শাহ আহমদ শফী ১৯২০ কারও মতে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়াটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। কারও মতে ১০৩ বছর বয়সী এই আহমদ শফী ১০ বছর বয়সে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। ১৯৪১ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে চার বছর হাদিস, তাফসির, ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে। ১৯৪৬ সালে দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়।
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠানের মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পায়। পরবর্তী সময়ে শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন করে আহমদ শফী। ২০০৮ সালে তিনি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারী দারুল উলুম হাটহাজারী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হয়। আহমদ শফি এর প্রতিষ্ঠাতা আমির মনোনীত হয়।
এভাবেই তার জীবনী প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে মাঝখানের ৪০ বছর সে কোথায় ছিল কি করলো কিছুই প্রকাশ করা হয় না।
স্বাধীনতা পূর্ব কালে নেজামী ইসলামের সদস্যপদ গ্রহণ করে আহমদ শফী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ‘মুজাহিদ বাহিনী’ গঠন করে। পাকিস্তানীদের সব ধরণের সহযোগিতায় ঐ অঞ্চলের অমুসলীমদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া, লুঠ, অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার সাথে জড়িত ছিল এই ‘মুজাহিদ বাহিনী’।
কথিত আছে হাটহাজারী মাদ্রাসার কাছে অবস্থিত একটি মন্দির এই আহমদ শফীর নেতৃত্বে যুদ্ধকালীন সময়ে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যুদ্ধ শেষে এই শফীর ভোল পাল্টাতে একটুও দেরী হয়নি রাতারাতি এই শফী সেই মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির পুনর্নির্মাণ করে। সে সময়ে কিছুদিনের জন্যে সে আত্মগোপনে চলে যায়।
এই সেই হাটহাজারী মাদ্রাসা যেখানে স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজাকার-আলবদর সদস্যরা আশ্রয় নেয় এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর লেবাসে নিজেদের পুনর্গঠিত করতে থাকে। এখানেই শিবিরের ক্যাডারদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হত বলে জানা যায়।
শায়খ আব্দুর রহমান, মুফতি হান্নানসহ হুজি-জেএমবি-জামাতের অসংখ্য জঙ্গি তাদের প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ এখান থেকেই নিয়েছে। এই মাদ্রাসা থেকেই আফগানিস্তান-পাকিস্তানসহ বহু দেশে জঙ্গি সাপ্লাই করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের শুধু নয় এই আহমদ শফীর অদৃশ্যমান এক প্রবল আধিপত্য রয়েছে সারা দেশের অসংখ্য কওমী মাদ্রাসার উপর। টেকনাফ থেকে ফেনী, প্রায় সবগুলো মাদ্রাসা চলে আসছে শফীর অলিখিত নির্দেশে।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই শফীর অনুসারীদের সংশ্লেষ পাওয়া যায়।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অন্যতম ক্রীড়নক মুফতি হান্নানের সাথে এই শফীর সম্পর্ক মুফতি হান্নান নিজেই জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ করেছিল।
এই সেই আহমদ শফী যার হাজার হাজার ছাত্র সারা দেশে অবস্থান করে হুজি-জেএমবি-জামাত-শিবির-ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটে (আমিনী) জড়িত থেকে দেশ জুড়ে ধর্মের লেবাসে সন্ত্রাস-খুন-লুট-অগ্নিসংযোগ নাস্তিক-মুরতাদ ফতোয়া দিচ্ছে এবং জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে।
পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর ই তৈয়াবা, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, তাহরিকুল জিহাদ আল ইসলামী, হরকাতুল মুজাহিদীন, হিজবুল মুজাহিদীন, জমিয়াতুল মুজাহিদীন, হরকাতুল আনসার, ইত্যাদি সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত লালখান মাদ্রাসার মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, তার ছেলে লস্কর ই তৈয়াবার এদেশীয় প্রধান সংগঠক হারুন ইজহার, ওসামা বিন লাদেনের ঘনিষ্ট সহচর দারুল মা আরিফ মাদ্রাসার আল্লামা সুলতান যওক নদভী, লাদেনের আরেক সহচর সিলেটের কাজীর বাজার মাদ্রাসার মওলানা হাবিবুর রহমান, আফগান ফেরত তালেবান জঙ্গি সংগঠনের পুরোধা মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, জুনায়েদ বাবুনগরী, নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা তৈয়্যব, আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতি ওয়াক্কাছ, জুনাইদ আল হাবিব, আবদুর রব ইউসুফী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, প্রমুখ তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সহকারী যা হাটহাজারী মাদ্রাসা ও ২০১০ সালে তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গঠিত হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যায়।
ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে হেফাজতের সাথে দ্বন্দের এক পর্যায়ে চরমোনাইয়ের পীরের রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন ইসলামী আন্দোলনের এক মহাসমাবেশে মতিঝিলে বিলি করা দলের এক নেতার নামে ‘হে আল্লাহ পীর সাহেব চরমোনাইকে কবুল কর’ শিরোনামে প্রকাশ করা একটি পুস্তিকায় হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ পাওয়া যায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরু করলে আহমদ শফী মুখোশ খুলে ফেলে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নামে। তথাকথিত ১৩ দফা দাবী প্রণয়ন করে যা বাংলাদেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী।
১৩ দফা আদায়ের নামে লং মার্চ ও অবরোধের ঘোষণা দিয়ে ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল এবং ৫ মে আহমদ শফী তার দলবলসহ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে সাংবাদিক/নারী সাংবাদিকসহ সাধারণ পথচারীকে মারধর, হেনস্তা ও লাঞ্ঝিত করা থেকে শুরু করে, সড়ক দ্বীপ ধ্বংস, বৃক্ষ নিধন, গাড়ী ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, এটিএম বুথ/ব্যাংক/হাউজ বিল্ডিং/সিপিবি অফিসে হামলা-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ, বায়তুল মোকাররম মসজিদের জায়নামাজে অগ্নিসংযোগ, বায়তুল মোকাররমের ইসলামী বইয়ের দোকান ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, দোকানের কোরান ও হাদিসের নানা বই রাস্তায় ফেলে অগ্নিসংযোগ করে। সারাদিনের তান্ডবে শাপলা চত্বর ও মতিঝিল-পল্টন এলাকায় কয়েকজন নিরীহ মানুষ নিহত হয়।
৫ মে শাপলা চত্বর থেকে তাদের উৎখাতের জন্যে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অত্যন্ত বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেন এবং বিভিন্ন মহলের চাপের মধ্যেও অনড় থেকে তিনি আহমদ শফী ও তার দলবলকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করেন। অত্যন্ত সুচারুভাবে পরিচালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত সে অপারেশনে তেমন কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও আহমদ শফীরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী হত্যার গল্প ফেঁদে বসে, যদিও আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই দিনে সে মিথ্যাচার ধোপে টেকেনি।
বিবাহের ন্যূনতম বয়স, নারী শিক্ষার বিরোধীতা, ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যায়িত করে নানা বক্তব্য, নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য, নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কেও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং বাঙালী সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গ ও প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বার বার সমালোচিত হয় হেফাজতের আমীর ও হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রাক্তন মহাপরিচালক ও উপদেষ্টা শাহ আহমদ শফী।
(সংগ্রহ)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৩২