#(তিন)#
'আমার খুব হাটঁতে ইচ্ছে করছে। অনেক দূর পথ! রাতের আধাঁরের বুনো নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে অসমাপ্ত সময় পর্যন্ত। '
'এত রাতে? আপনি কি পাগল?'
'সত্যি বলছি! হয়ত বা পাগলামী। কিন্তু, সত্যি। মানুষের কি মাঝেমাঝে এমন পাগলামী করতে ইচ্ছে করে না? আপনার কখনো ইচ্ছে করেনি? করে না কখনো?'
'ওগুলো তে জেনারেলাইজড কথা। মানুষের কতকিছু করতে ইচ্ছে করতে পারে! তবে সব ইচ্ছের পেছনে কারণ থাকে। কারণ ছাড়া কোনোকিছু হয়না। পাগলামীর ও কারণ থাকে। কেউ সত্যি সত্যি পাগল বলে পাগলামী করে। কেউ কষ্টে, কেউ আনন্দে, কেউ কোনো কিছু করার না থাকলে দিশেহারা হয়ে। তবে আমি পাগলামী বলে কিছুকে বিশ্বাস করতে রাজী নই। সবকিছুরই উদ্দেশ্য থাকে। আর যেটার পেছনে উদ্দেশ্য থাকে সেটা কি পাগলামী হতে পারে? ' নীরা একটানে বলে যাচ্ছিল কথাগুলো।
সত্যিই সেদিন আমার হাটঁতে ইচ্ছে করছিলো। একাকী নির্জনতায়। নীরার হাতে হাত রেখে। কথাটা কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই ভণিতা করিনি। বুঝতে পারছিলাম না ঐ মধ্য রাতে একটা মেয়েকে এভাবে কথাটা বলার প্রতিউত্তর কি হতে পারে। যার সাথে হৃদয়ের কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই, কেবল পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাই যে সম্পর্কের ভিত্তি। মনের মধ্যে একরকম দ্বিধা নিয়েই শুরু করলাম। তবে শুরুটা ওভাবে ছিলো না। অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে শুরু করেছিলাম। ওপাশে ছিলো অবাক হওয়া কণ্ঠ। কিছুটা বিস্ময় এবং ভদ্রতায় জড়ানো অতি ফরমাল কথামালা। অস্বস্তির রেশটা কাটতেই ইচ্ছের কথাটা তুলেছিলাম। এপাশ থেকেই বুঝতে পারছিলাম ওপাশে নীরার বিস্ময়াবনত কন্ঠে অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
'আজ কি আকাশে চাঁদ উঠেছে? আপনার জানালা দিয়ে কি আকাশ দেখা যায়? আকাশে চাঁদ থাকুক আর না থাকুক, আমি হাঁটবো। আপনাকে সাথে নিয়ে। চলুন না হাঁটি! প্লীজ! অনেক ইচ্ছে করছে।'
সকল দ্বিধা, সংকোচ কাটিয়ে এত রাতে ফোনটা যেহেতু দিয়েই ফেললাম ইচ্ছের কথাটা বলতে দ্বিধা করিনি। এ কেবল ইচ্ছের কথা বলা নয়। ভালোলাগার প্রথম প্রকাশ। জানিনা এমন উদ্ভট কথা দিয়ে কেউ প্রথম ভালোলাগার প্রকাশ ঘটানোর উদ্ভট চিন্তা কখনো করেছে কিনা। আমার মত উদ্ভট মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব।
ফোনের ওপাশে স্তব্ধতা।
'হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন?
'হ্যাঁ পাচ্ছি। বলেন।' বেশ খানিকক্ষণ পরে নীরার শান্ত উত্তর।
'আমি কিন্তু বলেছি হাটঁবো।'
'হ্যাঁ, বলেছেন তো। আমারও এভাবে অনেক রাতে নিশুতি নির্জনতায় মাঝে মাঝে হাঁটতে ইচ্ছে করে। এটা হতেই পারে।'
নীরা সাবলীলভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারছি ও কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু এটা বুঝতে না দিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে নেয়ার চেষ্টা করছে।
নীরার সাথে এভাবে এত কাছাকাছি টাইপের কথা বলার মত কোনো সম্পর্ক আমাদের মাঝে নেই। তাই সে হয়ত ধরে নিয়েছে কোথাও কোনো গড়বড় আছে। আমি কোনোভাবে ডিস্টার্বড। অথবা অন্য কোনো সমস্যা আছে। হয়ত বোঝার চেষ্টা করছে সেটা কি। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে পরষ্পরের প্রতি সম্মানের একটা জায়গা আছে। সেখানটায় সে আঘাত করতে চাচ্ছেনা। তাই এতটা ভদ্র, শান্ত স্বরে কথা বলছে। না হয় নীরা যে ধরণের মেয়ে এই রাতদুপুরে এইসব উদ্ভট কথার জবাবে এতটা শান্ত থাকার কথা নয়। আমার স্থানে অন্য কেউ হলে হয়ত সেটা হতোনা। যা-ই হোক আমাদের সম্পর্কের সম্মানের জায়গাটা আমার জন্য বেশ কাজ দিয়ে দিলো। আমি ও সম্পর্কের মাত্রাটাকে সঠিকভাবেই কাজে লাগালাম।
'তাহলে আমার আর হাঁটা হলোনা আপনার সাথে। আমার ইচ্ছেটা অপূর্ণ রয়ে গেলো। '
'সবসময় সব ইচ্ছে পূরণ হতে হয়না । ইন ফ্যাক্ট, সব ইচ্ছে সবসময় পূরণ হয় ও না। এটাই জীবন। জীবনের স্বাভাবিকতা। আপনি খোঁজ
নিয়ে দেখবেন ইচ্ছে পূরণ না হওয়ার গল্প নেই এমন মানুষ একটিও পাবেন না।'
'হুম! তবে আমার মত দুখী মানুষ কিংবা পোড় খাওয়া মানুষের গল্পগুলো একটু অন্যরকম হয় আর কি! বলতে পারেন 'কষ্টভোলার গল্প'।'
'হাহাহাহাহা! খুব সুন্দর বললেন তো! 'কষ্টভোলার গল্প'!!"
অনেকক্ষণ পর নীরার চিরচেনা হাসি। ওর হাসি'টা আমার জন্য খুব প্রত্যাশিত একটা কিছু। নাহ্, ওর হাসিতে কোনো মাদকতা নেই। হাসলে নীরাকে পরীর মত লাগে এরকম কিছু ও নয়। ঐ হাসিতে অন্যরকম একটা শক্তি আছে। নীরা হাসলে মনে হয় চারপাশের সবকিছু হাসছে। ও যখন হাসে না তখন চারপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে থাকে। ও সবকিছুকে হাসাতে পারে।
নীরার সাথে কথা বলছি প্রায় মিনিট বিশেক হয়ে চলল। তার সাথেই কেন হাঁটতে ইচ্ছে করছে, সে-ই কেন এত রাতে হঠাৎ আমার গল্প করার মানুষ হয়ে গেলো এধরণের কোনো প্রশ্নই নীরা করছে না। খুব কৌশলে কথোপকথনের গভীরতাকে সে এড়িয়ে যেতে চাইছে। এটা একদিকে ভালো। কারণ, এর অর্থ হচ্ছে এত রাতে তাকে ফোন দেয়ার উদ্দেশ্য এবং আমার ভেতরের ভালোলাগার অনুভূতিটা সে কিছুটা বুঝতে পেরেছে। তাই মূল প্রসঙ্গ থেকে পালানোর চেষ্টা। ও এতটুকু বুঝলেই হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু এখন আমার চাওয়া নেই।
হঠাৎ বাইরে ঝুমঝুম শব্দ। জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। আচমকা একটা শীতল হাওয়া এসে পুরো শরীর কাঁপিয়ে দিলো। এই শীতের বিকেলে বৃষ্টি! বেশ লাগছে। কিন্তু, এই ভালোলাগাটার চেয়ে এতক্ষণের স্মৃতি রোমন্থন ঢেঁর ভালো ছিলো। ওটা ছিলো আমাদের কাছাকাছি আসার প্রথম কথোপকথন। স্মৃতির পাতায় নীরাকে দেখতে ভালোই লাগছিলো। কতদিন নীরাকে এভাবে অনুভব করা হয়ে উঠে নি!
অনুভব গুলো কি এভাবে বুড়িয়ে যায়! সেদিনের সেই অনুভূতি কেমন প্রখর ছিলো! এমন হালকা কথোপকথনে ও কতটা প্রখর অনুভূতি ছিলো। কতটা ভালোলাগা! কতটা আবিষ্টতা! 'সেদিন' আর 'আজকের' অনুভবের পার্থক্যটা আমার নিজের কাছেই যেখানে এতটা প্রখর হয়ে উঠেছে, নীরার কাছে তো অবশ্যই। যার জীবনবোধ এতটা প্রখর। যে মুখ দেখেই জেনে যায় অনুভবের গভীরতা। যার কাছে স্পর্শহীন অনুভব স্পর্শের চেয়েও মূর্ত হয়ে উঠে কোনো কোনো সময়। তার কাছে তো অবশ্যই.....!
নীরার অভিমানী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ওই অভিমানী চোখে আমার বদলে যাওয়া চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট।।
# (চার) #
গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুর গড়িয়ে বিকেলের গায়ে হেলে পড়েছে। আমরা হাটঁছিলাম ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে। অনতিদূরে শান্ত দেহে বয়ে চলেছে নদী। চারপাশ প্রায় ফাঁকা। মানুষজনের তেমন একটা আনাগোনা নেই। গ্রীষ্মের দাপদাহে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে সকলে হয়ত ভাতনিদ্রায় মগ্ন। ক'দিন ধরে নীরার অনুপস্থিতি আমাকে খুব জালাচ্ছিল। ও জরুরি কাজে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো। এ কয়দিন ওকে দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। নীরাকে ছাড়া অলস সময়গুলো কেমন যেন থমকে ছিলো। আমার এমনিতে খুব ব্যস্ত সময় কাটে। এ ক'দিনও ব্যস্ততার কমতি ছিলো না। কিন্তু নীরাকে ছাড়া ব্যস্ত সময়গুলো ও কেমন যেন অলস হয়ে উঠে।
গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেই নীরা ফোন দেয়। বুঝতে পেরেছি সেও হয়ত আমাকে অনুভব করেছে আমিহীন সময়গুলোতে। তবে ওর অনুভবের তীব্রতা আমার অস্থিরতাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে যায়নি। সেই প্রথম কথোপকথনের পর বেশ অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। এখন আমরা অনেকটা কাছাকাছি। মানে হৃদয়ের কাছাকাছি। 'কাছাকাছি' শব্দটা আমার বেলায় যেভাবে জোর দিয়ে বলতে পারি নীরার ক্ষেত্রে পারি না। কারণ, ও কেবল আমার অনুভূতির কথাগুলো জানতে শুরু করেছে মাত্র। যতখানি অনুভব সে জেনেছে, তার কতটুকু বিশ্বাসে নিয়েছে জানিনা। খুব বেশি নয় অবশ্যই। ওর কাছে সবকিছুর পেছনে কারণ লাগে, যুক্তি লাগে, যথাযথ ভিত্তি লাগে। নীরা একসাথে অসম্ভব কঠিন, প্রচন্ড বাস্তববাদী কিন্তু প্রখর জীবনবোধে তাড়িত একটা মেয়ে। তাই আদতে ওর অনেক কাছাকাছি গেলেও কার্যত খুব কাছাকাছি নিজেকে নিতে পেরেছি বলে মনে হয়না। আমরা একই এলাকায় থাকি। মানে একই আবাসিকে। একই গলিতে দুটো বিল্ডিং পেরিয়েই ওর বাসা। দু'জনের অদেখা সময়ের কষ্টগুলোকে ভাগাভাগি করতে সময়ক্ষেপন না করে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। ইট পাথুরে আবহকে মুছে ফেলতে গাড়িতে দু'ঘন্টার রাস্তা পেরোতে হলো।
'আচ্ছা তুমি এমন মন খারাপ করে আছ কেন বল তো! তোমাকে এমন দেখতে ভাল্লাগেনা।'
'নাহ্! আমি একদম ঠিক আছি।'
'মোটে ও না। ওই যে কপালের ভাঁজ দুইটা ... ওটা বলে দিচ্ছে তুমি ভালো নেই। কোনো কারণে তোমার মন খারাপ। তুমি ওই দুইটা রেখার মধ্যে নিজেকে আড়াল করতে চাইছ। নিজেকে লুকোনো কি অত সহজ!'
'তোমার এমন মনে হয় কেন বল তো! মানুষ তো মাঝে মাঝে একটু চুপচাপ থাকতেই পারে, তাই না? চুপচাপ থাকা মানেই কি মন খারাপ?' আমার চুপচাপ থাকা, মন খারাপের মুহুর্ত সব কেমন করে যেন ও ঠিক ঠিক পড়ে নেয়।
'সেটা কখনোই নয়। চুপচাপ অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু তোমার এই নীরবতার অর্থ আমি বুঝি। এটা আমাকে অন্য কিছু বলে দেয়। তুমি তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখ তোমার চেয়ে কত বেশি রকমের দুঃখে আছে কত মানুষ। কত মানুষ কত অপূর্ণতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তুমি কত মানুষের চেয়ে ভালো আছ। তবুও ইদানিং তুমি এমন মন খারাপ করে থাকো কেন? জানিনা কিসের এমন কষ্ট তোমার। সব কষ্ট গুলোকে ছুটি দিয়ে দিতে পারোনা? দাওনা ছুটি সব কষ্টগুলোকে! তুড়ি মেরে ঐ আকাশে মেঘের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।' বলে নীরা চিরচেনা রূপে হেসে উঠলো।
নীরার দিকে তাকিয়ে আমি ছোটো করে হাসলাম। ও যেন আমাকে কাউন্সেলিং দিচ্ছে। 'অথচ তুমি কি জানো না তোমার জন্যই এইক'দিন এভাবে অস্থির হয়ে আছি ! তোমার অনুপস্থিতি আমাকে কতটা পীড়া দেয় তা কি তুমি বোঝনা?' মনে মনে বিড়বিড় করলেও নীরাকে বলতে ইচ্ছে হলো না। ও বিশ্বাস করবে না।
আমার মন খারাপের মেঘ আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করলো। সব ক'টি অস্থির দিন পেরিয়ে নীরা আমার পাশে আছে এতেই অব্যক্ত এক ভালোলাগা আমাকে ছেঁয়ে আছে। ও বুঝুক আর না বুঝুক, বিশ্বাস করুক আর না করুক তাতে আমার কি যায় আসে! এই ভালোলাগা তো একান্ত আমার। এই ভালোলাগা নিয়ে কোনো কবি কবিতা লিখবে, এ রকম হাজারো বিকেল প্রতিদিন আমার হবে, কিংবা ও কথা বিশ্বাসে নিয়ে নীরার চোখে দু ফোঁটা অশ্রু টুপটাপ করে ঝরে পড়বে এগুলোর কোনোটাই আমার চাওয়া নয়। নীরার পাশে থাকাটাই তো শুধু চাই।
নীরার পাশে থাকা আমার কাছে এতটা অর্থবহ ছিলো ওইসময়। মন চাইতো ওর পাশাপাশি থাকা সময়গুলো যেন থমকে থাকুক। আমি আরো কিছুক্ষণ ওই ভালোলাগাটুকু অনুভব করি। আমার মত করে।
বোধহয় ওটাকেই প্রেমে পড়া বলে। আমি ওর প্রেমে পড়াটা এভাবেই উপলদ্ধি করছিলাম প্রতিটি প্রহরে, পলে পলে, অসহ্য অস্থিরতায়।
(চলবে)
ছবি : ইন্টারনেট
(গল্প: 'ভালোলাগা' এক পরজীবী কষ্টের নাম! প্রথম পর্বের লিংক: )
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২২