
হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের সবচেয়ে অপকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ছিল হাসিনার মুখের ভাষা। পৃথিবীতে আর কোনো সরকার প্রধান তার মতো ইতর ভাষায় জনগণকে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। মনে পড়ে তার সেই উক্তি: "তাহলে বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করে দেই, পানি দেওয়া বন্ধ করে দেই, সার বন্ধ করে দেই। সব বন্ধ করে বসাই রাখি। আমার রিজার্ভ ভাল থাকবে।" লক্ষ্য করুন "আমার রিজার্ভ।' দেশের সরকার প্রধান থেকে তিনি দেশের মালকিন হয়ে গিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ, পানি, সার - সবই তার; জনগণ তার প্রজা মাত্র। রিজার্ভের ডলারও তার। আর তার ক্ষমতাকে কেউই চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। চ্যালেঞ্জ করা দূরের কথা, কোনো প্রকার সমালোচনা করলেই র্যাব উঠিয়ে এনে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেবে।
পদ্মাসেতু উদ্বোধনের বক্তৃতায় খালেদা জিয়া ও ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন: "মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে, সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত।" এখানে তিনি ক্ষমতার অধিকারি বিশেষ মাস্তান। তিনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন। তার ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য, কটু কথার জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই।
গণতন্ত্রের সব কাঠামো তিনি ধ্বংস করেছেন। নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতেই তার স্বেচ্ছাচারিতা ও দুঃশাসন কাজ করেছে। ভারতের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি ভেবেছিলেন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করে ফেলেছেন। ভোটের আগের রাতে ব্যালট ভর্তি করা, কেন্দ্র দখল এবং হাতুড়ি-হেলমেট বাহিনীর মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ - এসবই জনগণের প্রতি হাসিনার তীব্র তাচ্ছিল্যের প্রকাশ মাত্র।
হাসিনা শাসনের সবচেয়ে অন্ধকার দিক ছিল গুম, খুন এবং পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন। বিরোধী কর্মী, সমালোচক বা ভিন্নমতের মানুষ নিখোঁজ হয়ে যেত। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর মানুষ আর ফিরে আসত না। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুকে নিয়মিতভাবে "হৃদরোগে মৃত্যু" বলে ঢেকে ফেলা হতো। রাষ্ট্র-সমর্থিত এই দমননীতি শুধু ভয় সৃষ্টি করেনি, বরং জনগণের নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের ধারণাকেও ধ্বংস করেছে।
অর্থনীতির নামে হাসিনা গোষ্ঠী পুরো জাতিকে ধোকা দিয়েছিল বাংলাদেশে এক ধরনের দস্যুতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। কয়েকজন লুটেরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছিল। তাদের দোসর, কর্মচারী ও চাকর-বাকরেরা স্বল্প মেয়াদে কিছু টাকা পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এই উন্নয়ন টেকসই হয়নি, এবং সেটা ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পৌঁছেছিল। ব্যাংকগুলো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
হাসিনার পতন আমাদের কাছে মুক্তির সম্ভাবনা এনেছিল ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি দেখিয়েছে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের বদলে দেশ নতুন ধরনের অস্থিরতার দিকে ধাবিত হয়েছে। মানুষ ভেবেছিল রাজনৈতিক পরিবর্তন সামাজিক স্থিতি, নিরাপত্তা এবং সুশাসন নিয়ে আসবে, কিন্তু সেই আশা অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে।
এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে যে ক্ষমতার শূন্যস্থান পূরণ করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি - রাজাকার, আলবদর ও জঙ্গি-মৌলবাদীরা। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সরকারের উচ্চ পদগুলোতে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে। প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়েছে কুখ্যাত রাজাকারের সন্তানেরা, যারা মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত এবং রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়ে জনমানসকে বিভক্ত করেছে।
তাই বলতেই হচ্ছে - রাজাকার-আলবদর চাই না, কিন্তু হাসিনাকেও চাই না!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


