somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

[ভুলে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলি] শহীদ জহির রায়হান পরিচালিত বেহুলা (১৯৬৬) - পুরো ছবির ইউটিউব লিঙ্ক সহ

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পোস্ট উৎসর্গঃ ব্লগার জাহিদুল হাসান



সাংসারিক দুঃখ কষ্টে চির অভ্যস্ত এই সমাজ একমাত্র নিজের আদর্শকে চিরদিন উচ্চ করিয়া ধরিয়া লইয়া পথ চলিয়াছে। পরাজয় যে জীবনে মানিয়া লইল, সেইত দূর্ভাগা। নৈরাশ্যমথিত হৃদয়ে আশার একটি দীপশিখাকেও যে অনির্বাণ রাখিয়া দুস্তর সংসার গাঙরে ভেলা ভাসাইয়া দিয়াছে, তাহার জীবনে বাঁচিবার মত বলেরত অভাব হয়না, এবং পরিনামে বাঁচিয়া উঠিতে পারে সে-ই।

বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী বা পদ্মাপুরানে দেবতা নাই। পদ্মা পুরান প্রকৃত মানুষেরই কাব্য।

১৯৬৫ সাল। জহির রায়হান তার প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি উর্দু ভাষায় নির্মিত* বাহানা মুক্তি দিয়েছেন। ছবিটি ছিল সেসময়কার হিসেবে বেশ ব্যয়বহুল। এই ছবিকে নিয়ে জহির রায়হান খুব আশাবাদি ছিলেন এবং সারা পাকিস্তানের বাজার ধরার জন্য উর্দুতে নির্মান করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়। হতাশ জহির রায়হান আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য খুব শিঘ্রিই একটি ব্যবসাসফল ছবি বানাতে চাচ্ছিলেন। গল্পের জন্য এবার তিনি গেলেন বাংলার এক অতিপরিচিত লোককাহিনীর কাছে, হিন্দু পুরাণ মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা লখিন্দরের উপাখ্যানকে বেছে নিলেন।

সুভাষ দত্তের কাগজের নৌকা ছবির মাধ্যমে সুচন্দা তখন মাত্র চলচ্চিত্রে এসেছেন। কাগজের নৌকা দেখে বেশ মনে ধরল জহির রায়হানের, বেহুলা চরিত্রে নিলেন সুচন্দাকে। এটি সুচন্দার দ্বিতীয় ছবি। লখিন্দরের ভূমিকায় তখনকার নায়কদের মধ্যে কাউকে তেমন পছন্দ না হওয়ায় তিনি নতুন কাউকে সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। খবর পাঠিয়ে আসতে বলেন রাজ্জাককে।

রাজ্জাকের আদিবাড়ি কলকাতায়। ষাটের দশকের শুরুর দিকে তিনি সেখানেই ফিল্মে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। সুবিধা করতে না পেরে স্ত্রী এবং প্রথম সন্তান বাপ্পাকে নিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে এলেন। এখানকার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রিতে হয়ত সুযোগ পাওয়া সহজ হবে। প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর ছোটখাট চরিত্র এবং পরিচালকদের তৃতীয়, চতুর্থ সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। এসব কাজের বেশিরভাগই অবৈতনিক, শুধু শ্যুটিংয়ের সময় খাওয়া পাওয়া যায়। এ অবস্থায় শীর্ষস্থানীয় পরিচালক জহির রায়হানের ডাক তার কাছে আকাশের চাঁদ হয়ে এল।

জহির রায়হান রাজ্জাককে প্রাথমিকভাবে পছন্দ করলেন। এক সপ্তাহ দাঁড়ি না কামিয়ে আবার তার সাথে দেখা করতে বললেন। সাত দিন পর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে পূর্ন সন্তুষ্ট হয়ে লখিন্দর চরিত্রে ফাইনাল করেন রাজ্জাককে। নায়ক হিসেবে এটিই তার প্রথম ছবি।

এছাড়া আমজাদ হোসেন সংলাপ রচনা এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীতে দায়িত্বে ছিলেন।

দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু চাঁদ সওদাগরের (ফতেহ লোহানী) ছেলে লখিন্দর (রাজ্জাক) এবং শাহী সওদাগরের (মোহাম্মদ জাকারিয়া**) মেয়ে বেহুলা (সুচন্দা)। লখিন্দরের জন্মের সাথে সাথেই দুই বন্ধু তাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। শাহী সওদাগর মনসাদেবীর (সুমিতা দেবী) একনিষ্ঠ ভক্ত, অন্যদিকে চাঁদ সওদাগরের চক্ষুশূল মনসা। চাঁদপুত্র লখিন্দরের কাছ থেকে ময়ূর (ময়ূর সাপের ক্ষতি করে বলে মনসার শত্রু ময়ূর) নাচ শেখার জন্য মনসা বেহুলাকে অভিশাপ দেয়, বাসরঘরেই সে বিধবা হবে।

চাঁদ সওদাগর অভিশাপকে অগ্রাহ্য করে তাদের জন্য লোহার বাসর ঘর তৈরীর আদেশ দেয় বিশুকে (আমজাদ হোসেন)। ক্ষুদ্ধ মনসাদেবী তার অনুচর ধুমকেতুকে মর্ত্যে পাঠায় বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য। ধুমকেতু কৌশলে বেহুলাকে অমাবস্যা রাতে শ্মশানে ডেকে নিয়ে অমৃতসুধার কথা বলে সুরা পান করিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। লখিন্দরের পরিবার মাঝরাতে বেহুলাকে শ্মশানে দেখে অসতী আখ্যা দেয়। সতীত্ব প্রমানের জন্য বেহুলা অগ্নিপরীক্ষা দিতে রাজি হয়। জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় বেহুলাকে, কিন্তু কোনরকম ক্ষতি ছাড়াই বেড়িয়ে আসে।

বিশু এমন এক লোহার বাসর তৈরী করে যাতে ধোঁয়াও ঢুকতে পারে না। মনসাদেবী তখন নতুন ফন্দি আঁটে। বিশুকে সর্পদংশনে নির্বংশ করে দেবার ভয় দেখিয়ে তাকে সেই বাসরঘরে একটি চুল পরিমান ছিদ্র করতে বাধ্য করে। কিন্তু মনসার পরিকল্পনায় একটি ফাঁক আছে, যদি বেহুলা বাসরঘরে সারারাত জেগে থাকতে পারে আর তার সতীত্ব নষ্ট না করে, তাহলে কালনাগিনী গিয়ে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বেহুলা-লখিন্দরের নিষ্পাপ প্রেম দেখে মনসার দাসীর মনে দয়া হয়। সে বেহুলাকে সাবধান করে দেয় যেন সে ঘুমিয়ে না পড়ে আর সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখে।

বিয়ে সম্পন্ন হয়। কুলপ্রথা ভেঙে বিয়ের প্রথম রাত হয় ছেলের বাড়িতে, সেই লোহার বাসরঘরে। সতীত্ব বজায় রাখে বেহুলা। ঘুমন্ত লখিনের পাশে বসে সারারাত পাহারা দিতে থাকে। একের পর এক কালনাগিনী পাঠিয়েও মনসা সফল হয় না। মর্ত্যের এক তুচ্ছ মেয়ের কাছে পরাজয় সে কিভাবে মেনে নিবে? এ তার সম্মানের প্রশ্ন। বাইরে থেকে মোরগের নকল ডাকের ব্যবস্থা করে মনসা। ভোর হয়ে গেছে, আর চিন্তা নেই ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে বেহুলা। আর সেই সুযোগে কালনাগিনী ঘরে ঢুকে কামড়ে দেয় লখিনকে।

লখিনের মৃতদেহ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। বেহুলাও সাথে চলে যায় এই আশায় যদি জলের গুনে আবার বেঁচে ওঠে লখিন্দর। দীর্ঘ এক বছরব্যাপী চলতে থাকে জলের বুকে বেহুলার সাধনা। অবশেষে মনসার যে দাসী তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, সেইই আবার তাকে নিয়ে ইন্দ্রসভায়। লখিনের কংকাল হাতে নিয়ে বেহুলা উপস্থিত হয় দেবতাদের আসরে, অনুরোধ করে তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়ার। দেবতারা শর্ত দেয়, তাদের তুষ্ট করে বর আদায় করে নিতে হবে। লখিনের কাছে যে ময়ুর নাচ শিখেছিল, সেটাই দেখিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে সফল হয় বেহুলা। কংকাল লখিনে প্রান ফিরে আসে। দীর্ঘ সাধনা আর ভালবাসা দিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে নেয় বেহুলা আর তার অনুরোধে সারাজীবনের সব রাগ, অহংকার মুছে ফেলে মনসার পুজা দিতে রাজি হয় চাঁদ সওদাগর।


বাংলা সিনেমায় আর কোন নায়িকাতে এত সুন্দর লাগেনি যতটা এই গানে সুচন্দাকে লাগছিল

বেহুলা ছবিটি আক্ষরিক অর্থেই বেহুলাময়। গল্পটাতেই বেহুলা চরিত্রটির প্রাধান্য খুব বেশি আর পরিচালকও ছবির বড় অংশই ব্যয় করেছেন এই চরিত্রের সুচন্দার মিষ্টি চেহারা বিশেষ করে তার অসম্ভব সুন্দর দীঘির মত টলটলে পটলচেরা চোখকে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে। পরিচালকের এই প্রচেষ্টা আর অভিনয় জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগটাকে সুচন্দাও কাজে লাগাতে চেয়েছেন পুরোপুরি। মনপ্রান ঢেলে কাজ করেছেন তার চরিত্রটাতে। আজও সুচন্দা তাই পরিচিত বেহুলাকন্যা হিসেবে। শারীরিক সৌন্দর্য বিবেচনা করলে তিনি এই চরিত্রে দশে একশ পাবেন। অভিনয়ের কথা যদি আসে, ছবির প্রথম দিকে তার মধ্যে খুব জড়তা ছিল। ছবি যত এগিয়েছে, ততই মনে হয়েছে তিনি অভিনয়ে পরিনত হচ্ছেন। ক্লাইম্যাক্সের ময়ুর নাচটা খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল। এখানে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। দেখেই বোঝা গেছে, সুচন্দা একেবারেই নাচ জানেন না। আর নাচ না জানা কাউকে দিয়ে ক্লাসিক্যাল নাচে কাজ করানো অসম্ভব ব্যাপার। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল বারবার পরিবর্তন করেও পরিচালক এই ঘাটতিটুকু ঢেকে দিতে পারেননি। সুচন্দাকে নাচ শেখার জন্য আরও বেশ কিছুদিন সময় দিলে ভাল হত।



নবাগত রাজ্জাকের অভিনয় দক্ষতার উপর পরিচালক খুব একটা ভরসা করেননি। তার সংলাপ এবং পর্দা উপস্থিতি ছিল নায়কের সাপেক্ষে বেশ কম। যতটুকু ছিলেন, ভালই বলা যায়। তবে এই ছবির পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খুব শিঘ্রিই নিজেকে শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ৬-৭ বছরের মধ্যেই কিংবদন্তি পর্যায়ে চলে যান।

দুই বন্ধুর চরিত্রে ফতেহ লোহানী এবং মুহম্মদ জাকারিয়া ছিলেন অনবদ্য। দুজনই বহু দিনের অভিজ্ঞ অভিনেতা, সেটা বোঝা গেছে সহজেই। খলচরিত্রে সুমিতা দেবী দুর্দান্ত। আমজাদ হোসেন বোধহয় বাংলাদেশের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড অভিনেতা। ক্যামেরার সামনে যেকোন চরিত্রে তার মত সপ্রতিভ অভিনেতা বিরল। লেখালেখি এবং পরিচালনায় অনেক বেশি সময় দেয়ায় তিনি সারাজীবনই তার অভিনয় প্রতিভাকে অবহেলা করে গেলেন। এ ছবিতেও তার অভিনয় ছিল অসাধারন।

মিউজিক্যাল এই ছবিতে গান আছে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩টি। এর মধ্যে বেশ অনেকগুলিই সিচুয়েশনাল অর্থাৎ আলাদা গান হিসেবে নয়, বরং ওই সিচুয়েশনেই শুধুমাত্র ভাল লাগবে। আলতাফ মাহমুদের সুরারোপে সবকটি গানই শ্রুতিমধুর, তবে কোন গানই কালজয়ী হবার মত না। বেহুলা ছবিটি যত বিখ্যাত, এর গানগুলি খুব একটা পরিচিত না। 'নাচে মন ধিনা ধিনা ' গানের 'শখা বাজে না বাজে না বাজে নারে, তোমার সঙ্গবিনা আমার মনের বীনা' অংশে নজরুলগীতি 'তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, মধুপূর্নিমাতে সেথা চাঁদও দোলে ' সুরের প্রভাব খুব স্পষ্ট।

পরিচালক জহির রায়হানকে সবার আগে টুপি খোলা সম্মান জানাতে হবে এই গল্পটাকে নির্বাচনের দুর্দান্ত সাহস দেখানোর জন্য। আগেই বলা হয়েছে, এটা হিন্দু পুরাণের গল্প। এই গল্পে দেব-দেবী আছে, আগাগোড়াই হিন্দু সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে কারন প্রতিটা চরিত্র হিন্দু। এই গল্প এমন এক সময়কার যখন এই ভূখন্ডে সনাতন ধর্ম ছাড়া অন্য কারও অস্তিত্ব নাই। সেই ষাটের দশকে যখন পাক-সরকার এমনকি বাংলা ভাষার উপরেও হিন্দুত্বের তকমা এঁটে দিয়েছে, সেইসময় এরকম একটি গল্প নিয়ে ছবি তৈরী করা কতটা ঝুঁকিপূর্ন সেটা বর্ননা করার মত নয়। এছাড়া যাদের জন্য ছবি, সেই দর্শকদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। তারাও এরকম পুরাণের কাহিনী শুনতে কতটা আগ্রহী হবে, সেটাও যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার। জহির রায়হান সেই ব্যয়বহুল ঝুঁকি নিলেন এবং কি দারুনভাবে সফল। রেকর্ড পরিমান ব্যবসা করেছিল এই ছবি। সামান্য ছোটখাট দু'একটা ত্রুটির কথা উল্লেখ করা যায় অবশ্য। বিশু এবং তার স্ত্রীর খুনসুটিটা কাহিনীতে অপ্রয়োজনীয় ছিল। এই অংশটা কমিয়ে বরং বেহুলা ও লখিনের প্রেমময় সম্পর্কের বিকাশকে আরেকটু বিস্তারিত দেখানো যেত। বিশুর স্ত্রী চরিত্রের মেয়েটির অভিনয়ও ভাল হয়নি।

সবমিলিয়ে বেহুলা ছবিটি বাংলা ক্লাসিক ছবির ভক্তদের অবশ্যই দেখা উচিৎ।


ইউটিউবের এই লিঙ্কে পুরো ছবিটাই আছে। এর দৈর্ঘ এক ঘন্টা ৫৭ মিনিট। সমস্যা হচ্ছে, সেসময়কার একটা বাংলা ছবির দৈর্ঘ এত কম হবার কথা না। তাই আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল যে দু'একটা দৃশ্য বাদ পড়ে গেছে কিনা! কিন্তু ছবিটা দেখে সেরকম কিছু বোঝা যায়নি। এই বিষয়ে খোঁজখবর করছি যে অনলাইনে কোথাও আসল ছবির দৈর্ঘের ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা, এখন পর্যন্ত সফল হইনি।


বেহুলার ফেসবুক পেইজ


ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে মুখোমুখি নায়িকা বেহুলারুপী সুচন্দা ও খলনায়িকা মনসাদেবী সুমিতা

দু'টি প্রাসঙ্গিক তথ্য

সুমিতা দেবীর প্রথম স্বামী অমূল্য লাহিড়ী ছিলেন বাম আন্দোলনের কর্মী, চলচ্চিত্রের বাইরের লোক। সেই সংসারে সুমিতার সন্তানও ছিল। এদেশ তোমার আমার ছবিতে কাজ করার সময় ছবির সহকারী পরিচালক জহির রায়হানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয় এবং '৬১ সালে তারা বিয়ে করেন। ৬৫ সালের শেষ দিকে যখন বেহুলার শ্যুটিং শুরু হয়, জহির-সুমিতা দম্পতির দু'টি ছেলেও আছে। এই ছবির কাজ চলাকালীন জহির রায়হানের সাথে অবিবাহিতা সদ্য তরুনী সুচন্দার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুমিতা দেবীও ছবিতে থাকলেও এই সম্পর্কের বিষয়টা আঁচ করতে পারেননি কারন পুরো ছবিতে মাত্র এক মিনিটের একটি দৃশ্যে সুমিতা এবং সুচন্দা এক ফ্রেমে ছিলেন (এই দৃশ্যেরও শট ডিভিশন এবং ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল দেখে বোঝা মুশকিল যে তারা আসলেই এক ফ্রেমে ছিলেন নাকি আলাদা ধারন করে জোড়া লাগানো হয়েছে!)। বেহুলা ছবির কাহিনীর মতই সুচন্দার কাছে সুমিতা পরাজিত হন। '৬৮ সালে জহির রায়হান বিয়ে করেন সুচন্দাকে। ৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারী জহির রায়হানের রহস্যজনক অন্তর্ধানের আগ পর্যন্ত তাদের এই সম্পর্ক অটুট ছিল। আরও বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করে সুচন্দা ৭৫ সালে জনৈক রেজাউল মালিক খান মনুকে বিয়ে করেন। এই ভদ্রমহিলার ভাগ্য আসলেই খারাপ, তার এ স্বামীও বিয়ের কয়েক বছর পরেই মারা যান।

অনেক বছর পর আশির দশকে সুচন্দা তার নিজের প্রোডাকশন হাউস থেকে চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় বেহুলা পূনর্নির্মান করেন। এবার অবশ্য ছবিটির নামকরণ করা হয় বেহুলা ও লখিন্দর। ববিতা এবং ফারুক প্রধান চরিত্র দুটিতে অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিটি খুব একটা ব্যবসাসফল হয়নি।

______________________________________________
* জহির রায়হান বা সমসাময়িক অন্যান্য পরিচালকদের উর্দু ছবি নিয়ে অনেকের মধ্যে একটু নাক সিঁটকানো ভাব আছে। তার মত একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদী শিল্পী কেন উর্দুতে দুটো (বাহানা এবং সঙ্গম) ছবি নির্মান করেছিলেন, সে প্রশ্ন অনেকের। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাকে কোন খারাপ কিছু মনে করি না। উর্দুর সাথে সেসময় আমাদের কোন দ্বন্দ্ব ছিল না, বরং এটা দেশের অন্যতম রাস্ট্রভাষা। এছাড়া ছবিটা উর্দুতে বা দুই ভাষায় তৈরী করলে দ্বিগুন আকারের একটা বাজার পাওয়া যেত। বাজার বড় হলে মুনাফা বেশি, ফলে ছবির গুনগতমান বাড়ানো যায়। যেমন সঙ্গম পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি। রঙিন ছবি নির্মানে যে বিশাল ব্যয় সেটা হয়ত শুধু বাংলার বাজার দিয়ে পোষানো যেত না। প্রসঙ্গত, বাংলার পরিচালকদের বেশিরভাগ উর্দু ছবিই আবার বাংলায় ডাব করে এ অঞ্চলে প্রদর্শন করা হত।

** মোহাম্মদ জাকারিয়াকে অনেকে নাও চিনতে পারেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রবীন অভিনেতা। কলকাতার বহুরুপী নাট্যসংস্থায় শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় রক্তকরবীতেও তিনি কাজ করেন। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। মারা গেছেন পনের-বিশ বছর আগে।

--------------------------------------------------------------------------

ব্লগার জাহিদুল হাসান একজন চমৎকার ফটোগ্রাফার। তার ফটোব্লগগুলির আমি বড় ভক্ত এবং নিয়মিত ভিজিটর। ইদানীং মাইক্রোফটোগ্রাফি নিয়ে আছেন, মৌমাছির মধ্যেও যে সৌন্দর্য আছে সেটা আমি তার ফটোর মাধ্যমেই জানলাম। তবে ভাল ফটোগ্রাফারের চেয়েও অনেক চমৎকার একজন মানুষ তিনি। যেকোন 'ক্যামেরা কিনতে চাই, সাহায্য করেন' টাইপ পোস্টে তার মন্তব্য পাবেনই পাবেন এবং সবচেয়ে ভাল পরামর্শটাই বোধহয় তার কাছ থেকে পাবেন। কয়েকদিন আগে স্মার্টফোন কেনার ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন। আমি সেলফোনের ব্যাপারে কোন উৎসাহী না, ভাল-মন্দ খোঁজখবর রাখি না। কিন্তু সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিল, আহা! যদি এই বিষয়ে জানতাম আর এই ছেলেটাকে পরামর্শ দিয়ে একটু সাহায্য করতে পারতাম!!! যাই হোক, পরামর্শ তো দিতে পারলাম না। এই পোস্টটা দিলাম তাকে।

পুনশ্চঃ সম্প্রতি কিছু বাজে লোকের কারনে ব্লগে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর বলি হয়েছেন জাহিদুল হাসান। তাকে জেনারেল করা হয়েছে। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে আন্তরিক অনুরোধ জানাই, পরিস্থিতি পূনর্বিবেচনা করে এবং ব্লগে তার সুনামকে সম্মান দিয়ে শাস্তি মওকুফ করা হোক। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১০:১২
৫২টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×