somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের সেকাল এবং একালের ঈদ

৩১ শে মার্চ, ২০২৫ ভোর ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কানাডার আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে কিনা সেটা খুঁজতে গতকাল সন্ধ্যায় বাসার ছাদে বা খোলা মাঠে ছুটে যাইনি। শৈশবে সরু এই চাঁদটা আকাশে দেখতে পেলেই দেহকোষের সবখানে একটা আনন্দধারা বয়ে যেত। আমাদের চেয়ে বয়সে যারা কিছু বড়, বোধহয় বারো কি তেরো বছর বয়স যাদের, তারা চাঁদরাতে মশাল-মিছিল বের করতো। মশাল কীভাবে বানাতে হয় সেই কৌশল তখনো আমার জানা ছিল না। তবে সুযোগ পেলেই আমি এক ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়ে, সেই মিছিলের সঙ্গে অনর্থক দৌড় দিয়ে অনেকটা দূরে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম।

শৈশব-কৈশোরে আমার বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের ছোট এক শহরে। আমরা যখন সেই মফস্বলের খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়েছি, তখন সেখানে না ছিল শিশু-উদ্যান, না ছিল কোনো হোটেল-রেস্তোরা বা সৌখিন আমোদের জায়গা। ছোটবেলার ঈদ মানেই ছিল আকাশ সমান স্বাধীনতা, যেটা বছরের অন্য দিনগুলোতে পাওয়া যেত না। সকালে ঈদের নামাজের পরে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকতো। সারা বছর ধরে পরিকল্পনা করতাম এই দিনটিতে আমরা কী করবো।

তখন গলির মোড়ে মোড়ে কোক-পেপসির দোকান বসতো, আর সেখানে ক্যাসেট প্লেয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত সাউন্ড বক্সে খুব জোরে জোরে বাজতো ব্যান্ডের গান। উদ্দাম বাজনাকে ঘিরে ছেলেদের নাচের আসর জমে উঠতো কখনো কখনো। আমাদের পাড়ায় মুনসির দোকানে তখন সাধারণ চাল-ডাল মনোহরী পণ্যের পাশাপাশি কিছু নতুন খেলনা, চিপসের প্যাকেট, বোতলজাত পানীয় বা মিছরি জাতীয় খাবার উঠতো। চাঁদরাতে বা ঈদের দিন সন্ধ্যায় তারাবাতি জ্বালানো এবং বাজি পোড়ানোর একটা রেওয়াজ তখনও ছিল। সরু একটা কাঠির গায়ে দাহ্য পদার্থ মাখানো থাকতো। সেটার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে জোরে আকাশের দিকে ছুড়ে মারতাম। আতশবাজির মতো দেখাতো।

গলির মোড়ে মোড়ে হাওয়াই মিঠাই, কাগজের ফুল, বেলুন আর খেলনার অস্থায়ী স্টল বসতো। পাড়ার ছেলেমেয়েরাই সেই স্টলগুলোর উদ্যোক্তা। সেখানে আবার আটআনা পয়সা বা এক টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কেনা যেত। লেবুর রস দিয়ে লেখা একটা গোপন সংখ্যা ছোট ছোট কাগজে লেখা থাকতো। সুতা বা গুনার মধ্যে মালার মতো করে গেঁথে রাখা কাগজের টুকরোগুলোর মধ্যে একটা টেনে নিতাম। সেই কাগজ পানিপূর্ণ পাত্রে ফেলে দিতেই গোপন সংখ্যাটা উঠতো ভেসে।

বেলা একটু বাড়তেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। এভাবে ঘুরে ঘুরে প্রতিবেশীদের বাসায় গিয়ে গিয়ে কত যে পায়েশ, মিষ্টান্ন আর সেমাই খেয়েছি, তার হিসেব নেই।

ঈদের দিনে আরেকটা বড় আনন্দ ছিল বন্ধুদের সাথে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো। রিকশায় ঘুরে কোক বা পেপসি খাওয়া ছিল বিশেষ আনন্দের। এভাবেই একবার রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে এক বিরাট সাহসের কাজ করে ফেললাম। সেবার বন্ধুদের সাথে আমাদের রিকশাটি যখন শহরের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখি আমাদের দলের সামনের রিকশাটি একটা ফটো স্টুডিওতে গিয়ে থামলো। দেখাদেখি আমরাও রিকশা থেকে নেমে তাদের পিছু পিছু স্টুডিওতে ঢুকলাম। সেখানে একটা হাতে আঁকা গাড়ির ছবি কার্ডবোর্ডে লাগিয়ে ছবি তোলার জন্য একটা সেটের মতো করা হয়েছে। গাড়ির ছবিওয়ালা কার্ডবোর্ডের পেছনে দাঁড়ালে সামনে থেকে গাড়িতেই বসে আছি এমন মনে হয়। কে ড্রাইভার সিটে বসে ছবি তুলবে, এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে একটু তর্কাতর্কি চললো। ঠিক হল আমাদের এক বন্ধু সেখানে বসবেন। তারপর সকলে মিলে সেই আকা গাড়িতে পোজ দিয়ে একটা ফোটো তুলেছিলাম।

এখন যখন শৈশবের কথা ভাবি, তখন মনে হয় ঈদের সেই দিনগুলো আমাদের জন্য বাধাহীন আনন্দের হলেও আমাদের পিতামাতার জন্য এমন নিরঙ্কুশ আনন্দময় ছিল না। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের ঈদ মানে আমাদের মায়েদের বহু চোখের জল এবং পিতাদের রক্ত-ঘাম-কষ্টে অর্জিত আয় ও ব্যয়ের কঠোর হিসাব-নিকাশ। যে পরিবারগুলো খুব ভাগ্যবান, তাদের গৃহেই রক্ত-ঘাম-কষ্ট আর চোখের জলের সমতায় ঈদের নতুন কাপড়, মুখরোচক খাবার আর সন্তানদের অনর্থ ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য হতো।

পিতার সঙ্গে কলেজ মসজিদের মাঠে গিয়ে সকালে নামাজ পড়তাম। ঈদের দিন সকালটি কলেজ মসজিদের ইমাম সাহেব, আমাদের প্রিয় চিরচেনা হুজুরের সুন্দর তেলাওয়াত এবং কথায়-খুতবায় মুখরিত হতো। সেই তেলাওয়াত আমাদের বাসার উঠোন পর্যন্ত শোনা যেত। নামাজ পড়া শেষ হলে পিতার সঙ্গে প্রথম কোলাকুলি করতাম।

আজ এই বিদেশের মাটিতে নগর দালানের ব্যস্ত কমিউনিটি সেন্টারে নামাজ পড়তে গিয়ে আমার তেরো বছরের কন্যা আর সাত বছরের ছেলে এত মানুষ দেখে যারপরনাই অবাক হল। নামাজ শেষ হলে আমার পিতার মতো আমিও সন্তানের সঙ্গে কোলাকুলি করে, কোলাকুলি জিনিসটা যে কী, সেটা ব্যাখ্যা করে শোনালাম।

চাঁদরাত উপলক্ষে গতকাল এখানে একটি মেলা ছিল। আমার স্ত্রী সেখান থেকে আমার জন্য একটি পাঞ্জাবি এবং পায়জামা কিনলেন। সকালে নামাজের আগে সেই ভাঁজ খোলা নতুন কাপড় পরিধান করতে গিয়ে দেখি, পাঞ্জাবিটা স্বদেশি ঘরানার হলেও পায়জামাটা কুর্তা জাতীয় পোশাক। সেটি পরতে গিয়ে মুজতবা আলীর "দেশে বিদেশে" গ্রন্থের পাঞ্জাবি-কুর্তার গল্প মনে পড়লো। মুজতবা আলী লিখেছেন, তিনি এক সরদার্জীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সালওয়ার বানাতে কত গজ কাপড় লাগে। উত্তরে সরদার্জী বলেছিলেন, দিল্লিতে লাগে সাড়ে তিন গজ, লাহোরে সাড়ে পাঁচ গজ আর পাঠানমুল্লকে পুরো এক থান, অর্থাৎ বিশ গজ! আমার পরিধেয় এই কুর্তাটি পাঠানমুল্লক থেকে আগত কিনা, কে জানে!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:৩৩
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×