
একবার এক চায়ের দোকানে গিয়েছি।
চা চাইলাম। দোকানদার বলল- চিনি শেষ। চা বানাতে পারছি না। কাস্টমার এসে ফিরে যাচ্ছে। দোকান খালি রেখে আমি চিনি আনতে যেতেও পারছি না। আমি দৌড় দিয়ে এক কেজি চিনি এনে দিলাম। আমি চিনি এনেছি বলে দোকানদার লজ্জায় শেষ। আরেকদিন হেঁটে হেঁটে কমলাপুর থেকে বাসায় ফিরছি। হঠাত দেখি ট্রাফিক পুলিশ নেই। চারদিক থেকে একসাথে সব গাড়ি, বাস, রিকশা, ট্রাক, সিএনজি একসাথে এসে জট পাকিয়ে দিয়েছে। একদম গিট্টু লেগে গেছে। জিলাপির প্যাচ। সাথে সাথে আমি হয়ে গেলাম ট্রাফিক। মুহুর্তের মধ্যে জট পাতলা হয়ে গেলো। আশেপাশের দোকানদাররা আমাকে বাহবা দিলো। ভালো কাজ করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ছাদে আমার গাছ আছে। আমি নিয়মিত গাছে পানি দেই। আমাদের পাশের বাসায় ছাদে অনেক গাছ। পুরো ছাদ জুড়ে গাছ। মাঝে মাঝে দেখা যায়- অনেকদিন পার হয়ে যায় কিন্তু তাঁরা গাছে পানি দেয় না। গাছ গুলো দেখতে মলিন হয়ে যায়। তখন আমি রেলিং টপকে ওদের ছাদে গিয়ে ওদের গাছে পানি দিয়ে আসি।
এক মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
সে যাবে শান্তিনগর। মেয়েটা অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা পাচ্ছে না। এদিকে যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে- এমন অবস্থা। যা-ও দুই একটা রিকশা মেয়েটা পাচ্ছে, সে রিকশা শান্তিনগর যাবে না। আমি দৌড় দিয়ে রাস্তার ওপাড় থেকে একটা রিকশাচালক ধরে নিয়ে এলাম। বললাম, শোনা ভাই, মিয়াঁ ভাই। মেয়েটাকে শান্তিনগর দিয়ে আসো। আমার কাকুতি মিনতি দেখে- রিকশা চালক রাজী হলো। কেউ বিপদে পড়লে অবশ্যই তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন। আমাদের গলিতে একটা সেলুন আছে। সেই সেলুনে কাজ করে লোকমান। লোকমানের দাঁতে সমস্যা। সারারাত সে ঘুমাতে পারে না দাঁত ব্যথায়। টাকা নেই বলে চিকিৎসা করাতে পারছে না। ডেন্টালে গিয়েছিলো সেখানে অনেক খরচ। এঁর টাকা লোকমানের নেই। এক রবিবার সকালে আমি লোকমানকে নিয়ে গেলাম মিরপুর- ১৪ নম্বর। সরকারী হাসপাতাল। এখানে শুধু দাঁতের চিকিৎসা হয়। এক মেয়ে ডাক্তার লোকমানের চিকিৎসা করলো। সব মিলিয়ে আমার দু শ' টাকাও খরচ হয়নি। এখন লোকমান আমার চুল দাঁড়ি কাটলে টাকা নিতে চায় না। বলে, আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। আমি ধমক দেই, টাকা রাখ গাধা। তারপর লোকমান আমাকে জোর করে চা খাওয়ায়।
আমাদের গলির মুখে একটা পুরী, পিয়াজু, আলুর চপ, বেগুনীর দোকান আছে।
একদিন দেখি দোকানে কোনো কারিগর নাই। দোকানের মালিক এক হাতে সব করছে। পুরী বানাচ্ছে। বিক্রি করছে। একা তার উপর খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে। সে হিমশিম খাচ্ছে। আমি তাকে সাহায্য করলাম। পুরী, পিয়াজু, আলুর চপ সব ভেজে দিলাম। লোকটার উপকার করে দিলাম। তাতে আমার তো কোনো ক্ষতি হয়নি। মানুষ হয়ে জন্মেছি, মানুষের উপকার করবো না! এক মা তাঁরা ছেলেকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। ছেলে বলছে, মা আমাকে কোলে নাও। আমি হাঁটতে পারবো না। মা বলল, আমার শরীর ভালো না। আমি কোলে নিতে পারবো না বাবা। ছেলে শুরু করলো কান্না। তখন আমি বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি। ছেলে খুশি, ছেলের মা-ও খুশি। আমি নিজেও খুশি।
এখন বলব আমার ছোট বেলার গল্প।
৯০ সালের কথা। তখন আমাদের এলাকায় পানির খুব সমস্যা ছিলো। সারাদিন পানি থাকতো না। রাতে পানি আসতো। মানুষ বোল, বালতি, ঘামলা ইত্যাদি সব রাতা জেগে ভরে রাখতো। পানির সমস্যা কমাতে প্রতিটা বাড়িতে চাপকল লাগালো। আমি প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাপকল চেপে বালতি, ড্রাম ভরে দিয়ে আসতাম। কেন জানি চাপকল চাপতে আমার ভালো লাগতো। একটুও ক্লান্তি আসতো না। অনেকে চাপকল চাপতে পারতো না। পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা। বয়স হয়েছে। হাতে ঠোসা পড়ে যায়। আমার কোনো ব্যথা ছিলো না। আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। তুমুল উত্তেজনা ও শক্তি দিয়ে আমি চাপকল চেপে যেতাম। প্রতিদিন। আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখতাম সবাই আমার অপেক্ষায় থাকতো। আমাকে দেখলেই খুশিতে তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠতো।
আমার বাবার একটা কথা বলি-
৭৮ সালে আমাদের বাসার গলিটা ছিলো কাঁচা। বৃষ্টির দিনে পানি জমে যেন। কাঁদা মাটি দিয়ে মানুষ হাঁটতে পারতো না। বছরের পর বছর একই অবস্থা। আব্বা এক হাজার ইট কিনলো। সেই ইট পুরো রাস্তায় বিছিয়ে দিলো। মানুষ আরামে চলাচল করলো। একদিন দেখা গেলো- কে বা কারা ইট গুলো চুরী করে নিয়ে গেছে। শুক্রবার মানুষ জুম্মার নামাজ পড়তে যেতে পারে না। কাঁদা মাটিতে হাঁটা যায় না। তখন আব্বা আবার ইট কিনলো। প্রতি শুক্রবার নামাজে যেতে মানুষের যেন কোনো সমস্যা না হয়, তাই নিজে ইট বিছিয়ে দিতো। নামাজ শেষে আবার ইট বাসায় নিয়ে আসতো। টানা তিন বছর আব্বা এই এভাবে ইট বিছাতো। এরপর একদিন আমাদের গলির রাস্তাটা সরকার থেকে পাকা করা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৫:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




