভিতরে একটা বিদ্রোহের ভাব তৈরি হয়েছিল।

এখানে আমাদের শিক্ষকদের কাজ ক্লাসের পাঠদানে সীমাবদ্ধ ছিল না। সকাল থেকে রাত অব্দি ছাত্রদের নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত থাকতেন। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, শরীরচর্চা, ক্লাসের পড়াশোনা, খেলা, প্রার্থনা, এমনকি খাদ্য গ্রহনের সময়েও শিক্ষকদের তদারকি চলতো। দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে যেসব আয়োজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগীতা বা বিশেষ কোন অতিথির কলেজ পরিদর্শন, সবক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্ব ছিল পাহাড় সমান। নিজের জীবন ছাত্রদের জন্য সম্পূর্ণ উৎসর্গ না করলে কোন মানুষের পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব নয়। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, কী এমন পূণ্য করেছিলাম যে আমার মতো অশিষ্ট গরুর জন্য এতগুলো মানুষ প্রাণপাত করেছিলেন?

পৌরাণিক গল্পে আছে স্বর্গ উদ্ধারের জন্য, অসুরকে মারার অস্ত্র বানাতে ঋষি দধীচি জীবন বিসর্জন দিয়ে তার শরীরের হাড় দিয়েছিলেন। ক্যাডেট কলেজে আমাদের শিক্ষকেরা ছিলেন এযুগের দধীচি। নিজের জীবন, মেধা, অবসর সবই তারা বিসর্জন দিয়েছিলেন আমাদের জন্য। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রসন্ন কুমার পাল স্যার ছিলেন এমনি একজন মূর্তিমান দধীচি। ধীর-স্থির স্বভাবের, স্মিতবদন, মৃদুভাষী। প্রজ্ঞা আর পরিমিতিবোধের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। স্যার আমাদের পড়াতেন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া, সূর্যের আলো থেকে কি করে উদ্ভিদ নিজের খাবার নিজে প্রস্তুত করে তার প্রনালী। বৃক্ষের মধ্যে যেমন মহীরুহ, তিনি ছিলেন তেমনি মহীরুহ। আমার মতো অনেক ছাত্র অনায়াসে তার সুশীতল ছায়া পেত। আমাদের জানা ছিলো না, এই মহীরুহর মনে ভয়ানক হৃদয়বিদারক কষ্ট চাপা দেওয়া আছে। তার মৃত্যুর পরে জেনেছিলাম ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, তার সকল নিকট আত্মীয়ের সাথে গ্রামের অর্ধশত বা তারো বেশি মানুষকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একই দিনে একসাথে মেরে ফেলেছিল। তারপর থেকে প্রতিবছর এপ্রিল মাসে স্যার তীব্র মানসিক বিষাদে আক্রান্ত হতেন। মানসিক বিষাদ বেড়ে মানসিক ব্যাধির জন্ম হয়েছিল - যার পরিনতি আত্মহত্যা। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে কলেজের উপাধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। মানসিক রোগের কোন চিকিৎসা দেশের কোথাও তিনি পেয়েছিলেন কী না, আমার জানা নেই। মানসিক রোগ বাংলাদেশে চিরকাল অবহেলিত।

রবীন্দ্রনাথ "শিক্ষা" প্রবন্ধে লিখেছিলেন "আমাদের বিদেশী গুরুরা প্রায়ই আমাদিগকে খোঁটা দিয়া বলেন যে, তোমাদের উদ্ভাবনাশক্তি জন্মিল না, কেবল কতকগুলো মুখস্থ বিদ্যা সংগ্রহ করিলে মাত্র।" যদি সামান্য উদ্ভাবনাশক্তিও থাকতো তবে হয়তো স্যারের গ্রামে গিয়ে সেই ইতিহাসের অনুসন্ধান করতাম, যা তাকে অসময়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ আরো লিখেছিলেন, "জীবনের সহিত শিক্ষার একটা রাসায়নিক মিশ্রণ হয় না বলিয়া আমাদের মনের শিক্ষিত ভাবগুলি কতক আটা দিয়া জোড়া থাকে, কতক কালক্রমে ঝরিয়া পড়ে"। আমাদের ক্ষেত্রেই বা এর ব্যতিক্রম কেন হবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২২ সকাল ৯:১০
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×