
গত বছর ১১ ডিসেম্বর আব্বা মারা যায়।
৬০/৬২ বছর হবে আব্বার। আব্বার তেমন কোনো অসুখ ছিলো না। ডায়বেটিকস ছাড়া। ডায়বেটিক চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। আব্বা ভালোর দিকে। ঠিক তখন হাসপাতালেই আব্বা করোনায় আক্রান্ত হয়। করোনা চিকিৎসা চলা অবস্থায় আব্বা মারা যায়। তখনও করোনার ভ্যাকসিন আসেনি। সত্যি কথা বলি- আব্বার আচমকা মৃত্যুতে আমি ভীষন ধাক্কা খাই। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আব্বা এত তাড়াতাড়ি মরে যাবে আমি এটা ভাবিনি। আমাদের বংশে সবাই দীর্ঘদিন বাঁচে। আমার দাদা দাদী ৮০/৮৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর, সেদিন ছিলো শুক্রবার। আমি গভীর ঘুমে। মোবাইলে ফোন বেজেই চলেছে। সকাল আট টায় জানতে পারি আব্বা মারা গেছে।
আব্বা মারা গেছে এক বছর হয়ে গেলো আজ।
অথচ এখনও আমার মনে হয় আব্বা মারা যায় নি। জরুরী কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। একদিন আব্বাকে ফোন দিলাম। দেখি মোবাইল বন্ধ। পরে আমার মনে পড়লো, আব্বা তো নেই। মারা গেছে। যদি আবার আব্বাকে ভুলে ফোন দেই। তাই আব্বার নাম্বারটি মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিলাম। আমার কাছে আব্বার কিছু ছবি ছিলো। সেই ছবি গুলো আমি ডিলিট করে দিয়েছি। কারন ছবি গুলো দেখলেই ভীষন কষ্ট হয় আমার। ভীষন। বাবা কি জিনিস বাবা বেঁচে থাকতে বুঝি নাই। যেদিন আমি নিজে বাবা হলাম সেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি বাবা কি জিনিস। আমার অনেক কথা ছিলো। গল্প ছিলো- আব্বাকে বলার। বলব, বলব করে আর বলা হয়নি। আমার মনে অনেক জমানো কথা গুলো শুধুই আব্বার জন্য। সেই সমস্ত কথা গুলো আমৃত্যু আমাকে বহন করে চলতে হবে।
গ্রামে গতকাল মিলাদ হয়েছে।
কোরআন খতম দেওয়া হয়েছে। গরীব দুঃখীদের খাওয়ানো হয়েছে। মেন্যু ছিলো- সাদা ভাত। করলা ভাজি চিংড়ি মাছ দিয়ে। রুই মাছ দিয়ে লাউ। ডাল। গরুর মাংস। মূরগীর মাংস। পায়েস ছিলো। রান্না বেশ ভালো হয়েছে। আজ সারাদিন আমি গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। আমাদের ছোট গাড়ি। পরিবারের সবার জায়গা হবে না। তাই বড় গাড়ি ভাড়া নিয়ে সবাই একসাথে গ্রামে যাই। সবাই আব্বার কবরে গিয়েছে। কবর জিয়ারত করেছে। আমি আব্বার কবরের কাছে যাইনি। কবর জিয়ারত করি নি। আমি কেন আব্বার কবরে যাইনি তা শুধু আমিই জানি। আমার কতখানি জুড়ে আব্বা আছে তা শুধু আমিই জানি। আমি আজ খুব শান্ত ছিলাম। আব্বার জন্য আমার যে শোক, কষ্ট সেটা আমি একাই অনুভব করেছি। কাউকে বুঝতে দেইনি।
আজ দুপুরে ঢাকায় মাদ্রাসায় খাওয়ানো হবে।
কোরআন খতম ও দোয়া হবে। সারা দুনিয়াতে একজন মানুষ ছিলো আমার। যে আমার যেকোনো বিপদে সবার আগে সামনে এসে দাড়াতো। ভরসা দিতো। সাহস দিতো। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমি মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছি। আমার আত্মবিশ্বাস ও সাহস কমে গেছে। নিজেকে বড্ড বেশি দুর্বল মনে হয়- যখন মনে পড়ে আব্বা নেই। মারা গেছে। দুনিয়াতে বাপের মতো কেউ হয় না। সম্ভব না। আমি আমার কন্যাকে যতটুকু ভালোবাসি, আমার মতো করে কি আমার কন্যাকে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে? পারবে না। সম্ভব না। আমার কাছে সারা দুনিয়া একদিকে, আর আমার কন্যা আরেক দিকে। দুনিয়াতে সবার আগে আমার কন্যা। ঠিক তেমনি আমি ছিলাম আমার আব্বার কাছে সবার আগে।
একটা ছোটবেলার ঘটনা বলি, নতুন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভরতি হয়েছি। এবং বার্ষিক পরীক্ষায় চারটা সাবজেক্টে ফেল করেছি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্বাকে ডেকে নিয়ে গেলো। প্রধান শিক্ষন বললেন, দেখুন আপনার ছেলের কি অবস্থা। সেদিন আব্বা আমাকে কোলে করে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছিলো। বলেছিলো, মন খারাপ করিস না। ফেল করলে কি হয়? কিছুই হয় না। আগামী বছর ভালো করে পড়বি। পাশ করবি। ব্যস। ঝামেলা শেষ! এইবার হাসি দে। বড় করে হাসি দে। হাসি সুন্দর হলে বিরানী খেতে নিয়ে যাবো এখনই। বিরানীর কথা শুনে আমি বিশাল সাইজের এক হাসি দিলাম।
আমার কাছে আব্বা ছিলো একজন ম্যাজিশিয়ান।
আমার কাছে আব্বা ছিলো একজন সুপারম্যান। আব্বাকে কখনও মুখ ফুটে কিছু বলতে হতো না আমার। তিনি নিজে থেকেই সব বুঝে যেতেন। আমার মন খারাপ দেখলেই আব্বা বলতো- তোমার কোনো কিছু নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। তোমার বাবা বেঁচে আছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আসলেও জীবনে আমাকে কোনো কিছু নিয়ে বেগ পেতে হয়নি। বিনদাস ছিলাম। আব্বাকে যদি ফোন করে বলতাম, আব্বা মরন চাঁদের মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করছে। আব্বা মিষ্টি নিয়ে আসতো। আব্বাকে বলতাম, পুরান ঢাকার বিরানী খেতে ইচ্ছা করছে- আব্বা কাউকে দিয়ে বিরানী পাঠিয়ে দিতো। আব্বাকে যদি বলতাম- আব্বা আমার কেনাকাটা করতে হবে- আব্বা বলতো চলো যাই মার্কেটে। কুইক। একটা ঘটনা বলি- তখন আমি অনেক ছোট। আব্বা অনেক রাতে বাসায় ফিরতো ক্লান্ত হয়ে। আমি বলতাম, মা ছোট মাছ রান্না করেছে। আমি ছোট মাছ খাই না। আমি বিরানী খাবো। সেই রাত বারটায় আব্বা আমাকে বিরানী খেতে নিয়ে যেতো।
একবার রাজশাহী গিয়ে আটকা পড়লাম।
সুরভি আর আমি। বাস বন্ধ। কিন্তু আমাদের ঢাকা আসতে হবে। আব্বাকে ফোন করে বললাম, আমার ঢাকা আসা জরুরী। আব্বা হেলিকাপ্টারের ব্যবস্থা করে দিলো। আমার আব্বা কোনো মন্ত্রী মিনিস্টার না। কিন্তু আমার মনে হতো চারজন মন্ত্রী মিনিস্টারের ক্ষমতা আব্বার পকেটে ছিলো। কোনো কিছুতেই আব্বা ভয় পেতো না। অথচ আব্বা খুবই একজন নরম মনের মানুষ। সবার সাথে আব্বা হাসি মুখে কথা বলতো। পরিচিত অপরিচিত যে কারো বিপদে নিজে থেকে এগিয়ে যেতো। একবার হরতালের সময় পুলিশ দুইজন ছেলেকে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিলো। আব্বা গিয়ে ছেলে দুজনকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিলো- ছেলে দুটা আপনার পরিচিত? আব্বা বলেছিলো না। আমার পরিচিত না। কিন্তু ওদের অন্যায়ভাবে আপনাড়া নিয়ে যাচ্ছিলেন।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



