জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' কবিতাটি পড়েননি এমন পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে। অদ্ভুত একটা কবিতা। বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দকে বলেছিলেন- ‘প্রকৃত কবি এবং প্রকৃতির কবি’। কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায়। আপাত দৃষ্টিতে 'বনলতা সেন' একটি প্রেমের কবিতা যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনলতা সেন নাম্নী কোনো এক রমণীর স্মৃতি রোমন্থন। এডগার এলেন পো'র 'টু হেলেন' কবিতার সাথে 'বনলতা সেন' কবিতাটির খুব বেশি মিল।
জীবনানন্দ দাশ আজ থেকে ৮৬ বছর আগে বরিশালে বসে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। জীবনানন্দের কবিতায় সুস্পষ্ট বক্তব্য ও দর্শন আছে। কবি এই কবিতায় যে রহস্য তৈরি করেছেন সেই রহস্য এখনো ধোয়াশা। অনেকটা মোনালিসার ছবির মতোন। গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন, এই বনলতা সেনটা কে? এই নামে সত্যি আপনার পরিচিত কেউ ছিল নাকি?’ উত্তরে কবি শুধুমাত্র একগাল মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। কবি কখনো নিজের অজান্তেও এই বিষয়ে কারো কাছে কিছু বলেন নি। বাঘা বাঘা সব গবেষকরাও বছরের পর বছর গবেষণা করে এই ‘বনলতা সেন’ রহস্য উদঘাটন করতে পারেন নি।
বনলতা সেন আসলে কবির কল্পনা।
আবার এমনও হতে পারে- কোথাও তাদের একবার দেখা হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। লাভ এট ফ্রার্স্ট সাইট টাইপের ব্যাপার। তারপর অনেকদিন একজন আরেকজনকে খুঁজেছেন আর যখন পেয়েছেন তখন জীবনের লেনদেন শেষের পথে? বনলতা নামের সাথে নাটোর শহরের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কবিতায় একটি লাইনও আছে এইভাবে – ‘নাটোরের বনলতা সেন’। কেউ কেউ আবার এই কবিতাকে কবির জীবনের এক প্রেমিকা শোভনার সাথে তুলনা করেছেন। জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন ছিলেন শোভনা।
এতদিন কোথায় ছিলেন’ একটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন নয়, এ হচ্ছে বিপর্যস্ত নারীত্বের আর্তনাদ। নিষিদ্ধ প্রেমের আনন্দ ও বেদনা এত সুন্দরভাবে আর কোন কবি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। বনলতা নামটি অবশ্যই ছদ্মনাম। বনলতা সেন কবিতায় অপরাধবোধ খুঁজতে যাওয়া একটি ব্যর্থশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ এ ধরনের কোন বোধের লেশমাত্রও কবিতাটির কোন ছত্রে বা শব্দে আভাসিত বলে মনে হয় না। আবু তাহের মজুমদার বলেছেন, বনলতা সেন আসলে বরিশালের ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাঁর বর্ণনা জীবনানন্দের কারুবাসনা উপন্যাসে রয়েছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের পাশের বাড়ির একজন নারী।
বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:২৬