মধুমতি নদীটা সুন্দর।
অবশ্য বাংলাদেশের সব নদী'ই আমার ভালো লাগে। পাহাড়, সমুদ্র আর নদী সবার'ই ভালো লাগার কথা। বাংলাদেশ তো নদীর দেশ। ২৩০ টা নদী আছে আমাদের। একটি দেশের জন্য নদী অনেক বড় সম্পদ। এই সম্পদ আমরা যথাযথ কাজে লাগাতে পারছি না। দেশের দায়িত্বে থাকা দুর্বল, অদক্ষ লোকদের কারনে আমরা নদী থেকে উপকার কম পাচ্ছি। বরং এ সমস্ত নদী ভেঙ্গে ঘরবাড়ি আর ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোকসান। আমাদের দেশ আজও নদী শাসন করা শিখলো না। ফলাফল প্রতিবছর ক্ষতি। যাই হোক, খবরের কাগজে পড়লাম, এক বিরাট বিদেশি জাহাজ মধুমতি নদীতে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। সেই ডুবে যাওয়া বিশাল জাহাজ দেখার জন্য আমি ছুটে চললাম- মধুমতি নদীতে।
জাহাজ এর নাম স্টিভ অস্টিন।
আমি মধুমতি'র পাড়ে দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি দেখলাম, জাহাজটি অর্ধেক ডুবে গেছে। বাকিটা হয়তো কয়েক ঘন্টার মধ্যে ডুবে যাবে। আমার মন বলছে, জাহাজের মধ্যে একটি মেয়ে আটকা পড়ে গেছে। মেয়েটি বের হতে পারছে না। শুনেছি, জাহাজে ১০৫ টা কেবিন আছে। কোনো একটা কেবিনে মেয়েটা আছে। মেয়েটাকে আমি উদ্ধার করতে চাই। একা একা মেয়েটা না জানি কত ভয় পাচ্ছে। মেয়েটার জন্য আমার বুকের মধ্যে হাহাকার করছে। যে করেই হোক আমি মেয়েটিকে বাঁচাবো। আমি মনে মনে 'জয় বাংলা' বললাম। জয় বাংলা বললে মনে শক্তি আসে। ভরসা আসে। আমি একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে জাহাজটির সামনে যেতেই- এক পুলিশ অফিসার বলল- না, জাহাজের কাছে আসা যাবে না। নো, নেভার। প্লীজ।
পুলিশ অফিসারের কথা আমি কানে নিলাম না।
যে করেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। মেয়েটা হয়তো আমারই অপেক্ষায় আছি। আমি নৌকায় করে মধুমতি নদীতেই অবস্থান করছি। বেশ বড় বড় ঢেউ দিচ্ছে আজ! আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। আমি জানি না সাঁতার। মাঝি ব্যাটা নিশ্চয়ই জানে। মাঝি কি আমাকে বাঁচাবে? অবশ্য বিপদের সময় নিজে বাঁচাই ফরয। আমার নৌকার মাঝি বলল- আপনাকে আগেই কইছিলাম- ওই জাহাজের সামনে যাওয়া নিষেধ আছে। আপনি নিষেধ মানলেন না। সমস্যা হবে আমার। আপনি তো শহরেই চলে যাবেন। আমার তো এই মধুমতিতেই আমৃত্যু থাকতে হবে। পুলিশ অফিসারটি সমানে চিৎকার করে যাচ্ছেন। আমি মাঝিকে সাহস আর ভরসা দিয়ে-দিয়ে চলে এলাম একদম জাহাজের সামনে। আমাদের নৌকাটা জাহাজের সামনে আসতেই আমি লাফ দিয়ে জাহাজে উঠে পড়লাম। মাঝি আমাকে রেখে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
পুলিশ অফিসারটি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
পুলিশ অফিসারটি বলল, সাহস করে চলেই যখন এসেছেন, তাহলে দুপুরে আমার সাথে ভাত খান, খুব খুশি হবো। মেন্যু অতি সামান্য। ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে করলা ভাজি, বাইল্লা মাছের সালুন আর ডাল। হঠাত আমার মনে হলো- পুলিশ অফিসারটি চাচ্ছেন- আমি যেন এই ডুবে যাওয়া জাহাজটির সাথে তলিয়ে যাই। দুপুরে বেশ আরাম করেই খেলাম। পুলিশ অফিসারের স্ত্রীর রান্নার হাত অনেক ভালো। খাবার গুলো বেশ স্বাদ হয়েছে। আমি বললাম, ভাবীকে বলবেন। রানা ভালো হয়েছে। তৃপ্তি করে খেয়েছি। অফিসার বলল, তাহলে জনাব একদিন আমাদের বাড়ি আসেন। মনিরা হাঁসের মাংস খুব ভালো রাধে। হাঁসের মাংস দিয়ে চালের আটার রুটি। আমি বললাম, দেখি। সময় পেলে আসবো। অফিসার বলল, না আপনাকে আসতেই হবে।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম-
পুলিশ অফিসারটি আমার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু কোথায় তার সাথে আলাপ হয়েছে তা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আমি মনে করার চেষ্টা করছি, ঠিক এমন সময় নদীতে ঝড় শুরু হলো। বিকট ঝড়। এমন ঝড় দেখে আমার কলিজা উড়ে যাচ্ছে যেন! বাতসের ধাক্কায় আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। পুলিশ অফিসার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে- ধরুন, আমার হাত ধরুন, নয়তো আপনি ডুবে যাবেন। সময় খুব কম। আমি এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে পুলিশ অফিসারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ঠিক তখন কে যেন আমার কানে ফিস ফিস করে বলল- 'প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা'। দুর্যোগের সময় মানুষ অনেক ভুলভাল দেখে, ভুলভাল শুনে। বিশাল একটা ঢেউ আমাদের দিকে আসছে।
ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারা শরীর ঘামে ভেজা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ভোর চারটা। আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। সুরভি গভীর ঘুমে। বাম পাশ ফিরে, বাম হাত, বাম গালে রেখে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। দেখে ভীষন মায়া লাগলো। মনে পড়লো অনেকদিন সুরভিকে নতুন শাড়ি কিনে দেই না। আজ একটা দামী শাড়ি কিনে দেব। সুরভিকে বিকেলে বলবো, চলো রিকশা করে কিছুক্ষন ঘুরে আসি। তখন বেইলী রোড থেকে সুরভিকে প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে একটা শাড়ি কিনে দেব। সাদার মধ্যে ছোট ছোট নীল ফুল আঁকা থাকবে। কলেজে থাকতে লিলি মিসকে এরকম একটা শাড়িতে দেখে ছিলাম। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম, আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। ভোরের আকাশ দেখা- দারুন একটা ব্যাপার। এক কাপ চা পেলে দারুন হতো- ভাবতেই সুরভি চা নিয়ে এসে হাজির। এই মুহুর্তে সামান্য এক কাপ চায়ের জন্য মনে হচ্ছে জীবনটা আনন্দময়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:৪৩